হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৬

বাবা চল যাই হাসপাতালে। ভর্তি করানাে যায় কি-না দেখি। 

ঠিক আছি। আমি ঠিক আছি। বমি করার পর শরীরটা ফর্মে চলে এসেছে। তুই বাসায় চলে যা। বাসায় গিয়ে সাবান ডলে গরম পানি দিয়ে একটা গোসল দিবি । নয়তাে দেখা যাবে তােকেও ধরেছে। ভাইরাস মারাত্মক জিনিস, একবার ধরলে জান ‘বিলা করে দেয়।

লিলুয়া বাতাস

যূথীর মনে হয় আমার আনা হাতিটা খুব মনে ধরেছে। হাতিটা সে জড়িয়ে বুকের কাছে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে হাত টান করে সে হাতিটা তার চোখের সামনে আনে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, আবার বুকে চেপে ধরে। আমি বললাম, যূথী, তােমার কি হাতি পছন্দ হয়েছে ? সে প্রশ্নের জবাব দিল না। আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। তার ভুবনে আকাশী রঙের হাতিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি বললাম, যূথী, যাই ? সে শুধু ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। কিছুই বলল। 

আমার কাছে পনেরশ টাকা ছিল। হাতির পেছনে নয়শ’ টাকা খরচ হয়েছে। এতগুলি টাকা সামান্য একটা তুলা ভরা খেলনার পেছনে খরচ করতে মায়া লাগছিল— এখন ভালাে লাগছে। এই বাচ্চামেয়েটি বড় হবে।

সে তার সমগ্র জীবনে অসংখ্য উপহার নিশ্চয়ই পাবে, কিন্তু কোনাে উপহারই হাতিটার স্থান নিতে পারবে না। এই মেয়েরও একদিন মেয়ে হবে। তার জন্মদিন হবে । জন্মদিনের মেয়েকে তার মা বলবে, আমি যখন তাের মতাে ছােট ছিলাম তখন আমি জন্মদিনে একটা হাতি পেয়েছিলাম। পৃথিবীর সবচে’ সুন্দর হাতি। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৬

বাচ্চামেয়েটি আগ্রহ করে জানতে চাইবে, কে দিয়েছিল ? যূথী বলবে, বাবলু দিয়েছিল। বাবলু কে ? আমার ভাই। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। 

আচ্ছা আমি কি মেয়েটিকে স্নেহ করি ? হয়তাে করি। স্নেহ না করলে এত টাকা দিয়ে হাতি কিনব কেন। আবার এও হতে পারে যে স্নেহ-ট্রেহ কিছু না, আমি ঘটনা দেখতে আসি। বড়খালা ভিডিওতে ঘটনা দেখে মজা পান। আমি বাস্তবের ঘটনায় মজা পাই। 

মায়ের উকিল তালুকদার সাহেবের পরামর্শে মা বাবার সঙ্গে একান্তে দেখা করতে রাজি হলেন। তবে মা একা কিছুতেই যাবেন না। সঙ্গে কাউকে না কাউকে যেতে হবে। ঠিক হলাে আমি মাকে নিয়ে যাব। কোথায় যাব সেই জায়গাও ঠিক হলাে। ধানমণ্ডিতে জিংলিং নামের একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট।

দুপুরবেলা যাওয়া হবে, তখন তােকজন কম থাকে। উকিল সাহেব মা’কে কী বলতে হবে না বলতে হবে সব শিখিয়ে দিলেন। আমার প্রতি নির্দেশ হলাে— তারা যখন কথা বলা শুরু করবেন, তখন আমি অন্য টেবিলে চলে যাব। একা একা কোক বা সেভেন আপ খাব। 

উকিল সাহেব বললেন, কোন কোন পয়েন্টে কথা বলবেন এইগুলা আমি আলাদা কাগজে লিখে দেই। 

মা বললেন, দরকার নেই, আমার মনে থাকবে। দেখা হওয়ার মানসিক উত্তেজনায় পয়েন্ট বাই পয়েন্ট কথা মনে নাও আসতে পারে। ঐ লােককে দেখে আমার মানসিক উত্তেজনা হবার কিছু নেই। যা হবে তার নাম রাগ। রাগের সময় মানুষ বেশি ভুল করে। আমি ভুল করব না। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৬

চাইনিজ রেস্টুরেন্টের এক কোনায় বাবা বসেছিলেন। অসুখ থেকে উঠায় তাঁকে খুবই কাহিল লাগছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছেন। পাঞ্জাবিটা কুঁচকানাে। বাইরে বের হবার সময় বাবা কাপড়-চোপড়ে খুব সাবধান থাকেন। ইস্ত্রি ছাড়া কাপড় পরেন না। আজ মনে হয় ইচ্ছা করেই কুঁচকানাে কাপড় পরেছেন। নিজের হতাশ চেহারাটা দেখাতে চাচ্ছেন। 

বাবা সিগারেট টানছিলেন। মাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আধখাওয়া সিগারেট অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিলেন। আমার ধারণা, বাবা এই প্রথম তাঁর স্ত্রীকে দেখে সম্মান করে উঠে দাঁড়ালেন। 

বাবা বললেন, কেমন আছ? 

মা জবাব দিলেন না। তিনি বসলেন বাবার মুখােমুখি। আমি বললাম, আমি কি অন্য টেবিলে যাব ? 

মা বললেন, যেখানে বসে আছিস সেখানে বসে থাক । 

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যুপের অর্ডার দেই ? চাইনিজের আসল খাবার স্যুপ। এই একটা জিনিসই এরা বানাতে শিখেছে। বাকি সব অখাদ্য। 

আমি বললাম, স্যুপ খাব না বাবা । বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, থাক তাহলে স্যুপ বাদ। পানি খেয়ে পেট ভরানাের মানে হয় না। আফিয়া, তুমি কী খাবে বলাে? তুমি তাে আবার সেভেন আপ ছাড়া কিছু খাও না। আমি এসেই খোঁজ নিয়েছি। এদের কাছে সেভেন আপ নেই। মিরিন্ডা আছে। জিনিস একই। দিতে বলি একটা মিরিন্ডা ? 

 মা বললেন, বকবকানিটা বন্ধ করবে ? সারাজীবনই তাে বকবক করলে। এখন একটু কম কর। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৬

বাবা চুপ করে গেলেন। মা বললেন, কবে আমি তােমাকে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলাম ? তােমার আদরের ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে মাথায় হাত রেখে বলাে তাে কবে দিয়েছি। | বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আফিয়া, কাজটা করেছি জানে বাঁচার জন্য। এই বয়সে জেলে ঢুকতে হলে সমস্যা না ? সাদা কাগজে তােমার সিগনেচার করা কয়েকটা পাতা ছিল । ঐটা ব্যবহার করেছি। 

আমার দস্তখত করা এমন কাগজ তাে তােমার কাছে আরাে আছে। আছে ম করে নিয়ে এসেছি তার 

আরাে দু’টা আছে। সেই দুই কাগজ দিয়ে নতুন কোনাে প্যাচ খেলবে না ? att att I My word of honour. মা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা যাই। বাবলু উঠ। বাবা বললেন, সে-কী! কোনাে কথাই তাে হয় নি। মা বললেন, যা হয়েছে যথেষ্ট । বাবলু, এখনাে বসে আছিস কী জন্যে ? আয় । 

বাবা হড়বড় করে বললেন, এফডিআর একটা ম্যাচিউর হয়েছে । ঐ টাকাটা নিয়ে একটু কথা বলতাম। খুবই খারাপ অবস্থায় আছি । বাড়ি ভাড়া বাকি 

পড়েছে দুই মাসের… আফিয়া শােন… 

বাবাকে হতাশ অবস্থায় রেখে আরা মাতা-পুত্র বের হয়ে এলাম। রিকশা করে ফিরছি, মা চাপা গলায় বললেন, ঐ বদ এখন বুঝবে কত ধানে কত পােলাউয়ের চাল। তার প্রতিটি কথা ডিজিটাল রেকর্ডারে রেকর্ড করা হয়েছে। উকিল সাহেব আমাকে রেকর্ডার দিয়ে দিয়েছিলেন । তাের বাপ পরিষ্কার বলেছে না সাদা কাগজে করা আমার সিগনেচার সে ব্যবহার করেছে। বলেছে না ? 

বলেছে। 

বলেছে— সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড হয়ে গেছে। অতি চালাকের গলায় দড়ি পড়ে, জানিস তাে ? তাের বাপের গলায় দড়ি পড়েছে। 

কাজটা কি ঠিক হয়েছে মা ? 

তাের বাবা যে কাজটা করেছে সেটা ঠিক, আর আমারটা ভুল ? রিকশা থামতে বল তাে। কেন ? 

গলা শুকিয়ে গেছে, একটা সেভেন আপ খাব। ঠাণ্ডা দেখে আনবি । আমার কাছে ভাঙতি টাকা নেই।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড–১৭

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *