হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-৬

আজিজুর রহমান খােকন সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। জহির ভাই আমার দিকে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বললেন,

বাবলু উনার কাছ থেকে দুইটা মুরগি রেখে দে।খােকন সাহেব বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। জহির ভাই হাই তুলতে তুলতে বললেন, দুটা দিতে না চাইলে একটা দেন। সাদা গলার মুরগিটা দেন।

জোকারি কথাবার্তা বললেও জহির ভাই কিন্তু জোকার না। সিরিয়াস টাইপ মানুষ । খােকন সাহেবের কাছে সে যে মুরগি চেয়েছে জোকারি করে চায় নি, সত্যি সত্যি চেয়েছে।

লিলুয়া বাতাস 

জহির ভাইয়ের দুই হাজার টাকা সন্ধ্যার মধ্যে দরকার । অবশ্যই জরুরি কোনাে কাজে দরকার। জরুরি কাজটা কী কে জানে ? পনেরশ টাকার জন্যে আমি কার কার কাছে যাব তার লিস্ট করে ফেললাম। প্রথমে নীলা ফুপু, তারপর বড়খালা, তারপর মা, সবশেষে ভাইয়া। 

নীলা ফুপু আমাকে দেখে প্রায় ছুটে এলেন। চোখ-মুখ শুকনা করে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি ? একটা চিঠি মগবাজারে দিয়ে আসতে একঘণ্টা ছাব্বিশ মিনিট লাগে ? মুকুল ভাইকে পেয়েছিলি? চিঠি তার হাতে দিয়েছিস ? চিঠি পড়েছেন ? তাের সামনেই পড়ছেন ? 

সব কথাতেই হুঁহুঁ করছিস কেন? কথা বলা ভুলে গেছিস? চিঠি পড়ার পর মুকুল ভাই কিছু বলেছেন ? 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৬

আমাকে বললেন, এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিতে পারবে ? শুধু এইটুকু বলেছেন। আর কিছু বলেন নি ? সিগারেট কিনে দিয়ে এসেছিস তাে? 

উফ, লােকটা এত সিগারেট খায়! সারা শরীরে সিগারেটের গন্ধ । 

আমি কিছুক্ষণ নীলা ফুপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমাকে পনেরশ’ টাকা ধার দিতে পারবে ? 

কী করবি ? আমি একজনকে দেব । আমার কাছে চেয়েছে। সেই একজনটা কে ? জহির ভাই। আমার কাছে টাকা নেই। 

টাকা নেই, তাহলে এত কথা জিজ্ঞেস করলে কেন ? টাকা দিয়ে কী করবি ? কাকে ধার দিবি ? 

জানার জন্যে জিজ্ঞেস করেছি। যা এখন ভাগ। সেদিনের ছেলে, চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শিখেছে! 

আমি নীলা ফুপুর সামনে থেকে বের হলাম। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সিক্সথ সেন্স আমাকে বলছে টাকা পাওয়া যাবে না। যার কাছে যাব সে-ই বলবে । মাঝে মাঝে আমার সিক্সথ সেন্স খুব কাজ করে। 

বাবলু, একটু শুনে যা তাে। 

আমি তাকিয়ে দেখি ভাইয়া তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে। ঘরের দরজা খােলা। খুবই অস্বাভাবিক দৃশ্য, ভাইয়ার ঘরের দরজা কখনাে খােলা থাকে না। 

একতলার সবচে’ শেষের ঘরটা ভাইয়ার। ঘরটা ছােট। ঘরের একটাই জানালা, সেই জানালাটাও ছােট। জানালা ঘেঁসে বিশাল একটা পেয়ারা গাছ উঠেছে। গাছে এখন পর্যন্ত কোনাে পেয়ারা হয় নি। এই গাছটা নাকি পুরুষ। পুরুষ পেয়ারা গাছের কারণে ভাইয়ার ঘরের জানালা দিয়ে কোনাে আলাে ঢুকে

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৬

এটাই ভাইয়ার পছন্দ। তাঁর ঘর অন্ধকার থাকতে হবে। তার ঘরে কেউ ঢুকতে পারবে না । ঘর ঝাট দেয়ার জন্যেও না। ভাইয়া তাঁর নিজের ঘর নিজে গােছায় । যে-কেউ ভাইয়াকে দেখলেই বুঝবে সে একজন অস্বাভাবিক মানুষ। 

অস্বাভাবিক তাে বটেই। এসএসসি পরীক্ষায় ভাইয়া ঢাকা বাের্ডের সব ছেলেমেয়ের মধ্যে থার্ড হয়েছিল। ইন্টারমিডিয়েটে হয়েছে ফোর্থ । ফিজিক্স অনার্স পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড। এমএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এখনাে রেজাল্ট হয় নি। উড়া উড়া শুনতে পাচ্ছি, রেজাল্ট হবার আগেই ভাইয়া পিএইচডি করতে আমেরিকা যাবে। এই বিষয়ে ভাইয়ার কাছ থেকে কিছু শুনি নি। ভাইয়া তাঁর নিজের বিষয়ে কখনাে কাউকে কিছু বলে না। 

বাবলু বােস, খাটের ওপর বােস। 

আমি বসলাম। ভাইয়া আমার সামনে চেয়ারে বসল। 

লজেন্স খাবি ? হরলিক্সের কৌটায় লজেন্স আছে। নিয়ে খা । আমাকেও একটা দে। 

আমি লজেন্স নিলাম। ভাইয়াকে একটা দিলাম। 

রাত জেগে পড়ি তাে, তখন ব্রেইন প্রচুর সুগার খরচ করে। শরীরে সুগারের ঘাটতি পড়ে। তখন লজেন্স খাই । 

আমি লজেন্স চুষছি। ইচ্ছা করছে লজেন্সটা দাঁত দিয়ে ভেঙে গুঁড়া করে ফেলতে। কড়মড় শব্দ হবে । ভাইয়া হয়তাে বা বিরক্ত হবে, এই ভয়ে পারছি বাবলু। 

হুঁ। 

শরীরের রক্তের তিন ভাগের এক ভাগ যে ব্রেইন নিয়ে নেয়, এটা জানিস ? ব্রেইনেরই অক্সিজেন সবচে’ বেশি দরকার । 

আমার কাছে একটা বই আছে, নাম বােকাওয়ার্স ব্রেইন। পড়ে দেখতে পারিস। মজা পাবি। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৬

ইংরেজি পড়তে পারি না ভাইয়া। 

ইংরেজি পড়তে না পারার কী আছে? একটা ডিকশনারি নিয়ে বসবি। অজানা শব্দগুলির মানে ডিকশনারিতে দেখে নিবি। ভােকাবলারি বাড়বে । 

আচ্ছা। এখন তাের খবর কী বল ? 

আমি হুট করে বলে ফেললাম, আমাকে পনেরশ টাকা দিতে পারবে ভাইয়া ।। 

কত ? পনেরশ’। তােষকের নিচে আমার মানিব্যাগ আছে। মানিব্যাগ থেকে নিয়ে নে । 

আমি মানিব্যাগ থেকে টাকা নিলাম । হরলিক্সের কৌটা থেকে আরেকটা লজেন্স নিলাম। এই লজেন্স কড়মড় করে ভেঙে খাব । ভাইয়া বিরক্ত হলে হবে। 

বাবলু, তােকে একটা কথা বলার জন্যে ডেকেছি। তাের সঙ্গে তাে বাবার খুব খাতির। বাবা যে আরেকটা বিয়ে করেছে এটা জানিস ? বাবা তােকে কিছু বলেছে ? 

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, না! 

বিয়ে করেছে চার বছর আগে। ঐপক্ষে তার একটা মেয়েও আছে। মেয়ের নাম যূথী। 

আমি কড়মড় করে লজেন্স ভাঙলাম। ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলাে না লজেন্স ভাঙার শব্দ তাঁর কানে গেছে । 

ঘটনাটা আমি জানি আর মা জানে। বাবা আর ঐ মেয়ে একটা ওয়ান বেডরুম অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। তােকে ঠিকানা দিচ্ছি, তুই ভেরিফাই করে আসবি। 

এখন যাব ? 

এখন না। একটু রাত করে যা। ভাইয়ার ঘর থেকে বের হয়ে দেখি মা বারান্দায় মােড়ার ওপর বসেছেন। মাথাটা উঠানের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন। নতুন একটা কাজের মেয়ে মার মাথায় পানি ঢালছে। এটা নতুন কোনাে দৃশ্য না।

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৬

প্রায়ই মা’র মাথা গরম হয়ে যায়, তখন তার মাথায় পানি ঢালতে হয়। কাজের মেয়েটিকে দেখে মনে হলাে, পানি ঢালার কাজটায় সে খুব আনন্দ পাচ্ছে। একহাতে জগে করে পানি ঢালছে অন্যহাতে। মাথায় থাবড়া দিচ্ছে । থাবড়া দেয়ার সময় তার মুখ হাসি হাসি হয়ে যাচ্ছে । 

 মা আমাকে দেখেছেন। তিনি হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। বাবা বিষয়ে কোনাে কথা বলবেন কি-না বুঝতে পারছি না। কাজের মেয়ের সামনে বলার কথা না— তবে উচিত অনুচিত নিয়ে মাথা ঘামানাের মানুষ তিনি না। আমি কাছে গেলাম।

মা ভাঙা গলায় (মা’র গলা কখনাে ভাঙে না, তবে যে-কোনাে সময়ে তিনি দুঃখের কথা ভাঙা গলায় বলতে পারেন। আমার সঙ্গে ভাঙা গলায় কথা বলে তার পরপরই অন্য একজনের সঙ্গে স্বাভাবিক গলায় কথা বলবেন। এটা তার কাছে কোনাে ব্যাপারই না ।) বললেন, খােকনের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছিস ? 

আমার স্যান্ডেলটা সাথে করে নিয়ে যা। যদি দেখিস ঘটনা সত্যি, আমাণ স্যান্ডেলটা দিয়ে তাের বাপকে দশটা বাড়ি দিবি । পারবি না? অবশ্যই আমার স্যান্ডেল নিয়ে যাবি। স্যান্ডেল না নিয়ে গেলে তুই আমার কু পুত্র। তােকে আমি পেটে ধরি নাই। অন্য কোনাে মাগি তােকে পেটে ধরেছে।… 

মা হড়বড় করে কথা বলেই যাচ্ছেন। তার ভাঙা গলা ঠিক হয়ে গেছে। কাজের মেয়েটা মার কথা শুনেও মজা পাচ্ছে। সে মুখ আড়াল করে হাসার চেষ্টা করছে। তার হাসির শব্দ মা’র কানে গেলে বিপদ আছে। মা কাজের মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে খুব পছন্দ করেন। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৬

জহির ভাইকে দুই হাজার টাকা দিয়েছি। তিনি টাকা হাতে নেন নি। বিরক্ত মুখে বলেছেন, ম্যাগাজিনটার নিচে রেখে দে। টাকা দিয়েছে কে ? 

ভাইয়া। 

সাতদিনের মধ্যেই টাকা ফেরত দিব । তখন মনে করে যার টাকা তাকে দিয়ে দিবি । 

আচ্ছা। 

জহির ভাই বসে আছেন আমার ঘরে। আমার ঘর বলা ঠিক হচ্ছে না, আমাদের ঘর বলা উচিত। জহির ভাই আমার সঙ্গে থাকেন। এই ঘরে দুটো সিঙ্গেল খাট পাতা। তবে এখানে তিনি থাকেন না বললেই হয়। তার স্থায়ী ঠিকানা এখন ‘দি ইমেজ। 

বাবলু ! 

কী জহির ভাই। 

এই দুই হাজার নিয়ে আমার কাছে এখন টোটাল ক্যাশ টাকা কত আছে জানিস ? 

আন্দাজ কর । পাঁচ হাজার ? পঁয়তাল্লিশ হাজার। এত টাকা ? 

পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা বাংলাদেশে এখন কোনাে টাকাই না। সদরঘাটে ভিক্ষা করে যে ফকির তার কোচড়েও এই টাকা থাকে। একটা জার্মান লুগার পিস্তলের দাম সত্ত্বর হাজারের ওপরে। চাইনিজ পিস্তলের দাম ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-৭

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *