হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৬

শাড়ির মত কাশী নীল। 

| ঘুম ভেঙে দেখি চোখের সামনে হুলস্থুল ধরনের বাড়ি। প্রথদর্শনে মনে হল বাড়িতে আগুধরে গেছে। বুকে একটা ছােটখাট ধাক্কার মত লাগল। পুরাে বাড়ি বােগেনভিলিয়ার গাঢ় লাল রঙে ঢাকা। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় ফুলের রঙকে আগুন বলে মনে হচ্ছিল।

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম

মারিয়া বলল, বাড়িনাম মনে করে রাখুন – চিত্রলেখা। চিত্রলেখা হচ্ছে আকাশের একটা তারার নাম। 

আমি বললাম, ও আচ্ছা। ‘আজ বাড়িতে কেউ নেই। মা গেছেন রাজশাহী। 

আমি আবারও বললাম, ও আচ্ছা।। ‘আপনি কি টাকাটা নিয়ে চলে যাবেন, না একটু বসবেন? ‘টাকা নিয়ে চলে যাব। 

বাড়ির ভেতরে ঢুকবেন না?” 

আমি তাকালাম। বাড়ির ভেতর থেকে মারিয়া ইন্সটিমটিক ক্যামেরা হাতে বের হয়েছে। বের হতে অনেক সময় নিয়েছে, কারণ সে শাড়ি বদলেছে। এখন পরেছে স্কার্ট। স্কার্ট পরায় একটা লাভ হয়েছে। মেয়েটা যে অসম্ভব রূপবতী তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। শাড়িতে যেমন অপূর্ব লাগছিল স্কার্টেও তেমলাগছে। দীর্ঘ সময় গেটের বাইরে রােদে দাড়িয়ে থাকার কষ্ট মেয়েটাকে দেখে একটু যেন কমল। | ‘আপনি সূর্যকে সামনে রেখে এটু দাড়ান। মুখের উপর সানলাইট পড়ুক। আপনার ছবি তুলব। বাবাকে ছবির একটা কপি পাঠাতে হবে। ছবি দেখলে বাবা বুঝবেন যে, আমি আসল লােকই পেয়েছিলাম। 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৬

‘হাসব?”। ‘হ্যা, হাসতে পারেন। ‘দাত বের করে হাসব? না ঠোট টিপে? ‘যে ভাবে হাসতে ভাল লাগে সে ভাবেই হাসুন। আর এই নিন টাকা। 

মারিয়া একশ টাকার দুটা নােট এগিয়ে দিল। দুটাই চকচকে নােট। বড়লােকদের সবই সন্দর। আমি অপ যে কজন দারুণ বড়লােক দেখেছি তাদের কারাে কাছেই কখনাে ময়লা নােট দেখিনি। ময়লা নােটগুলি এরা কি ওয়াশিং মেশিনে ধুয়ে ইস্ত্রি করে ফেলে? না-কি ডাস্টবিনে ফেলে দেয়? | ‘আমি আপনার বাবাকে একশ টাকা দিয়েছিলাম। | ‘বাবা বলে দিয়েছেন যদি আপনার দেখা পাই তাহলে যেন দুশ টাকা দেই। কারণ – গ্রন্থ সাহেব বইএ গুরু নানক বলেছেন – 

দু গুনা দত্তাচৌগুনা জুজার। 

‘তাহলে এখানে দাঁড়ান। 

আমি দাড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা গ্রহ করেআমাকে এতদূর এনেছে কিন্তু আমাকে বাড়িতে ঢুকানাের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আমি তাতে তেমন অবাহলাম না। আমি লক্ষ্য করেছি বেশিরভাগ মানুষই আমাকে বাড়িতে ঢােকাতে চায়। না। দরজার ওপাশে রেখে আলাপ করে বিদায় করে দিতে চায়। রাস্তায় রাস্তায় দীর্ঘদিন হাঁটাহাটির ফলে আমার চেহারায় হয়ত রাস্তা-ভাব চলে এসেছে। রাস্তা 

দুগুণ নিলে চারগুণ ফেরত দিতে হয়। বাবা সামনের মাসের ১৫ তারিখের পর। আসবেন। আপনি তখন এলে বাবা খুব খুশি হবেন। আর বাবার সঙ্গে কথা বললে আপনার নিজেরও ভাল লাগবে। 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৬

‘আমার ভাল লাগবে সেটা কি করে বলছেন? ‘অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বাবার সঙ্গে যে পাঁচ মিনিট কথা বলে সে বার বার 

ফিরে আসে। 

‘ও আচ্ছা। 

আচ্ছা বলা কি আপনার মুদ্রা দোষ? একটু পর পর আপনি আচ্ছা 

বলছেন। 

‘কিছু বলার পাচ্ছি না বলে “আচ্ছা বলছিবাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আসবেতাে?” আসব। 

‘আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে – যে প্রশ্নের জবাব আপনি জানেন না – সেই প্রশ্ন বাবার জন্যে নিয়ে আসতে পারেনআমার ধারণা, আমার বাবা এই পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি সব প্রশ্নের জবাব জানে। 

| আমি যথাসম্ভবিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বললাম – “ও আচ্ছা। মারিয়া বাড়িতে ঢুকে পড়ল। বাড়ির দারােয়ান গেট বন্ধ করে মােটা মােটা দুতালা লাগিয়ে দিয়ে জেলের সেন্ট্রির মত তালা টেনে টেনে

পরীক্ষা করতে লাগল। আমি হাতের মুঠোয় দুটা চকচকে নােট নিয়ে চৈত্রের ভয়াহ রােদে রাস্তায় নালামমারিয়া একবারও বলল না – কোথায় যাবেন বলুন, গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেবেবড়লােকদের ঠাণ্ডা গাড়ি মানুষেচরিত্র খারাপ করে দেয় – একবার চড়লে শুধুই চড়তে ইচ্ছা করে। আমি রাস্তায় হাঁটা মানুষ, অল্প কিছু সময় মারিয়াদের গাড়িতে চড়েছি, এতেই হেঁটে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না।। 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৬

‘তুমি কেমআছ? দি ভা‘বােস। খাটের উপর বােস। | ‘আমি কিন্তু স্যার ভিজে জবজবা ‘কোন সমস্যা নেইবােস। মাথা মুছবে ?? দ্বি না স্যারবৃষ্টিপানি আমি গায়ে শুকাইতােয়ালে দিয়ে বৃষ্টিপানি মুছলে বৃষ্টিঅপমান হয়। 

আমি খাটে বসলামভদ্রলােক হাবাড়িয়ে আমার কাধ স্পর্শ করলেন। তুমি কেমআছ হিমালয়? ‘জ্বি ভাল। 

‘ঐ দিন তােমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে সেছিলাম – ধন্যবাদ পর্যন্ত দেইনিআসলে মাথার মধ্যে ব সময় ছিল কখবইটা পড়ব। জগতের চারপাশে তখন কি ঘটছিল তা আমার মাথায় ছিল নাভাল কোন বই হাতে পেলে আমার এ রকম হয়। 

‘বইটা কি ভাল ছিল? | ‘আমি যতটা ভাল আসা করেছিলাম তারচে ভাল ছিলএ জাতীয় বই লাইব্রেরিতে পাওয়া যায় না। পথেঘাটে পাওয়া যায়আমি এবার পুরানাে খবরের কাগজ কেনে এ রকম ফেরিওয়ালার ঝুড়ি থেকে একটা বই জোগাড় করেছিলাম। বইটার নাম ‘Dawn of Intelligence, এইটিন নাইনটি টুতে প্রকাশিত বই – অথর হচ্ছেন ম্যাক মাস্টাররয়েল সােসাইটির ফেললচামড়া দিয়ে মানুষ বই ধাধিয়ে রাখে – ঐ বইটা ছিল সােনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মত। 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৬

মারিয়া বলল, বইয়ের কচকচানি শুনতে ভালাগছে না বাবা – আমি যাচ্ছিতােমাদের চা বা কফি কিছু লাগলে বল, আমি পাঠিয়ে দেব| আসাদুল্লাসাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদেচা দাও। আর শােন, হিমালয়, তুমি আমাদের সঙ্গে দুপুরে খাবে। তােমার কি আপত্তি আছে? 

বি না। ‘তােমাকে কি এক সেট শুকনাে কাপড় দেব? লাবে না স্যারশুকিয়ে যাবে। 

তােমাকে দেখে এত ভাল লাগছে কেন বুঝতে পারছি নামারিয়া, তুই বল তাে এই ছেলেটাকে দেখে আমার এত ভাল লাগছে কেন?  ‘তােমার ভাল লাগছে কারণ তুমি ধরে নিয়েছিলে ভদ্রলােকের সঙ্গে তােমার দেখা হবে না। তাকে ধন্যবাদ দিতে পারবে নাসারাজীবন ঋণী হয়ে থাকবেতুমি ঋণ শােধ করতে পেরেছ, এই জন্যেই ভাল লাছে। 

আসাদাহ সাহেবের সঙ্গে দেখা হল আষাঢ় মাসেবষ্টিতে ভিজে জবজবা হয়ে ওদের বাড়িতে গিয়েছি। 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৭

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *