হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-৩

উনার রেডিয়েশন তাের উপর আসতে পারে। সব মানুষের রেডিয়েশন আছে, এটা জানিস ?

লিলুয়া বাতাস

সব মানুষের রেডিয়েশন আছে। কারােরটা ভালাে কারােরটা মন্দ। আমি একজন পীর সাহেবের কাছে যাই। উনার রেডিয়েশন মারাত্মক। ধাক’ টের পাওয়া যায়। 

তােমার পীর সাহেব আছে না-কি ? 

আছেন একজন। তবে আমি উনার মুরিদ না। এমি মাঝে-মধ্যে যাই। আমাকে স্নেহ করেন । তােকে নিয়ে যাব একদিন। কিছুক্ষণ কথা বললেই উনার পাওয়ার বুঝবি। উনি থাকেন হাঁটার মধ্যে। দিনরাত হাঁটেন। তার পেছনে পেছনে ভক্তরা হাঁটে। মজুম অবস্থা। 

মজুম অবস্থা কী ? 

সাধনার স্তর। শেষ স্তরের নাম ফানা ফিল্লাহ। সেটা কঠিন জিনিস! আল্লাহ পাকের সঙ্গে ডাইরেক্ট কানেকশন। 

বাবার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। তিনি এখনাে উঠছেন না। মনে হয় তিনি আরাে কিছুক্ষণ কথা বলবেন। 

তাের বড়খালার ব্রেইন যদি সত্যি সত্যি আউট হয়ে যায় তাহলে তাে বিরাট সমস্যা। তার টাকা-পয়সার বিলি ব্যবস্থা নিয়ে সমস্যা । টাকা পাবে কে ? 

উনার ছেলে জহির ভাই পাবেন। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৩

বােকার মতাে কথা বলিস না বাবলু। বােকা যখন বােকার মতাে কথা বলে তখন শুনতে ভালাে লাগে, কিন্তু একজন বুদ্ধিমান ছেলে যদি বােকার মতাে কথা বলে তখন শুনতে ভালাে লাগে না। জহির উনার টাকা-পয়সা থেকে একটা পাঁচ টাকার নােটও পাবে না ।। 

কেন পাবে না ? 

আরে গাধা, জহির তাে তাদের ছেলে না। পালক পুত্র। এখন বুঝেছিস ? ‘পালক পুত্র পুত্র নহে’— এই কথা কোরান শরীফেও আছে। তাের খালার বিষয় সম্পত্তির মালিক আসলে আমরা। 

বাবা উঠে দাঁড়ালেন। প্রথম যখন আমার ঘরে ঢুকেছিলেন তখন তাঁর চেহারায় একটা ক্লান্ত ভাব ছিল। এখন সেই ক্লান্তি নেই। বাবার চোখ তাঁর জুতার মতােই চকচক করছে। 

বাবলু! জি বাবা? 

তাের বড়খালার সঙ্গে একটু ‘হাই হ্যালাে’ করে যাই। তাঁকে খুশি রাখা আমাদের কর্তব্য। মহিলার কাপড়চোপড় ঠিক আছে কি-না কে জানে! নেংটা মেংটা বসে থাকে— এক দিগদারি।। 

বাবা খালার ঘরে ঢুকলেন, আমি দোতলা থেকে একতলায় নামলাম। বড়খালার চায়ের অর্ডার দেব । নিজে চা খাব । নাশতা তৈরি হয়ে থাকলে নাশতা খাব। এই বাড়িতে দু’ধরনের নাশতা হয়। একদিন হয় পাতলা খিচুড়ি বেগুন ভাজা। আরেকদিন হয় আটার রুটি আলু ভাজা। শুধু আমার নীলা ফুপুর জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা।

নীলা ফুপু পাতলা খিচুড়ি খেতে পারেন না। তার ধারণা, পাতলা খিচুড়ি ফকির-মিসকিনদের খাবার । যারা দিনের পর দিন পাতলা খিচুড়ি খায় তারা ভবিষ্যতে ফকির-মিসকিন হয়। তিনি আটার রুটিও খেতে পারেন না। শুকনা রুটি তার নাকি গলায় আটকে যায়।

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৩

 নীলা ফুপু সকালবেলা দুধ দিয়ে এক বাটি কর্নফ্লেক্স খান, অর্ধেকটা কলা খান। বাকি অর্ধেক কলা চটকে (খােসাসুদ্ধ) তিনি একটা মিকচারের মতাে বানান। এই মিকচার চোখ বন্ধ করে চোখের ওপর দিয়ে রাখেন। তার দুই চোখের নিচেই কালাে ছােপ পড়েছে। কলার মিকচার চোখের নিচের কালাে দাগ দূর করার মহৌষধ। 

 নীলা ফুপু দেখতে খারাপ না। মায়া মায়া চেহারা। লম্বা চুল, বড় বড় চোখ। গায়ের রঙ দুধে-আলতা না হলেও ভালাে । তার একটাই সমস্যা। তিনি বেঁটে। ঢাকা শহরের সবচে’ বড় হিলের জুতা তিনি পরেন। তারপরেও তাঁকে বেঁটে লাগে। লম্বা হবার অনেক চেষ্টা তিনি করেছেন। হাইটোলিন নামের একটা পেটেন্ট ওষুধ তিনি দুই বছর খেয়েছেন।

এই ওষুধ খেলে প্রতি বছরে এক পয়েন্ট পাঁচ সেন্টিমিটার করে লম্বা হবার কথা। তিনি লম্বা হন নি, বরং শরীর ফুলে গেছে। ওষুধ খাওয়ার জন্যেই হয়তাে তার খুকি খুকি চেহারা এখন বদলে মহিলা মহিলা চেহারা হয়ে গেছে । 

 লম্বা হবার আশা নীলা ফুপু এখনাে ছাড়েন নি। তাঁর ঘরে কোনাে ফ্যান নেই। ফ্যানের জায়গায় নাইলনের দড়ি দিয়ে রিং ঝুলানাে । প্রতিদিন তিনি ঘড়ি ধরে পনেরাে মিনিট রিং-এ ঝুলেন। প্রচণ্ড গরমেও তিনি ফ্যান ছাড়া ঘুমান। কারণ ফ্যানের বাতাসে ঘুমালে নাকি শরীর ভ্যাবসা হয়ে যায় ।শরীর ভ্যাবসা হয়ে গেলে নীলা ফুপুর বিরাট সমস্যা হবে। এখন তার কাছে শরীর, চেহারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি একটা মেগাসিরিয়ালে চান্স পেয়েছেন।

সিরিয়ালের নাম কুসুম কানন। নায়িকার নাম কুসুম। নায়কের নাম কানন। দুজনের নাম দিয়ে সিরিয়ালের নাম। কাহিনী খুব ট্রাজিক। নায়িকা অ্যাকসিডেন্ট করে অন্ধ হয়ে যায়। নায়ক তার একটা চোখ দান করে নায়িকার একটা চোখ রক্ষা করে। তারপর আবার দুজনই কী করে যেন অন্ধ হয়ে যায় । শেষে একজন বিদেশী ডাক্তার অপারেশন করে দুজনকেই ঠিক করে দেন। সিরিয়ালে নীলা ফুপুর রােল খুবই ছােট।

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৩

নায়কের বাড়ির সে সহকারী (আসলে কাজের মেয়ে। কাজের মেয়ের রােলে অভিনয় করছেন বলতে নীলা ফুপুর লজ্জা লাগে বলেই তিনি সবাইকে বলেন, সহকারীর ক্যারেক্টার।) রােল ছােট হলেও অনেক কিছুই না-কি করার আছে। সিরিয়ালের পরিচালক মুকুল সাহেব নীলা ফুপুকে বলেছেন— শেষের দিকে এসে এই ক্যারেক্টারে অনেক টার্ন আছে। 

নীলা ফুপু কয়েক বছর ধরেই ইন্টারেমিডিয়েট পড়ছেন- কমার্স। প্রথমবার পাশ করতে পারেন নি। পরের বার সিরিয়ালের কারণে পরীক্ষা দিতে পারেন নি। এবারাে মনে হয় দিতে পারবেন না। তবে পড়াশােনা নিয়ে তাঁর কোনাে মাথাব্যথা নেই। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, কী পড় ? তিনি হাসিমুখে বলেন, ইন্টার পড়ি। আমার ধারণা, ফুপু যতদিন বাঁচবেন, ইন্টার পড়ি বলেই কাটিয়ে দিবেন। 

আমি রান্নাঘরে ঢুকে বড়খালাকে চা পাঠাতে বললাম। খাবার টেবিলে নীলা ফুপুর পাশে এসে বসলাম। টেবিলের মাঝখানে বল ভর্তি পাতলা পানি পানি খিচুড়ি। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বলে দুধের মতাে সর পড়েছে। আমি খিচুড়ি নিতে যাচ্ছি, নীলা ফুপু বললেন, খিচুড়ি নিস না। আজকের খিচুড়িতে প্রবলেম আছে। 

কী প্রবলেম ? খিচুড়িতে একটা তেলাপােকা পাওয়া গেছে। 

আমি হাত গুটিয়ে বসলাম । খিচুড়িতে তেলাপােকা পাওয়া আমাদের বাসার একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এটা নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায় না। হাঁড়ির যে অংশে তেলাপােকা পাওয়া গেছে, মা সেখান থেকে তেলাপােকা সুদ্ধ এক খাবলা খিচুড়ি শুধু ফেলে দেবেন। তারপর সূরা এখলাস পড়ে ফু দিবেন । সূরা এখলাস 

পড়ে ফু দিলে খাবার শুদ্ধ হয়ে যায়।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-৪

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *