হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-১১

আমার মার নাম আফিয়া বেগম। এমন কোনাে বড় নাম না, তারপরেও এই নামটা ছােট করে বাবা ডাকতেন আফি। ই-কারের টান যখন দীর্ঘ হতাে তখন বােঝা যেত বাবার মেজাজ শরিফ। এখানেই শেষ না, নাম নিয়ে বাবার দু’টা ছড়াও ছিল । যেমন— 

আফি আফি করতে হবে মাফি

লিলুয়া বাতাস

 আফি আফি 

You are কাফি প্রথম ছড়াটা বাবা বেশি বলতেন। মা’র চোখে মুখে তখন আনন্দ ঝরে পড়ত। মা হচ্ছেন স্বামীর প্রতিভায় মুগ্ধ হওয়া গােত্রের মহিলা। এই জাতীয় মহিলাদের চোখে একধরনের অদৃশ্য চশমা থাকে। যে চশমা স্বামীদের যাবতীয় ত্রুটি ফিল্টার করে রেখে দেয়। তাদের চোখে স্বামীদের গুণাবলিই শুধু ধরা পড়ে। 

আমরা যখন ভাড়াবাড়িতে থাকতাম তখন বাবা প্রথম মিল্লাত কোম্পানির একটা সিলিং ফ্যান কিনলেন। সেই ফ্যান বসার ঘরে লাগানাে হলাে। সুইচ টেপার পর ফ্যান থেকে বৃদ্ধ মানুষদের ধারাবাহিক কাশির মতাে ঘড়ঘড় আওয়াজ হতে লাগল। আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। ভাইয়া বলে ফেলল, এত শব্দ! মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ফ্যানে একটু আধটু শব্দ তাে হবেই। হাওয়া কত এটা দেখবি না ? ঝড়-তুফানের মতাে হাওয়া। 

বাবা বললেন, ফ্যানটা বদলায়ে নিয়ে আসি ? 

মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তুমি আবার কষ্ট করে গরমের মধ্যে ফ্যান নিয়ে যাবে! কোনাে দরকার নেই। ফ্যানে শব্দ হওয়া ভালাে, বােঝা যায় একটা জিনিস চলছে। 

 লিলুয়া বাতাস খন্ড-১১

মা’র প্রতি বাবার প্রেমও চোখে পড়ার মতােই। যে দোতলা বাড়িতে আমরা বাস করছি (তিনতলার ফাউন্ডেশন, দোতলা) তার নাম আফিয়া মহল। বাড়ির গেটে শ্বেতপাথরে বাড়ির নাম লেখা আছে। বাবার ঝোঁক হচ্ছে সস্তায় কাজ করানাে। শ্বেতপাথরের নামফলকটাও তিনি অতি সস্তায় করিয়েছেন বলে 

এক বছরের মাথায় আফিয়ার অ এবং মহলের ম উঠে গেল। 

এখন আমাদের বাড়ির নাম— 

ফিয়া হল। 

যেদিন বাড়িতে শ্বেতপাথরের নাম লাগানাে হলাে সেদিন বাবা কাঁপা কাঁপা গলায় ঘােষণা করলেন, সম্রাট শাহজাহান তাজমহল বানিয়ে ছিলেন, আমি বানালাম আফিয়া মহল । ইনশাল্লাহ আমি আগামী দুই এক বছরের মধ্যে তিন তলাটা কমপ্লিট করে দেব। তিনতলার আলাদা নাম হবে– 

আফিয়া আলয়। 

পুরা তিনতলা হবে আফিয়ার একার সংসার। তার শােবার ঘর, তার বসার ঘর, সাজের ঘর এবং নামাজ ঘর । আফিয়ার অনুমতি ছাড়া তিনতলায় কেউ যেতে পারবে না। এমনকি আমি যদি যাই আমারও অনুমতি লাগবে। 

বাবার কথাবার্তায় আমাদের হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু মা কেঁদে কেটে অস্থির। 

বাড়ি দোতলা পর্যন্ত হবার পর বাবা মানত রক্ষার জন্যে মাকে নিয়ে আজমির শরিফ গেলেন। পথে দিল্লিতে তারা তাজমহল দেখলেন। তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে ফটোগ্রাফারদের দিয়ে ছবি তুললেন। সেই ছবিও অনেক কায়দার ছবি। দুজন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছেন। দুজনের হাতের ফাঁক দিয়ে তাজমহল দেখা যাচ্ছে। এই ছবি বাঁধাই করে আমাদের বসার ঘরে টিভির পাশে ঝুলানাে হলাে। 

সেই ছবিটা গতকাল সকালে সরানাে হয়েছে। শুধু এই ছবি না, বাবার সব ছবিই নামানাে হয়েছে। মার ঘরে বাবার তিনটা ছবি ছিল। তিনি ব্যবসার জন্যে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন, তখন তােলা ছবি। প্রতিটি ছবিতে তাঁর চোখে কালাে চশমা ঠোটে পাইপ। 

মা’র ঘরে বিশেষ ভঙ্গিমায় তােলা এই ছবিগুলি শুধু যে নামানাে হলাে তা , কাজের মেয়েকে বলা হয়েছে শিল-পাটার শিল দিয়ে ছবির কাচগুলি ভাঙতে। সে কাচ ভাঙতে গিয়ে নিজের হাতও কেটেছে। এমনই কেটেছে যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে স্টিচও করাতে হয়েছে। 

 লিলুয়া বাতাস খন্ড-১১

বাবার বিষয়ে ভাইয়া এবং মা মিলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৩ হলো 

১. এই বদলােক কখনাে বাড়িতে ঢুকতে পারবে না।

২. এই বদের নাম বাড়িতে কেউ উচ্চারণ করতে পারবে 

৩. বদটার নামে স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই দ্বিতীয় বিবাহ এবং 

নারী নির্যাতন আইনে মামলা করা হবে। মামলা করা 

হয়ে গেছে। ৪. বদটাকে জেলের ভাত খেতে হবে। মা’র পক্ষে যে উকিল মামলা পরিচালনা করছেন তার নাম মােহম্মদ কায়েস উদ্দিন তালুকদার। এই কায়েস উদ্দিন সাহেবের হাবভাব চোরের মতাে। তিনি স্থির হয়ে কারাে দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারেন না। সারাক্ষণ এদিক-ওদিক করেন। তাঁর মুদ্রাদোষ হচ্ছে প্রতিটি কথার আগে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বলবেন ‘এখন তাহলে একটা কথা বলি? | তালুকদার সাহেব মাকে বললেন— এখন তাহলে একটা কথা বলি ? ভাবি সাহেব শুনেন, আমি যদি আপনার স্বামীকে সাত বছর জেলখানার লাবড়া না খাওয়াতে পারি তাহলে আমি বাকি জীবন ভাত খাব না। পাঞ্জাবিদের মতাে রুটি খাব। বড়বােন হিসেবে আপনার কাছে এই আমার ওয়াদা। 

মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আপনার স্বামী আপনার স্বামী করছেন কেন ? সে কি আমার স্বামী ? 

তালুকদার সাহেব বললেন, এখন তাহলে একটা কথা বলি ? উনি এখনাে আপনার স্বামী। আপনি ডিভাের্স করলে স্বামী থাকবে না। তবে এখন ডিভাের্স করা ঠিক হবে না। মামলা দুর্বল হয়ে যাবে। 

মা বললেন, মামলা দুর্বল হয় এমন কিছুই আমি করব না। ঐ বদটা সারাজীবনের জন্যে জেলে থাকতে পারে কি-না সেটা দেখেন। 

আপা, সেটা সম্ভব হবে না। সাত বছরের বেশি আমি পারব না । ঐ গ্যারান্টি আপনাকে আমি দিচ্ছি। আমি গ্যারান্টি দিয়ে মামলা চালাই। বিনা গ্যারান্টিতে মােহম্মদ কায়েস উদ্দিন তালুকদার মামলা নেয় না। 

বাবার মতাে ঘড়েল লােক তালুকদারের প্যাচে পড়ে সাত বছরের জন্যে জেলে যাবেন লাবড়া খেতে, এটা আমার কখনােই মনে হয় নি। মামলার প্রথম তারিখেই আমার সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হলাে। মা যে বাবাকে অনেক আগেই দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি দিয়েছেন সেই কাগজ (নােটারি পাবলিক দিয়ে নােটিফাই করানাে। সঙ্গে ওয়ার্ড কমিশনারের কাগজ, যে দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতির বিষয়টি তার জানা আছে) জমা দিলেন। 

 লিলুয়া বাতাস খন্ড-১১

আমাদের উকিল সাহেব মাকে বললেন, তাহলে একটা কথা বলি ? আপনার দুষ্ট হ্যাসবেন্ড যে এরকম একটা স্টেপ নিবে তা আমার হিসাবের মধ্যে আছে। সব রােগের যেমন চিকিৎসা আছে, এই রােগেরও চিকিৎসা আছে। দেখেন কী করি? 

মা বললেন, কী করবেন? 

মামলার কাগজপত্রের নকল নিয়ে এসেছি। আপনার সই জাল করা হয়েছে এটা প্রমাণ করব, ওয়ার্ড কমিশনারের চিঠিও যে জাল তাও প্রমাণ করব। এতে আমাদের মামলা আরাে শক্ত হবে- সাত বছরের জায়গায় আট-ন বছরের বাসস্থান উনার জোগাড় হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। 

মা কোর্টের কাগজপত্র দেখে, শুকনা মুখে বললেন, সই তাে জাল না। সই আমার । 

কখন সই করলেন ?

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড–১২

 

 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *