কখন সই করেছি মনে নাই। তবে সাদা কাগজে সই করেছি। ঐ বদ নানান সময়ে কাগজপত্রে আমার সই নিয়েছে। এই বাড়ি তাে আমার নামে, বাড়ির ট্যাক্স দিতে হবে, হেনতেন বলে সই করিয়েছে।
আপা, আপনি কোনাে চিন্তা করবেন না। এই হিসাবও আমার আছে । আমি বিনা হিসাবে কাজ করি না। একজন সাধারণ মানুষ ঘুঘু দেখলে ফাঁদ দেখে না। ফাদ দেখলে ঘুঘু দেখে না। আমি আপনাদের দশজনের দোয়ায় দুটাই একসঙ্গে দেখি। ব্যবস্থা নিচ্ছি।
কী ব্যবস্থা ? | যথাসময়ে জানবেন। প্রথমে যেটা দেখতে হবে— বাড়িঘর এখনাে আপনার নামে আছে, না-কি এখানেও কিছু দুই নম্বরি করা হয়েছে। এক সপ্তাহের ভেতর আপনি বাড়িঘরের টু পিকচার পাবেন। এখন আপনাকে একটা কথা বলি, ধৈর্য ধরুন। বদটা জেলে যাবে তাে ? অবশ্যই। সাত বছর?
মিনিমাম সাত। বেশিও হতে পারে । আপাতত জেলের চিন্তা মাথা থেকে দূর করতে হবে। প্রায়ােরিটি বেসিসে কাজ করতে হবে। বাড়িঘর ঠিক আছে কি-না আগে দেখতে হবে। প্রায়ােরিটি লিস্টে এটা নাম্বার ওয়ান।
এক সপ্তাহের মধ্যে জানা গেল, বাড়িঘর ঠিক ঠাক আছে। আফিয়া মহল মা’র নামেই আছে। তার নামেই নাম জারি করা হয়েছে। মিউনিসিপ্যালটি ট্যাক্সও তার নামেই দেয়া হচ্ছে।
লিলুয়া বাতাস খন্ড–১২
বাবার সাম্প্রতিক খবরে বিন্দুমাত্র বিচলিত যিনি হলেন না, তিনি বড়খালা– মাজেদা বেগম। তিনি বিচলিত লােডশেডিং নিয়ে। আমার সঙ্গে এই নিয়ে তার দীর্ঘ আলাপ হয়। তিনি হতাশ গলায় বলেন, এটা কী অবস্থারে বাবলু ? এক ঘণ্টা কারেন্ট না থাকা সহ্য করা যায় দেড় ঘণ্টা দু’ঘণ্টা এসি ছাড়া মানুষ বাঁচবে কীভাবে?
ঠিকই বলেছ, এসি ওয়ালাদের বিরাট দুর্ভোগ।
ভােল্টেজ কী রকম উঠানামা করে দেখেছিস ? যে-কোনােদিন কম্প্রেসার জুলে যাবে। তখন উপায় কী হবে ?
আরেকটা এসি কিনবে। তােমার তাে টাকার অভাব নেই। সেইটা যখন জ্বলে যাবে তখন? তখন আরেকটা।
উন্মাদের মতাে কথা বলিস না তাে বাবলু। তাের কথাবার্তা বদ্ধ উন্মাদের মতাে। আমি একটার পর একটা কিনতেই থাকব ? তুই আছিস নিজেকে নিয়ে। অন্যের দুঃখ-কষ্ট তাের মাথায় ঢােকে না। পরশু রাতে কী হয়েছে জানিস ?
বলাে । রাতে আরাম করে ঘুমাচ্ছি। ঘর ঠাণ্ডা। এসি চলছে। হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম, এসিটা বাস্ট হয়েছে। সেখানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি ঘর থেকে বের হতে গেলাম, দেখি আমার প্যারালিসিসের মতাে হয়েছে, বিছানা থেকে নামতে পারা দূরের কথা, শােয়া থেকে উঠে বসতেও পারছি না। এদিকে এসির আগুন বাড়ছে।
গায়ে আগুনের আঁচ লাগছে। শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তখন ঘুম ভাঙল । দেখি এসি বন্ধ। লােডশেডিং না কী যেন হয়েছে কে জানে! ঘরের ভেতরে অসহ্য গরম। আমি মাথায় পানি ঢাললাম, সারা গায়ে পানি ঢাললাম, বিছানায় পানি ঢাললাম, তাতেও গরম কমে না। কারেন্ট এলাে ভাের চারটা তেইশ মিনিটে, তখন ঘুমাতে গেলাম। বুঝলি অবস্থা ?
লিলুয়া বাতাস খন্ড–১২
তােমার জন্যে অবস্থা যে খারাপ এটা বুঝতে পারছি। তুই এসির লােককে খবর দে তাে। সার্ভিসিং করে দিক। গত মাসে তাে একবার সার্ভিসিং করল । আরেকবার করুক। সার্ভিসিং যত করবি তত ভালাে। আচ্ছা খবর দেব ।
এখন তুই ঘর থেকে যা, আমার গরম বেশি লাগছে। গায়ের কাপড়-চোপড় খুলে গায়ে এসির ঠাণ্ডা বাতাস মাখব । বনের পশুরা কী আরামে থাকে, একবার ভেবেছিস ? কাপড় পরতে হয় না…।
বাবার বিষয় নিয়ে আরাে একজন নির্বিকার। তিনি নীলা ফুপু। বাসায় কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে ফুপুর মাথাব্যথা নেই। তাঁর ধ্যান-স্বপ্ন প্যাকেজ নাটক। পরিচালক মুকুল ভাই, নাটকের লােকজন অভিনেতা, অভিনেত্রী, ক্যামেরাম্যান, মেকাপম্যান, লাইটম্যান। বাসায় তিনি যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণ তার হাতে মােবাইল টেলিফোন থাকে। তিনি হাঁটতে হাঁটতে নাটকের সঙ্গে যুক্ত কারাে না কারাে সঙ্গে গল্প করেন।
‘কে, মারুফ ভাই ? শট দিচ্ছেন ? তাহলে পরে টেলিফোন করব। কার নাটক ? ও বিশু ভাইয়ের ? মেগা সিরিয়েল না-কি সিঙ্গেল ? মেগা ? বিশু ভাইকে বলেন না, আমাকে কোথাও ঢুকিয়ে দিতে। আমি ফ্রি আছি।
লুনা আপু! খবর পেয়েছি ঐদিন আপনি খুব মজা করে জন্মদিন করেছেন। আমার কথা তাে মনে পড়ল না। আপনার জন্যে একটা গিফট রেখে দিয়েছি ফেস ওয়াশ। বেলজিয়ামের তৈরি। কৌটাটা খুব কিউট। আমি এসে বাসায় দিয়ে যাব। কবে আসব বলুন।
‘হ্যালাে, কে, ফরিদ ভাই ? ভালাে আছেন ফরিদ ভাই ? ভাবি ভালাে আছেন? আপনার মেয়েটার যে হাম হয়েছিল, হাম কমেছে ? ছােটবেলায় আমার একবার হয়েছিল, যা কষ্ট দেয়। একটু কাজের কথা বলি ফরিদ ভাই ? আপনারা আমাকে যে রােলটা দিয়েছেন সেটা না-কি আমার আগে আরাে দুজনকে আপনারা অফার দিয়েছেন। তারা রিজেক্ট করেছে। সেই রােল আমাকে দিয়েছেন।
লিলুয়া বাতাস খন্ড–১২
যাদের অফার করেছেন তারাই আমাকে বলেছে । আচ্ছা ফরিদ ভাই, আমি কি এতই ফেলনা ? হ্যা, আমি করব। করব না কেন? আপনাদের পার্টির সঙ্গে আমার সম্পর্ক আলাদা। আমরা জয়েন্ট ফ্যামিলির মতাে, তাই না ? ফরিদ ভাই, আমি একদিন আপনাদের বাসায় যাব। ভাবির সঙ্গে গল্প করব আর আপনার মেয়েটাকে দেখে আসব । আপনার মেয়েটা কী যে সুইট হয়েছে ফরিদ ভাই। আপনার মেয়ের জন্যে আমি এক প্যাকেট চকলেট আলাদা করে রেখেছি। সুইজারল্যান্ডের চকলেট। টিনের ভেতর থাকে।
নীলা ফুপুর সঙ্গে গত বুধবারে আমি শুটিং দেখতে গিয়েছিলাম। ফুপু আমাকে জোর করে নিয়ে গেল। নায়কের সঙ্গে তাঁর না-কি সিরিয়াস অ্যাকটিং আছে। দেখার মতাে জিনিস হবে ।
আমি বললাম, তুমি নায়িকা না-কি ?
না, আমি নায়িকা না। নতুন একটা মেয়ে নায়িকা। অভিনয়ের অ জানে না। চেহারাও বান্দরীর মতাে। প্রডিউসারের সাথে ইটিস-পিটিশ আছে, এইজন্যে তাকে নিয়েছে।
তুমি তাহলে নায়কের সঙ্গে কী করবে?
সিকোয়েন্সটা তােকে বলি। পার্কের সিকোয়েন্স । আমি একটা গাছে হেলান দিয়ে বাদাম খাচ্ছি, এমন সময় নায়ক রিয়াজ ভাই আসবে। আমাকে দূর থেকে দেখে মনে করবে, আমিই তার নায়িকা। রিয়াজ ভাই পা টিপে টিপে এসে আমার পাশে বসবে, মাথায় টোকা দেবে। আমি চমকে রিয়াজ ভাইয়ের দিকে তাকাব। রিয়াজ ভাই বলবেন, Sorry, 1 made a mistake. তারপর উঠে চলে যাবেন ।
তােমার কী ডায়ালগ ?
আমার কোনাে ডায়ালগ নেই। ক্লোজ ট্রিটমেন্টের সিকোয়েন্স তাে । এইসব সিকোয়েন্সে ডায়ালগ দিলে সিকোয়েন্স পড়ে যায় । এইসব সিকোয়েন্স হলাে এক্সপ্রেশনের খেলা।
তুমি কী এক্সপ্রেশন দেবে ?
লিলুয়া বাতাস খন্ড–১২
আমার সঙ্গে চল । নিজের চোখে দেখবি। এই ধরনের সিকোয়েন্স দেখার মধ্যেও মজা আছে। নানান দিক থেকে লাইট করবে। ব্যাক লাইট দিবে। ব্যাক লাইট কি জানিস ?
না।
পেছন থেকে যে লাইট দেয় তাকে বলে ব্যাক লাইট। ব্যাক লাইট দিলে চেহারা ফুটে উঠে। আমার পেছনে যখন ব্যাক লাইট দিবে তখন দেখবি চেহারা কেমন বদলে যায়। আমাকে রাজকন্যার মতাে লাগবে। নীলা ফুপুর অভিনয় দেখতে না যাওয়াই ভালাে ছিল। পরিচালক সাহেব (মুকুল ভাই না, অন্য একজন) এমন ধমক শুরু করলেন।
ধমকের ভাষাও খারাপ— এই গাধী মেয়েকে কে এনেছে ? হাত-পা শক্ত করে বসে আছে। কেউ একজন এর গালে একটা থাপ্পড় দাও তাে। এই মেয়ে, তুমি আগে আগে মাথা ঘােরাও কেন ? আবার যদি আগে আগে মাথা ঘােরাও ঘাড় মটকে দেব । গাধীর গাধী!
পরিচালক সাহেবকে আমি দোষ দিতে পারি না। নীলা ফুপু আসলেই কিছু পারছে না। অ্যাকশান বলার আগপর্যন্ত ঠিক আছে। অ্যাকশান বলার পরপরই
Read More
হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৩