হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-৭

তুমি কি পিস্তল কিনবে? 

জহির ভাই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরালেন। এখন তার চোখে মুখে বিরক্তি নেই। তাঁকে আনন্দিতই মনে হচ্ছে।লিলুয়া বাতাস

বাবলু ! জি জহির ভাই। তাের এখানে রাতে ঘুমাই না কেন বল তাে? জানি না। অনুমান কর । ঘরটা ছােট, সিলিং ফ্যানে শব্দ হয়। শব্দে তুমি ঘুমাতে পার না।। 

হয় নি। তাের ওপরে আমার আছর’ হােক, এটা চাই না বলেই তাের সঙ্গে ঘুমাই না। ঘুমের সময় আত্মা ফ্রি হয়ে যায়। একজনের আত্মার সঙ্গে আরেকজনের মিলমিশ বেশি হয়। আছরও বেশি পড়ে। তুই যদি সাতদিন কোনাে ক্রিমিন্যালের সঙ্গে ঘুমাস, অষ্টম দিনে তুই নিজেও ক্রিমিন্যাল হয়ে যাবি। 

তুমি কি ক্রিমিন্যাল ? এখনাে জানি না। পিস্তল হাতে আসুক, তারপর বুঝব । মানুষ মারবে ? 

কাকে মারবে? 

জহির ভাই হাই তুলতে তুলতে বললেন, প্রথম ধরা খাবে দি ইমেজের মালিক— আমার প্রাণপ্রিয় দোস্ত, ফারুক ভাইজান। 

উনি কী করেছেন ? 

উনি কী করেছেন তাের জানার দরকার নাই। এই জগতের নিয়ম যত কম জানবি তত সুখে থাকবি। পিঁপড়া সবচে’ কম জানে বলে সে মহাসুখে আছে। খাচ্ছে-দাচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিঁপড়ার চেয়ে একটু বেশি জানে উইপােকা। উইপােকাকে কী করতে হয় ? আগুন দেখলেই তাকে উড়ে আগুনের কাছে যেতে হয় । উইপােকা যদি কম জানতাে তাহলে তাকে আগুনে পুড়ে মরতে হতাে না। বুঝতে পারছিস ? 

পারছি । পনের মিনিট ঘুমাব, বুঝতে পারছিস ? পারছি। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৭

ঘড়ি হাতে নিয়ে বসে থাক। ঠিক পনের মিনিট পরে আমাকে ডেকে তুলবি। তাের ঘড়ি আছে না ? 

ঠিক আছে তােকে একটা দামি ঘড়ি দেব। আপাতত আমার ঘড়ি হাতে বসে থাক । ঠিক পনের মিনিট পরে ডাকবি । পনের মিনিটের জায়গায় যদি ষােল মিনিট হয়, কনুইয়ের গুতা খাবি। জায়গা মতাে কনুইয়ের গুতা দিলে যে মানুষ মরে যায়, এটা জানিস ? 

না। 

মানুষের শরীরে কয়েকটা দুর্বল জায়গা আছে, সেখানে গুতা লাগলে শেষ।। কলমা পড়ার সুযােগও পাবে না।। 

জহির ভাই তাঁর হাতঘড়ি খুলে আমার হাতে দিলেন । বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন, আমি কাউন্টিং শুরু করতে বললেই কাউন্টিং শুরু করবি । 

আচ্ছা। মা না-কি আজকাল ভূত-প্রেত দেখা শুরু করেছে, এটা সত্যি ? 

মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ভালাে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করানাে দরকার । 

সত্যিও তাে হতে পারে। 

হতে পারে। There are many things in heaven and earth… কার কথা বল দেখি ? 

শেক্সপিয়ারের। 

জানলি কী ভাবে ? তুমি আগে একবার বলেছিলে— ভেরি গুড। হ্যামলেটে আছে। Ok, start counting. 

জহির ভাই পাশ ফিরলেন। আমি তাকিয়ে আছি ঘড়ির দিকে। জহির ভাই বিষয়ে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি— জহির ভাইও খুব ভালাে ছাত্র। ভাইয়ার মতাে না হলেও বেশ ভালাে। এসএসসি, ইন্টারমিডিয়েট দুটোতেই স্টার পাওয়া । ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হলেন।

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৭

ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠার সময় তার সত্ত্বাবা (আমার বড়খালু) রােড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেলেন। তখন খালা বললেন, জহিরের পড়ার খরচ আমি দিব কেন? ও তাে ফকিরের পুলা। আমার ছেলে তাে না । ফকিরের পুলার পিহনে আমি কেন পয়সা নষ্ট করব ? আমার স্বামী নাই, প্রতিটা পাই পয়সা আমাকে হিসাব করে খরচ করতে হয়। ফকিরের পুলার পিছনে আমি আর একটা পয়সা খরচ করব না। 

জহির ভাই তখন খালাকে বললেন, আমি তাহলে কী করব? 

খালা বললেন, তুই তাের বাপ মারে খুঁজে বের কর। পরের ঘাড়ে আর কতদিন বসে থাকবি ? 

আলােচনার এই পর্যায়ে বাবা বললেন, বড়আপা, আপনারা একসময় আগ্রহ করে এই ছেলেকে পালক এনেছেন। এখন হঠাৎ করে… 

বড়খালা বললেন, তােমার যদি এত দরদ থাকে তুমি পাল। তুমি তার পড়ার খরচ দাও ।বাবা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, কষ্ট টষ্ট করে খরচ আমিই দিব । অনার্সটা পাশ করে ফেললে চাকরির চেষ্টা করা যাবে। বড় বড় লােকজন আমার পরিচিত। আব্দুল গনি নামে একজন আছে, পুরান ঢাকায় রিয়েল স্টেট করে কোটিপতি হয়েছে।

তার সঙ্গে একসময় একখাটে ঘুমাতাম। তাকে গিয়ে যদি বলি— গনি! ছেলেটার একটা ব্যবস্থা করে দাও। সে আমার কথা ফেলতে পারবে না। তার অসংখ্য ফার্ম। কোনাে একটার ম্যানেজার বানায়ে দিবে। পােস্ট থাকলে পােস্ট ক্রিয়েট করবে। এইটুকু আমার জন্যে তাকে করতেই হবে।। 

আমাকে ডাকতে হলাে না। পনের মিনিট পার হবার আগেই জহির ভাই। উঠে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কতক্ষণ ঘুমিয়েছি ? 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৭

আমি বললাম, এগারাে মিনিটেরও কম। 

এতেই চলবে, শরীর ফ্রেশ লাগছে । এগারাে মিনিটের মধ্যে ইন্টারেস্টিং স্বপ্ন দেখেছি। ইন্টারেস্টিং এবং ভয়াবহ। 

কী স্বপ্ন ? 

আমি একটা ঠেলাগাড়িতে বসে আছি। দু’জন মহিলা ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সামনের জনের মুখ দেখতে পাচ্ছি না। পেছনের জনের মুখ দেখতে পাচ্ছি। তাও ভালােমতাে না। কারণ আমি যতবার মহিলার দিকে তাকাই, উনি মুখ ঘুরিয়ে নেন। এই হলাে স্বপ্ন। 

আমি বললাম, ইন্টারেস্টিং স্বপ্ন ঠিকই আছে। ভয়াবহ তাে না। 

অবশ্যই ভয়াবহ। দু’জন মহিলার কারাের গায়েই কাপড় নেই। একগাছা সুতাও নেই। আমার গায়েও কাপড় নেই। অথচ রাস্তার সবার পরনে কাপড়। সবাই আমাদের দেখে মজা পাচ্ছে– হাসছে। এখন বল, স্বপ্নটা ভয়াবহ না ? 

জহির ভাই উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। আমার শার্টের পকেটে ঠিকানা লেখা কাগজ আছে। সেই ঠিকানায় যেতে হবে । বিকাল ছটা বাজে। সূর্য ডুববে ছয়টা পঁয়তাল্লিশে। সেই সময় ঘর থেকে বের হতে নেই। ঘর ছেড়ে বের হতে হলে আগেই বের হতে হবে । 

দরজার পাশে কলিংবেল আছে। কলিংবেলের নিচে স্কচ টেপ দিয়ে সাঁটা নােটিশ | হাত দিলে শক খাইবেন বেল নষ্ট। আমি দরজার কড়া নাড়লাম। ঢাকা শহর থেকে কড়া বসানাে দরজা উঠে গেছে বলেই জানতাম— এখানে আছে। চিপা ধরনের লিফট ছাড়া ফ্ল্যাট বাড়ি। গরিবদের জন্যে আজকাল এক বেডরুমের কিছু ফ্ল্যাট বানানাে হচ্ছে। এটাও নিশ্চয়ই এরকম কিছু। সিঁড়িতে রেলিং বসানাে শেষ হয় নি, এর মধ্যেই লােকজন উঠে গেছে। 

 ফ্ল্যাট নাম্বার আটের খ। দরজায় প্লাস্টিকের অক্ষরে বাড়িওয়ালা কিংবা ভাড়াটের নামআবুল কালাম মিয়া। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৭

অ্যাডভােকেট, সুপ্রিম কোর্ট সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভােকেটদের এমন দৈন্যদশা জানতাম না। আমি খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেছি। ভাইয়া এই ঠিকানা কাগজে লিখে দিয়েছে। এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে— ঠিকানাটা ভুল। দরজার কড়া নাড়লেই অ্যাডভােকেট সাহেব বের হবেন এবং থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করবেন, কী চাই ? 

ভুল ঠিকানা নিয়ে এসেছি বললেও যে অ্যাডভােকেট সাহেবের কাছ থেকে পার পাওয়া যাবে তা মনে হয় না। তিনি অবশ্যই নানান প্রশ্ন করবেন— ভুল ঠিকানাটা কে দিয়েছে? তার নাম, তার পরিচয় ? তােমার নাম ? তােমার পরিচয় ? ঠিকানা কী ? আমি কড়া নাড়লাম।

কলিংবেল টিপতে হয় একবার, কড়া নাড়তে হয় থেমে থেমে তিনবার। আমাকে তিনবার নাড়তে হলাে না। দ্বিতীয় বারেই দরজা খুলে গেল। দরজার ওপাশে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরনে হলুদ লুঙ্গি। গায়ে স্যান্ডাে গেঞ্জি। মুখ হাসি হাসি। যেন তিনি আমার জন্যেই অপেক্ষা করছেন। 

আরে বাবলু তুই ? আয়, ভেতরে আয়। 

বাবা ভেতরের দিকে মুখ করে আনন্দিত গলায় বললেন, এই দেখ বে এসেছে। 

বসার ঘরের মেঝেতে তিন সাড়ে তিন বছরের একটা মেয়ে বসে আছে। তার চারদিকে সস্তার খেলনা ছড়ানাে। সামনে একটা টেবিল ফ্যান। মেয়েটির স্বভাব মনে হয় প্রতিধ্বনির মতাে যা শুনছে তাই নিজের মতাে করে বলা। সে খেলনা থেকে চোখ না সরিয়ে রিনরিনে গলায় বলল, এই দেখ কে এসেছে। 

বাবা আমার হাত ধরে ঘরের ভেতর টানতে টানতে বললেন, বাবলু এসেছে। বাবলু। 

ছােট মেয়েটা বলল, বাবলু এসেছে, বাবলু বাবা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন, বাবলু কী রে? নাম ধরে ডাকা বেয়াদব মেয়ে। তাের ভাই হয়। ভাইয়া ডাকবি। 

মেয়েটা বিড়বিড় করে বলল, ভাইয়া। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৭

রান্নাঘর থেকে অল্পবয়স্ক, আঠারাে-উনিশ কিংবা তারচেয়ে কমও হতে পারে, একজন মহিলা উঁকি দিলেন। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতাে চমকে উঠলেন। 

 বাবা বললেন, হা করে তাকিয়ে আছ কেন? এই হলাে বাবলু, My son. দেখেছ কী সুন্দর চেহারা! 

মহিলা কী বলবেন ভেবে পেলেন না। শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিলেন। বাবা বললেন, তুই যে একদিন না একদিন আসবি আমি জানতাম। তুই আরাম করে বস তাে। যূথী মা, ভাইয়ার দিকে ফ্যানটা দিয়ে দাও। | যূথী ফ্যান আমার দিকে ঘুরিয়ে দিল, আর তখনি মঞ্চে যার আবির্ভাব হলাে তাকে আমি চিনি– আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে জিতুর মা। গােশতের শুটকির টিন নিয়ে সে এই বাসায় উঠেছে, এখন বুঝতে পারছি। জিতুর মা আহ্লাদী গলায় বলল, ও আল্লা, ভাইজান! কেমন আছেন ? বাসার সবেই ভালাে ? আম্মাজানের আধ কপালী মাথাব্যথা এখনাে হয় ? 

বাবা বললেন, জিতুর মা, ফালতু বাত বন্ধ কর। বাবলু রাতে খাবে, এই ব্যবস্থা দেখ । টাকা নিয়ে যাও, হাফ কেজি খাসির মাংস নিয়ে আস। আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই যাচ্ছি তােমার যেতে হবে না। মাংস চিন না কিছু না। ভেড়ার মাংস নিয়ে আসবে, বােটকা গন্ধের জন্যে মুখে দেয়া যাবে না। বাবলু, তুই দশ মিনিট বসে থাকতে পারবি না ? 

পারব। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৭

যূথীর সঙ্গে বসে গল্প কর। আমি রিকশা নিয়ে যাব, রিকশা নিয়ে ফিরব। দশ মিনিটও লাগবে না। তুই বসে বসে চা খা । তাের চা শেষ হবার আগেই আমি চলে আসব। 

আমিও যাই তােমার সঙ্গে ? কোনাে দরকার নেই, তুই যূথীর সঙ্গে গল্প কর । 

আমি এবং যূথী বসে আছি। মেয়েটার চেহারা যে এত মায়াকাড়া আগে বুঝতে পারি নি। গােলগাল রােগা মুখে বড় বড় চোখ। চোখের মণি ঝলমল করছে । গায়ের রঙ একটু ময়লা। তাকে এই রঙটাই মানিয়েছে। এই মেয়েটা ফর্সা হলেও মানাতাে না। কালাে হলেও মানাতাে না। তার মাথার চুল বেণি করা। দু’দিকে দুটা বেণি ছিল। একটা খুলে গেছে, এতেই মেয়েটাকে ভালাে লাগছে । দুই বেণিতে একে মানাতাে না। আমি বললাম, যূথী, তুমি কেমন আছ ? 

যূথী বলল, ভালাে না। আমার জ্বর। কপালে হাত দিয়ে দেখ। সে মাথা আমার দিকে এগিয়ে দিল । নিতান্ত অপরিচিত একজনের সঙ্গে কী সহজ স্বাভাবিক আচরণ! আমি কপালে হাত দিলাম। যূথী ভুল বলে নি। তার সত্যিই জ্বর। একশ’র ওপর তাে হবেই। এই জ্বর নিয়ে মেয়েটা নিজের মনে খেলছে। নিশ্চয়ই খুব লক্ষ্মী মেয়ে ।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-৮ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *