হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৩

উনার হাত-পা-মুখ সব শক্ত। নিঃশ্বাসও বন্ধ । জীবন্ত মানুষ থেকে হঠাৎ তিনি মূর্তি হয়ে যাচ্ছেন। নায়ক তার পেছনে দাঁড়ানাে মাত্রই তিনি আড়চোখে তাকাবেন । তাকিয়ে শরীরে ছােট্ট ঝাঁকি দেবেন।শেষপর্যন্ত টেক ওকে হলাে। তবে পরিচালকের মন মতাে হলাে না। তিনি তাঁর অ্যাসিসটেন্টকে বললেন, এই গাধীকে আবার যদি কল দিয়ে আনাে, তােমাকে আমি কানে ধরে উঠবােস ক্লাব। ত্রিশ সেকেন্ডের সিকোয়েন্সে একঘণ্টা খেয়ে ফেলেছে।

লিলুয়া বাতাস

নীলা ফুপু বেশ স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয় নি। তিনি তার নিজের জন্যে এবং আমার জন্যে দুকাপ চা নিয়ে নিলেন। চাপা গলায় বললেন, প্রডাকশনের লেবু চা, খেয়ে দেখ মজা পাবি। দুপুরে এফডিসি’র খানা আসবে । মিনিমাম দশ পদের ভর্তা থাকবে। সঙ্গে মাছ গােশত। মাছ গােশত দু’টাই কেউ পাবে না । যারা গােশত নিবে তারা মাছ পাবে না। শুধু ডিরেক্টর সাহেব এবং নায়ক-নায়িকা মাছ-গােশত দু’পদই পাবে। এটাই নিয়ম।দুপুর পর্যন্ত থাক, খেয়ে যা। 

আমি বললাম, তােমার কি আরাে সিকোয়েন্স আছে ? | আর নেই। তবু থাকতে হয়। একটা ইউনিটের সঙ্গে আছি, কাজ নেই বলে চলে যাওয়া তাে ঠিক না। | তুমি বরং চলেই যাও। ডিরেক্টর সাহেব যেমন রেগেছেন। তােমাকে মারবেন। 

তুই কী যে বলিস! টেক’-এর সময় উনি সবাইকে ধমকা ধমকি করেন। সিকোয়েন্স শেষ হয়ে গেলে আবার মাটির মানুষ । সবার সঙ্গে হাসি খুশি । জোক 

বলছেন, মজা করছেন। আয় তাের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। 

কোনাে দরকার নেই। 

দরকার আছে। তাের ধারণা হয়েছে, উনি আমার ওপর রেগে আছেন। ধারণাটা কত ভুল এক্ষুনি প্রমাণ পাবি। 

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৩

আমার প্রমাণের দরকার নেই।। আয় তাে। 

নীলা ফুপু আমার হাত ধরে প্রায় টেনেই ডিরেক্টর সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি মুখভর্তি করে পান খাচ্ছিলেন। এক হাতে আবার চায়ের কাপ । পান এবং চা কি একসঙ্গেই খাচ্ছেন? অসম্ভব না। এরা তাে আর আমাদের মতাে সাধারণ মানুষ না। 

স্যার, এ আমার ভাইয়ের ছেলে। এর নাম বাবলু। 

ডিরেক্টর সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বিনীতভাবে বললাম, স্যার, স্লামালিকুম । ডিরেক্টর সাহেব সালামের জবাব না দিয়ে নীলা ফুপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তােমার কাজ শেষ না ? 

নীলা ফুপু বললেন, জি স্যার। তাহলে এখনাে ঘুরঘুর করছ কেন? বাড়ি যাচ্ছ না কেন? 

আমরা ট্যাক্সি ক্যাবে ফিরছি। ট্যাক্সিতে উঠে নীলা ফুপু সামান্য কান্নাকাটি করলেও এখন স্বাভাবিক। শাহবাগের কাছে এসে আমাকে বললেন, তুই এখানে নেমে যা। আমি একটু মুকুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি । দশটা টাকা রাখ, রিকশা ভাড়া। 

দশ টাকা বলে যে নােটটা তিনি আমার হাতে গুঁজে দিয়েছেন সেটা একটা একশ’ টাকার নােট। আমি বললাম, ফুপু, তুমি ভুলে একশ’ টাকার নোেট দিয়েছ। 

ফুপু বললেন, দিয়েছি যখন রেখে দে। ফেরত দিতে হবে না ? তুই কি গাধা নাকি ? 

ট্যাক্সি থেকে নেমে হঠাৎ করে মনে হলাে, আমি আমার এই ফুপুকে খুবই পছন্দ করি। কেন করি? উনি বােকা বলে কি পছন্দ করি ? বুদ্ধিমান মানুষদের কেউ পছন্দ করে না। মানুষ পছন্দ করে বােকাদের। তবে বড়খালাকে আমি কেন পছন্দ করি না ? উনি তাে যথেষ্টই বােকা। এদিকে জহির ভাইকে আমার বেশ পছন্দ। জহির ভাই অসম্ভব বুদ্ধিমান। তাহলে কি এই দাঁড়াচ্ছে না যে, মানুষ বােকাদের পছন্দ করে, এই থিওরি ভুল ? 

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৩

নীলা ফুপু মাঝে মধ্যেই পাঁচটা টাকা রাখ বলে একটা পঞ্চাশ টাকার নােট দেন কিংবা দশটা টাকা রাখ বলে একটা একশ’ টাকার নােট দেন। এই কারণেই কি উনাকে পছন্দ করি ? পছন্দটা কি অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত ? তাও তাে ঠিক না। জহির ভাই কখনাে আমাকে টাকা-পয়সা দেন না। তারপরেও তাে 

তাকে আমার খুবই পছন্দ। 

জহির ভাই টাকা-পয়সা দেন না, তার মূল কারণ অবশ্যি উনার কাছে টাকা-পয়সা নেই । উনি নিজেই চলেন এর তার কাছে হাত পেতে । এখন অবশ্যি তাঁর অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি “দি ইমেজ’ এ স্থায়ী হয়েছেন। ভালােভাবেই স্থায়ী হয়েছেন। ফারুক ভাইয়ের স্ত্রী (নাসরিন )

দেখতে শাকচুন্নির মতাে। দাঁত ভাসা, চুলের রঙ প্রায় লাল) না-কি জহির ভাইকে অনুরােধ করেছেন মৃত বন্ধুর ব্যবসা দেখাশােনা করতে। তাঁর বিশ্বাসী কেউ নেই। জহির ভাই ভরসা। জহির ভাই রাজি হয়েছেন। এখন তিনিই ভিডিও ব্যবসা দেখেন। শাকচুন্নি মহিলাকে আগে কখনাে দি ইমেজে দেখা যায় নি। এখন তিনি প্রায়ই আসেন। বিহারি মেয়েদের মতাে ঝলমলা শাড়ি পরেন। গালে কী যেন মাখেন— এতে গাল আপেলের মতাে লাল টুকটুক হয়ে যায় । তারপরেও এই মহিলার দিকে তাকানাে যায় না। ভিডিও দোকানের স্টাফরা আড়ালে তাকে দু’টা নামে ডাকে। এক, ঘােড়ামুখী। এই নামকরণ ঠিক আছে। সাইড থেকে দেখলে তার মুখের সঙ্গে ঘােড়ার মুখের মিল আছে। তবে তাঁর আরেকটা নাম হলাে শিয়ালমুত্রা। এই নামের পেছনের কারণ কী জানি না । কোনাে একদিন জিজ্ঞেস করে জেনে নিব। 

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৩

শিয়ালমুত্রার সঙ্গে একদিনই আমার কথা হয়েছে। উনি আমাকে দেখে বললেন, তুমি জহির সাহেবের ভাই না ? সারাদিন তােমাকে ঘােরাঘুরি করতে দেখি, স্কুলে যাও না ? 

স্কুল বন্ধ। 

এখন কিসের স্কুল বন্ধ ? বাংলাদেশের সব স্কুল খােলা, তােমারটা বন্ধ এর মানে কী ? আমার সঙ্গে বাইচলামি কর ? 

এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি তাে, এই জন্যে স্কুল বন্ধ। ও আচ্ছা তাই বলাে । তুমি কি এখান থেকে ভিডিও নিয়ে যাও ? জি। তুমি দেখ, না আর কেউ দেখে ? আমার বড়খালা দেখেন। এক্স রেটেড ছবি নাও না তাে ? যে ছেলেমেয়ের কুকর্মের ছবি ? জি-না। 

আমি কিন্তু রেজিস্টার চেক করে দেখব। যদি দেখি ট্রিপল এক্স বা ডাবল এক্স ছবি নিয়েছ– তাহলে কিন্তু তােমার খবর আছে। তােমার বাসায় কমপ্লেইন করা হবে । বুঝেছ তাে ? 

জি। 

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৩

 

আরেকটা কথা তােমাকে বলব । এই কথাটা উঁচাগলায় বলতে পারব না। চাপাগলায় বলব। আমি চাই না বাইরের কেউ শুনুক। 

আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। শিয়ালমুত্রা ফিসফিস করে বললেন, এ৩৯ণ ধরে তােমার সঙ্গে কথা বলছি, তুমি আমার চোখের দিকে তাকাও নাই। ৩াকিয়ে ছিলে আমার বুকের দিকে। সেই দিনের বাচ্চাছেলে, মুখের দুধের গন্ধ এখনো যায় নাই, এর মধ্যেই মেয়েছেলের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকা শিখেছ। যাও সামনে থেকে । 

আমি ভদ্রমহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম না, এটা ঠিক । তবে আমি তাঁর বুকের দিকে তাকিয়ে ছিলাম না। আমি তাকিয়ে ছিলাম তার দাঁতের দিকে। 

জহির ভাইয়ের সঙ্গে এই মহিলার সম্পর্ক কোন পর্যায়ের আমি এখনাে জানি । জহির ভাই তাকে ডাকেন রুবি। মনে হয় রুবি এই মহিলার ডাকনাম। 

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৩

একদিন জহির ভাইয়ের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি, ‘দি ইমেজ’-এর ম্যানেজার কাদের সাহের গম্ভীর গলায় বললেন, বাবলু, এখন যেও না। ম্যাডাম জহির ভাইয়ের সঙ্গে আছেন। ঘণ্টাখানিক পরে এসাে। 

বলতে ভুলে গেছি, কাদের সাহেবকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও পরে ছেড়ে দিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত হয়েছে। কিছু টাকা খরচ হয়েছে, তার পরিমাণও অল্প। 

কাদের সাহেব লােক ভালাে। গাট্টাগােট্টা চেহারা। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তাকে দেখলেই মনে হয় ফুটবল কোচ বা এই ধরনের কেউ । তিনি সব সময় ভুরু কুঁচকে রাখেন। মনে হয় গভীর কোনাে চিন্তার মধ্যে থাকেন। তিনি কারাে সঙ্গেই বিশেষ কথাবার্তা বলেন না— তবে আমার সঙ্গে মাঝে মধ্যে। কথা বলেন। 

জহির ভাইয়ের ঘরের সামনে থেকে ফিরছি, কাদের সাহেব বললেন, বাবলু, কোক ফান্টা এইসব কিছু খাবে ? 

আমি বললাম, জি-না। তােমাদের রেজাল্ট কবে হবে ? এখনাে জানি না। 

আমি শুনলাম তুমিও তােমার বড়ভাইয়ের মতাে ভালাে ছাত্র, সত্যি না-কি ? তুমিও তাে ফাস্ট সেকেন্ড হবে ? 

এখন তাে কেউ আর ফার্স্ট সেকেন্ড হয় না। এখন গ্রেডিং হয়। 

তা ঠিক, খুবই বাজে সিস্টেম। ফার্স্ট সেকেন্ড হলে ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়। ছবি দেখে অন্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কম্পিটিশনের ভাব আসে। ঠিক না ? 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৪

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *