কুকর। আমাকে এতটা মমতা দেখানাে কি ঠিক হচ্ছে? আমাদের পশু জগতের নিয়ম খুব কঠিন। ভালবাসা ফেরত দিতে হয়। মানুষ হয়ে তােমরা বেঁচে গেছ। তােমাদের ভালবাসা ফেরত দিতে হয় না।
আসগর সাহেবের সঙ্গে দেখা হল, কথা হল না। তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। চলে আসছি, দরজার কাছের বেড থেকে একজন ক্ষীণ স্বরে ডাকল ভাই সাহেব।
আমি ফিরলাম। ‘আমারে চিনছেন ভাই সাহেব?
‘আমি মােহম্মদ আব্দুল গফুর। আপনের কাছে চিঠি নিয়ে গেছিলাম। কুড়ি টাকা বখশিশ দিলেন।
‘খবর কি গফুর সাহেব ??
‘খবর ভাল না ভাই সাহেব। বােমা খাইছি। রিকশা কইরা ফিরতেছিলাম। বােমা মারছে।
‘রিকশায় উঠতে নিষেধ করেছিলাম…’ ‘কপালের লিখন, না যায় খণ্ডন। ‘তা তাে বটেই। ‘ঠ্যাং একটা কাইট্যা বাদ দিছে ভাই সাহেব।।
একটা তাে আছে। সেটাই কম কি? নাই মামার চেয়ে কানা মামা। ‘ভাই সাহেব, আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন ভাই সাহেব। ‘দেখি সময় পেলে করব। একেবারেই সময় পাচ্ছি না। হাঁটাহাটি খুব বেশি হচ্ছে। গফুর সাহেব, যাই?”
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৪
গফুর তাকিয়ে আছে। গফুরের বিছানায় যে মহিলা বসে আছেন তিনি বােধহয় গফুরের কন্যা। অসুস্থ বাবার পাশে কন্যার বসে থাকার দৃশ্যের চেয়ে মধুর দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম –- “মা যাই ?” | মেয়েটি চমকে উঠল। আমি তাকে মা ডাকব এটা বােধহয় সে ভাবেনি।
মারিয়ার বাবা আসাদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বলাকা সিনেমা হলের সামনের পুরানাে বইয়ের দোকানে। আমি দূর থেকে লক্ষ্য করলাম এক ভদ্রলােক পুরানাে বইয়ের দোকানের সামনে দাড়িয়ে। তার হাতে চামড়ার বঁধানাে মােটা একটা বই। তিনি খুবই অসহায় ভঙ্গিতে চারদিকে তাকাচ্ছেন। যেন জনতার ভেতর কাউকে খুঁজছেন। দ্রলােকের পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, চোখে চশমা। ফটোসেনসিটিভ গ্লাস বলেই দুপুরের কড়া রােদে সানগ্লাসের মত কাল হয়ে ভদ্রলােকের চোখ ঢেকে দিয়েছে।
আমি দ্রলােকের দিকে কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। হতভম্ব হবার প্রধান কারণ, এমন সুপুরুষ আমি অনেকদিন দেখিনি। সুন্দর পুরুষদের কোন প্রতিযােগিতা নেই। থাকলে বাংলাদেশ থেকে অবশ্যই এই ভদ্রলােককে পাঠানাে যেত। চন্দ্রের কলংকের মত যাবতীয় সৌন্দর্যে খুঁত থাকে – আমি দ্রলােকের খুঁতটা কি বের করার জন্যে এগিয়ে গেলাম এবং তাকে চমকে দিয়ে বললাম, কেমন আছেন?
অপরিচিত কেউ কেমন আছেন বলে আমরা জবাব দেই না। হয় ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকি, কিংবা বলি, আপনাকে চিনতে পারছি না। এই ভদ্রলােক তা করলেন না, সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে বললেন, জ্বি ভাল।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৪
কাছে এসেও ভদ্রলােকের চেহারায় খুঁত ধরতে পারা গেল না। পঞ্চাশের মত বয়স। মাথাভর্তি চুল। চুলে পাক ধরেছে – মাথার আধাআধি চুল পাকা। এই পাকা চুলেই তাকে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে – কুচকুচে কাল হলে তাকে মানাতাে না। | অসম্ভব রূপবতীদের বেলাতেও আমি এই ব্যাপারটা দেখেছি। তারা যখন যেভাবে থাকে – সেভাবেই তাদের ভাল লাগে। কপালে টিপ পরলে মনে হয় – আহ্, টিপটা কি সুন্দর লাগছে! টিপ না থাকলে মনে হয় – ভাগ্যিস, এই মেয়ে অন্য মেয়েগুলির মত কপালে টিপ দেয়নি। টিপ দিলে তাকে একেবারেই মানাতাে।
আমার ধারণা হল – ভদ্রলােকের চোখে হয়ত কোন সমস্যা আছে। হয়ত চোখ ট্যারা, কিংবা একটা চোখ নষ্ট। সেখানে পাথরের চোখ লাগান। ফটোসেনসিটিভ সানগ্লাস চোখ থেকে না খােলা পর্যন্ত কিছুই বােঝা যাবে না। কাজেই আমাকে
ভদ্রলােকের সঙ্গে কিছু সময় থাকতে হবে। এই সময়ের ভেতর নিশ্চয়ই তার চোখে ধুলাবালি পড়বে। চোখ পরিষ্কার করার জন্যে চশমা খুলবেন। যদি দেখি ভদ্রলােকের চোখও সম্রাট অশােক-পুত্র কুনালের চোখের মত অপূর্ব তাহলে আমার অনেকদিনের একটা আশা পূর্ণ হবে। আমি অনেকদিন থেকেই নিখুঁত রূপবান পুরুষ খুঁজে বেড়াচ্ছি। নিখুত রূপবতীর দেখা পেয়েছি —রূপবানের দেখা এখনাে পাইনি। | আমি ভদ্রলােকের মুখের দিকে তাকিয়ে পরিচিত মানুষের মত হাসলাম। তিনিও হাসলেন — তবে ব্যাকুল ভঙ্গিতে চারদিক তাকানাে দূর হল না। আমি বললাম, স্যার, কোন সমস্যা হয়েছে?
| তিনি বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, একটা সমস্যা অবশ্যি হয়েছে। ভাল একটা পুরানাে বই পেয়েছি – Holder-এর Interpretation of Conscience. অনেকদিন বইটা খুঁজছিলাম, হঠাৎ পেয়ে গেলাম।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৪
আমি বললাম, বইটা কিনতে পারছেন না? টাকা শর্ট পড়েছে? তিনি বললেন, জ্বি। কি করে বুঝলেন? ‘ভাবভঙ্গি থেকে বােঝা যাচ্ছে। আমার কাছে একশ’ একুশ টাকা আছে – এতে কি হবে?”
‘একশ’ টাকা হলেই হবে। | আমি একশ’ টাকার নােট বাড়িয়ে দিলাম। ভদ্রলােক খুব সহজভাবে নিলেন। অপরিচিত একজন মানুষ তাকে একশ টাকা দিচ্ছে এই ঘটনা তাকে স্পর্শ করল না।। যেন এটাই স্বাভাবিক। ভদ্রলােক বই খুলে ভেতরের পাতায় আরেকবার চোখ বুলালেন – মনে হচ্ছে দেখে নিলেন মলাটে যে নাম লেখা ভেতরেও সেই নাম কি
‘অসম্ভব। আমার এখন অনেক কাজ। ‘বেশ, আপনার ঠিকানা বলুন। আমি টাকা পৌছে দেব। ‘আমার কোন ঠিকানা নেই। ‘ ‘সেকি।। ‘স্যার, আপনি বরং আপনার টেলিফোন নাম্বার দিন। আমি টেলিফোন করে একদিন আপনাদের বাসায় চলে যাব।‘
‘কার্ড দিচ্ছি, কার্ডে ঠিকানা, টেলিফোন নাম্বার সবই আছে।।
‘কার্ড না দেওয়াই ভাল। আমার পাঞ্জাবির কোন পকেট নেই। কার্ড হাতে নিয়ে ঘুরব, কিছুক্ষণ পর হাত থেকে ফেলে দেব। এরচে টেলিফোন নাম্বার বলুন, আমি মুখস্থ করে রেখে দি। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল। একবার যা মুখস্থ করি তা ভুলি না। | উনি টেলিফোন নাম্বার বললেন। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে গাড়িতে উঠে বসলেন। তখনাে তার হাতে বইটি ধরা। মনে হচ্ছে বই হাতে নিয়েই গাড়ি চালাবেন। আমি বললাম, স্যার, দয়া করে এক সেকেন্ডের জন্যে আপনি কি চোখ থেকে চশমাটা খুলবেন?
‘কেন ?
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৪
‘ব্যক্তিগত কৌতুহল মেটাব। অনেকক্ষণ থেকে আমার মনে হচ্ছিল আপনার একটা চোখ পাথরের। | উনি বিস্মিত হয়ে বললেন, এরকম মনে বার কারণ কি? বলতে বলতে তিনি চোখ থেকে চশমা খুললেন। আমি অবাক হয়ে তার চোখ দেখলাম।
পৃথিবীতে সবচে সুন্দর চোখ নিয়ে চারজন মানুষ জন্মেছিলেন – মিশরের রাণী ক্লিওপেট্রা, ট্রয় নগরীর হেলেন, অশােকের পুত্র কুনাল এবং ইংরেজ কবি শেলী। আমার মনে হল – এই চারটি নামের সঙ্গে আরেকটি নাম যুক্ত করা যায়। ভদ্রলােকের কি নাম? আমি জানি না – ভদ্রলােকের নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি। তার টেলিফোন নাম্বারও ইতিমধ্যে ভুলে গেছি। তাতে ক্ষতি নেই – প্রকৃতি তাকে কম করে হলেও আরাে চারবার আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে।
এইসব ব্যাপারে প্রকৃতি খুব উদার – পছন্দের সব মানুষকে প্রকৃতি কমপক্ষে পাঁচবার মুখােমুখি করে দেয়। মুখােমুখি করে মজা দেখে।। | কাজেই আমি ভদ্রলােকের সঙ্গে যােগাযােগের কোন চেষ্টা আর করলাম না। আমি থাকি আমার মত – উনি থাকেন ওনার মত। আমি ঠিক করে রেখেছি – একদিন নিশ্চয়ই আবার তার সঙ্গে দেখা হবে। তখন তার সম্পর্কে জানা যাবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মানুষটা ইন্টারেস্টিং।
Read More