হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-৯

বাবলু! জি ভাইয়া। 

জহিরের ব্যাপারটা মাথা থেকে দূরে রাখবি। তাের স্বভাব হচ্ছে, তুই যার কাছেই যাস তার ছায়া হয়ে যাস। এটা ঠিক না। সবাইকে আলাদা আইডেনটিটি নিয়ে বড় হতে হবে । তুই ছায়া মানব না। You are not a shadow man. লিলুয়া বাতাস

যা ঘুমুতে যা। 

আমি ঘুমুতে গেলাম। পাশের ঘরে বড়খালা জেগে আছেন। কোনাে হিন্দি মুভি দেখছেন। মারপিটের দৃশ্য হচ্ছে। ঢিসুম ঢিসুম শব্দ হচ্ছে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থাকার পরেও হিন্দি মুভিতে প্রথম বেশ কিছুক্ষণ কিলঘুসির দৃশ্য থাকে। ঘুসি খেয়ে কেউ না কেউ তরকারিভর্তি ভ্যানগাড়িতে পড়ে। ভ্যান ভেঙে সে তরকারি সুদ্ধ নিচে পড়ে। মারামারির সঙ্গে তরিতরকারির সম্পর্ক আমি এখনাে ধরতে পারি নি। 

 শােবার আগে বড়খালা ‘দি ইমেজ’-এর ঘটনা কীভাবে নিচ্ছেন জানার জন্যে তার ঘরে ঢুকলাম। বড়খালা টিভি থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বললেন, সবুজ শাড়ি পরা যে মেয়েটা দেখছিস সে-ই আসল খুনি। তবে সে নিজেও জানে না সে খুনি। 

আমি বললাম, তাই নাকি? মেয়েটা খুন করে ঘােরের মধ্যে। আমি বললাম, জহির ভাই যে খুন হয়েছে শুনেছ

বড়খালা বললেন, দুটা মিনিট পরে কথা বল তাে! ছবি এখনই শেষ হয়ে যাবে । তুইও দেখ। শেষটা এরা ইন্টারেস্টিং বানিয়েছে। 

আমি চোখ বড় বড় করে সবুজ শাড়িওয়ালির অভিনয় দেখে শেষ করলাম। বড়খালা হাই তুলতে তুলতে বললেন, বাবলু, তুই একজন এসির মিস্ত্রি নিয়ে আসিস। এসিতে কোনাে গণ্ডগােল আছে, ঘর আগের মতাে ঠাণ্ডা হচ্ছে না। মনে হয় গ্যাস চলে গেছে। 

আচ্ছা নিয়ে আসব ।

তুই কি আম চিনিস? খিরসাপাতি আম কিনে আনতে পারবি ? এক কেজি খিরসাপাতি আম আনিস তাে। আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাস। আম কিনে আমার হাতে দিবি। 

তােমার আঙুলে কী হয়েছে ? 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৯

খালা বিরক্তচোখে নিজের বাঁ হাতের আঙুল মেলে ধরলেন। দুটা আঙুল ব্যান্ডেজ করা। গজ-তুলা দিয়ে ব্যান্ডেজ। একটা আঙুল থেকে রক্ত চুইয়ে ব্যান্ডেজের বাইরে চলে এসেছে। আঘাত নিশ্চয়ই গুরুতর। 

আঙুলে ব্যথা পেয়েছ কীভাবে ? ব্যথা পাই নি। কামড় দিয়েছে। কে কামড় দিয়েছে ? 

একটা দুষ্টু ভূতের বাচ্চা আমার খাটের নিচে থাকে, বলেছি না! সেটাকে ঝাড় দিয়ে মারতে গেছি, ফট করে সে আঙুল কামড়ে ধরেছে। এমন বদ! 

ভূতের বাচ্চাটাকে বিদায় করতে পেরেছ, না-কি এখনাে সে খাটের নিচে ঘাপটি মেরে বসে আছে ? 

আমি জানি না। তুই উঁকি দিয়ে দেখ । তবে আমি ঠিক করেছি, ঐটাকে আর ঘটাব না। সে তার মতাে থাকুক। বুড়া বয়সে আর কামড় খাব না। কামড় দিয়ে যখন রক্তারক্তি করে ফেলল তখন থােকন ডাক্তার নিয়ে এলাে। চেংড়া ডাক্তার। পড়াশােনা করে পাস করেছে, না নকল করে পাস করেছে কে জানে! ডাক্তার বলল, কিসে কামড় দিয়েছে ? আমি বললাম, ভূতে কামড় দিয়েছে । ডাক্তার এমনভাবে তাকাল যেন আমার মাথা খারাপ। তাের কি ধারণা আমার মাথা খারাপ ? 

আমি বললাম, না। 

ভূতগুলা এত জায়গা থাকতে আমার খাটের নিচে বসে থাকে কেন বল দেখি ? | তুমি দিনরাত এসি চালিয়ে রাখ। ঘর থাকে ঠাণ্ডা। ভূতরা মনে হয় ঠাণ্ডা পছন্দ করে। 

হতে পারে। তাের বুদ্ধি খারাপ না। আমি এই লাইনে চিন্তাই করি নি । আরেকটা ছবি চালা তাে। টেবিলের উপরে আছে। উপর থেকে তিন নম্বর সিডিটা দে ‘ম্যায় হু না’। শাহরুখ খানের ছবি। নায়িকা সুস্মিতা সেন। চিনিস সুস্মিতাকে ? 

মিস ইন্ডিয়া হয়েছিল। পরে মিস ইউনিভার্স হয়েছে । ফিগার খুব সুন্দর। তবে তাকে নিয়ে নানান গুজব আছে । আয় আমার সঙ্গে ছবি দেখ। 

ঘুম পাচ্ছে খালা। ঘুমাব । 

যা ঘুমা। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৯

মন বিক্ষিপ্ত থাকলে ঘুম ভালাে হয় না, এমন কথা প্রচলিত আছে। আমার বেলায় কথাটা একেবারেই খাটে না । আমার ঘুম তখন অনেক ভালাে হয়। এক ঘুমে রাত পার করে দিলাম। ছােট ছােট কয়েকটা স্বপ্ন দেখলাম। এর মধ্যে একটা স্বপ্নে জহির ভাই স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। বড়খালা সেই স্ট্রেচার ঠেলছেন। জহির ভাই বলছেন, আস্তে ঠেল মা । আস্তে। আমার শরীরে বিরাট জখম।

জহির ভাই যে কথাগুলি বলছেন সেই কথাগুলি আবার একজন নার্স রিপিট করছে। জহির ভাই বললেন, আমার শরীরে বিরাট জখম। নার্স বলল, আমার শরীরে বিরাট জখম। জহির ভাই বললেন, মা, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ ? নার্স বলল, মা, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ ? এই কথায় বড়খালা রেগে গিয়ে বললেন, তুমি আমাকে মা ডাকছ কেন ? তুমি কে ?

খালার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে নার্সটা একটা ছােট্ট বাচ্চা মেয়ে হয়ে গেল । স্বপ্নে এই বিষয়টা মমাটেই অবাস্তব মনে হলাে না। মনে হলাে এটাই স্বাভাবিক। বাচ্চা মেয়েটা বলল, আমার নাম যূথী। আমার জ্বর। কপালে হাত দিয়ে দেখ। এই বলে সে বড়খালার দিকে মাথা এগিয়ে দিল । স্বপ্ন এখানেই শেষ। 

দ্বিতীয় আলাে পত্রিকায় ‘দি ইমেজ’ হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রথম পৃষ্ঠায় লিড নিউজ হয়েছে। সংবাদের শিরােনাম— রাজধানীর কেন্দ্রে আবারাে নৃশংস খুন। একজন নিজস্ব সংবাদদাতা ঘটনার এমন নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন যা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন । হত্যাকারীর সঙ্গে হত্যার মােটিভ নিয়ে কথাবার্তাও হয়েছে।

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৯

 প্রতিবেদকের বক্তব্য থেকে জানা গেল, জহির ভাই বেঁচে আছেন। তাঁর ডান পা এবং ডান হাতে গুলি লেগেছে, তবে ডাক্তাররা তাকে শঙ্কামুক্ত ঘােষণা করেছেন। এবং কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হবে। পুলিশের ধারণা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে দি ইমেজের ম্যানেজার মােহম্মদ নাসিম। হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন আগেই দি ইমেজের মালিকের সঙ্গে তার বচসা হয় এবং চাকরি চলে যায়। মােহম্মদ নাসিম বর্তমানে পলাতক আছে। পুলিশ তার সন্ধানে আছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই সব রহস্যের সমাধান হবে। 

আওয়ামী লীগ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দি ইমেজের মালিক ফারুক এবং তার বন্ধু জহির দুজনই আওয়ামী যুবলীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। ক্ষমতাসীন সরকার ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী কর্মীদের হত্যা করে যাচ্ছে। ক্ষমতার লােভে অন্ধ হয়ে যাওয়া এই খুনি সরকারের পতনের জন্যে মুক্তিযুদ্ধের সকল স্বপক্ষ শক্তিকে এক হতে আহ্বান জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় কর্মীদের ওপর এই বর্বর আক্রমণের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ আগামী বৃহস্পতিবার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে। 

এদিকে বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, এই দুজনই জিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত যুবদলের কর্মী। একজন (মােহম্মদ ফারুক) যুবদল নগর কমিটির ক্রীড়া পরিষদের সদস্য। বিরােধী দল দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির জন্য পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। তাদের সমুচিত জবাব দেয়া দেশপ্রেমিক জনতার কর্তব্য। বিএনপি উন্নয়নের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাসী না। 

জহির ভাই আওয়ামী লীগের লােক না-কি বিএনপি’র লােক আমি জানি না। একটা জিনিস জানি, তাঁকে দেখতে যাওয়া দরকার। ভাইয়ার নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করেই যেতে হবে। কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে উপস্থিত হতে হবে। তিনি কোথায় আছেন এই তথ্য এখন জানি। পত্রিকায় লিখেছে। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৯

জহির ভাই খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আমাকে দেখে একপলক তাকিয়ে। আবার কাগজ পড়ায় মন দিলেন। তার ডান হাতে ব্যান্ডেজ। একহাতে পত্রিকা ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। ফ্যানের বাতাসে পত্রিকা এলােমেলাে হচ্ছে । সামলানাে যাচ্ছে না। জহির ভাইকে রাখা হয়েছে কেবিনে। কেবিনের দরজার সামনে একজন বন্দুকধারী পুলিশ। সে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করছে না। যার ইচ্ছা জহির ভাইয়ের কেবিনে ঢুকছে, বের হচ্ছে। | আমি খাটের পাশে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, কেমন আছ ? 

জহির ভাই বললেন, কাগজ পড়ছি দেখছিস না! পড়া শেষ করি, তারপর আলাপ। 

আমি কি কাগজটা ধরব ? তুমি তাে একহাতে কাগজ ধরতে পারছ না ? 

জহির ভাই জবাব দিলেন না। আমি কেবিনের সাজসজ্জা দেখায় মন দিলাম। ঘরটা বেশ বড়। সঙ্গে এটাচড টয়লেট। টয়লেট থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। হাসপাতালের কেবিনের টয়লেটে পানির কল নষ্ট থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আমি যে কয়বার হাসপাতালের কেবিনে গিয়েছি, প্রতিবারই এই জিনিস দেখেছি। 

খাটের মাথার দিকে সাদা রঙ করা লােহার টেবিল। যেখানে যেখানে রঙ উঠে গেছে সেখানে লােহায় মরিচা পড়ে গেছে। টেবিলে কমলা এবং আঙুর রাখা আছে। বাংলাদেশে ফলের ব্যাপারে বিপ্লব হয়ে গেছে। সারা বছরই কমলা, আঙুর, আপেল পাওয়া যায়। রােগী দেখতে লােকজন কমলাই বেশি নিয়ে যায় ।

আমি এখন পর্যন্ত কাউকে আম নিয়ে রােগী দেখতে যেতে দেখি নি। রােগীদের জন্যে আম কি নিষিদ্ধ? আমের কথায় মনে পড়ল, বড়খালার জন্যে খিরসাপাতি আম কিনতে হবে। তিনি টাকা দিয়ে দিয়েছেন। খিরসাপাতি আমের কেজি কত টাকা করে কে জানে ?

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৯

 জহির ভাই পত্রিকা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন।  

আমি বললাম, হাসপাতালে সিগারেট খেতে দেয় ? 

জহির ভাই বললেন, দিবে না কেন ? হাসপাতাল তাে আর মসজিদ না, যে, কোনাে নেশা করা যাবে না।। 

তুমি আছ কেমন ? 

ভালাে। ইচ্ছা করলে আজই রিলিজ নিয়ে চলে যেতে পারি। যাচ্ছি না, ঠিক করেছি কিছু দিন রেস্ট নেব । রেস্ট নেবার জন্যে হাসপাতাল খারাপ না। 

খাওয়া কি হাসপাতাল থেকে দেয় ? 

দেয়। খাওয়া সুবিধার না, আমি হােটেল থেকে খাওয়া আনাই। এখানে ডাক্তারদের একটা ক্যান্টিন আছে, তারা দুপুরে ভালাে বিরানি বানায়। দুপুর পর্যন্ত থাক, বিরানি খেয়ে যা । 

আচ্ছা। জহির ভাই, তােমাকে কিন্তু সুন্দর লাগছে। কয়েকদিন শেভ না করায় খোঁচা খোঁচা দাড়ি বের হওয়ায় চেহারা বদলে গেছে। 

সাধু সাধু চেহারা হয়েছে না ? 

চা খাবি ? খাব। 

-কি কফি খাবি ? ক্যান্টিনে কফিও পাওয়া যায়। দশ টাকা কাপ। কফিও খেতে পারি । 

জহির ভাই শােয়া থেকে আধশােয়া হলেন। তাঁর হাতে সিগারেট। তিনি খুবই আরাম করে সিগারেট টানছেন । তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সব মানুষের আলাদা কিছু বিশেষত্ব থাকে। তাের বিশেষত্ব কী জানিস ? 

না । 

তাের বিশেষত্ব হচ্ছে, তুই কোনাে কিছুতেই না বলতে পারিস না। বিরানি খেতে বললাম, তুই রাজি। চা খেতে বললাম রাজি। কফি খেতে বললাম তাতেও রাজি। তুই কি না বলতে পারিস না ? 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৯

পারি, কিন্তু বলতে ইচ্ছা করে না। 

তুই অনেকক্ষণ হয়েছে আমার কাছে এসেছিস। এখনাে একবারও জিজ্ঞেস করিস নি, ঐ রাতে কী ঘটেছিল। এটাও তাের একটা বিশেষত্ব। 

তােমার বিশেষত্ব কী ? 

আমারটা আমি বলব কেন, তুই বলবি। এক্ষুনি বলতে হবে না। চিন্তা ভাবনা করে বের কর, তারপর তাের কাছ থেকে জেনে নেব। টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে মানিব্যাগ বের কর। পঞ্চাশ টাকার একটা নােট পুলিশ ভাইজানকে দে, তিন কাপ কফি নিয়ে আসবে। সে নিজে এককাপ খাবে । আর পনেরশ টাকা তাের। ধার নিয়েছিলাম, ধার শােধ করলাম । ঐ রাতে মরে গেলে তাে ধার শােধ হতাে না। 

জহির ভাই হাসছেন। একটা মানুষের হাসি এত সুন্দর! এখন কেবিনে শুধু আমরা দুজন। পুলিশ ভাইজান কফি আনতে আগ্রহের সঙ্গেই গিয়েছেন। জহির ভাইয়ের কাছে শুনেছি, সে কোনাে বাজার সদাইয়ের কাজ খুব আগ্রহের সঙ্গে করে, শুধু টাকা ফেরত দেয় না।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-১০

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *