আমাকে দেখেও একবারও জিজ্ঞেস করল না – ব্যাপার কি? সহজ ভঙ্গিতে সে আমাকে নিয়ে গেল তার বাবার কাছে। বিশাল একটা ঘরে ভদ্রলােক খালি গায়ে বিছানায় বসে আছেন। অনেকটা পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসা। তার চোখ একটা খােলা বইয়ের দিকে। দেখেই বােঝা যায় ভদ্রলােক গভীর মনযােগে বই পড়ছেন। আমরা দুজন যে ঢুকলাম তিনি বুঝতেও পারলেন না। মারিয়া বলল, বাবা, একটু তাকাবে?
ভদ্রলােক বললেন, যা তাকাব। বলার পরেও তাকালেন না। যে পাতাটা পড়ছিলেন সে পাতাটা পড়া শেষ করে বই উল্টে দিয়ে তারপর তাকালেন। তাকিয়ে হেসে ফেললেন। আমি চমকে গেলাম। মানুষের হাসি এত সুন্দর হয়। তৎক্ষণাৎ মনে হল – ভাগ্যিস, মেয়ে হয়ে জন্মাইনি! মেয়ে হয়ে জন্মালে এই ঘর থেকে বের হওয়া অসম্ভব হত।
‘হিমালয় সাহেব না?
‘ভেরি গুড় – যতই দিন যাচ্ছে তাের বুদ্ধি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে।
মারিয়া চা আনতে গেল। আমি আসাদুল্লাহ সাহেবকে বললাম, আপনাকে একটা প্রশ্ন করব। আমি আসলে আপনাকে দেখতে আসিনি, প্রশ্নটা করতে এসেছি।
আসাদুল্লাহ সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কি প্রশ্ন? | এই জীবজগতে মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী কি আছে যে আত্মহত্যা করতে
পারে?
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৭
‘আছে। লেমিং বলে এক ধরনের প্রাণী আছে। ইদুর গােত্রীয়। স্ত্রী-লেমিংদের বছরে দুটা বাচ্চা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে প্রতি চার বছর পর পর দুটার বদলে এদের বাচ্চা হয় দশটা করে। তখন ভয়ংকর সমস্যা দেখা দেয়। খাদ্যের অভাব, বাসস্থানের অভাব। এরা তখন করে কি — দল বেঁধে সমুদ্রের দিকে হাঁটা শুরু করে। এক সময় সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। মিনিট দশেক মনের আনন্দে সমুদ্রের পানিতে সাঁতরায়। তারপর সবাই দল বেঁধে সমুদ্রে ডুবে আত্মহত্যা করে। মাস সুইসাইড।
বলেন কি | ‘নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের মধ্যে মাস সুইসাইডের ব্যাপারটা আছে। সীল মাছ করে, নীল তিমিরা করে, হাতি করে। আবার এককভাবে আত্মহত্যার ব্যাপারও আছে। একক আত্মহত্যার ব্যাপারটা দেখা যায় প্রধানত কুকুরের মধ্যে। প্রভুর মৃত্যুতে শােকে অভিভূত হয়ে এরা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে আত্মহত্যা করে। পশুদের আত্মহত্যার ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছ কেন?” | ‘জানতে চাচ্ছি, কারণ – আপনার কন্যার ধারণা আপনি পৃথিবীর সব প্রশ্নের জবাব জানেন।
সত্যি জানেন কি-না পরীক্ষা করলাম। | আসাদুল্লাহ সাহেব আবারও হাসছেন। আমার আবারও মনে হল, মানুষ এত সুন্দর করে হাসে কি ভাবে? ” মারিয়ার এরকম ধারণা অবশ্যি আছে, যদিও তার মা‘র ধারণা, আমি পৃথিবীর কোন প্রশ্নেরই জবাব জানি না। ভাল কথা, হিমালয় নামটা ডাকার জন্যে একটু বড় হয়ে গেছে –– হিমু ডাকলে কি রাগ করবে?
‘বি না। “হিমু সাত্বে!’ ‘ব্ধি।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৭
ব্যাপারটা কি তােমাকে বলি – আমার হল জাহাজের নাবিকের চাকরি। সিঙ্গাপুরের গােল্ডেন হেড শিপিং করপােরেশনের সঙ্গে আছি। মাসের পর মাস থাকতে হয় সমুদ্রে। প্রচুর অবসর। আমার আছে বই পড়ার নেশা – ক্রমাগত পড়ি। স্মৃতিশক্তি ভাল, যা পড়ি মনে থাকে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে চট করে জবাব দিতে পারি।
‘এনসাইক্লোপিডিয়া হিউমেনিকা?’
| ‘হা হা হা। তুমি তাে মজা করে কথা বল। মােটেই এনসাইক্লোপিডিয়া না। আমি হচ্ছি সেই ব্যক্তি যে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত দুবার পড়েছে। এনসাইক্লোপিডিয়া মানুষ কেনে সাজিয়ে রাখার জন্যে, পড়ার জন্যে না। আমার হাতে ছিল প্রচুর সময় – সময়টা কাজে লাগিয়েছি। পড়েছি।
‘পড়তে আপনার ভাল লাগে ? | ‘শুধু ভাল লাগে না, অসাধারণ ভাল লাগে। প্রায়ই কি ভাবি জান? প্রায়ই ভাবি, মৃত্যুর পর আমাকে যদি বেহেশতে পাঠানাে হয় তখন কি হবে? সেখানে কি লাইব্রেরি আছে? নানান ধর্মগ্রন্থ ঘেঁটে দেখেছি। স্বর্গে লাইব্রেরি আছে এ রকম কথা কোন ধর্মগ্রন্থে পাইনি। সুন্দরী হুরদের কথা আছে, খাদ্য-পানীয়ের কথা আছে, ফলমূলের কথা আছে, বাট নাে লাইব্রেরি।
| ‘বেহেশতে আপনি নিজের ভুবন নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে পারবেন। আপনার ইচ্ছানুসারে আপনার হাতের কাছেই থাকবে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির মত প্রকাণ্ড লাইব্রেরি।
আসাদুল্লাহ সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, নিজের বেহেশত নিজের মত করা গেলে আমার বেহেশত কি রকম হবে তােমাকে বলি – সুন্দর একটা বিছানা থাকবে, বিছানায় বেশ কয়েকটা বালিশ। চারপাশে আলমিরা ভর্তি বই, একদম হাতের কাছে, যেন বিছানা থেকে না নেমেই বই নিতে পারি। কলিংবেল থাকবে – বেল টিপলেই চা আসবে।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৭
‘গান শােনার ব্যবস্থা থাকবে না? | ‘ভাল কথা মনে করেছ। অবশ্যই গান শােনার ব্যবস্থা থাকবে। সফট স্টেরিও মিউজিক সারাক্ষণ হবে। মিউজিক পছন্দ না হলে আপনাআপনি অন্য মিউজিক বাজা শুরু হবে। হাত দিয়ে বােম টিপে ক্যাসেট বদলাতে হবে না।
‘সারাক্ষণ ঘরে বন্দি থাকতে ভাল লাগবে?
বন্দি বলছ কেন? বই খােলা মানে নতুন একটা জগৎ খুলে দেয়া। “তারপরেও আপনার হয়ত আকাশ দেখতে ইচ্ছা করবে। ‘এটাও মন্দ বলনি। হ্যা থাকবে, বিশাল একটা জানালা আমার ঘরে থাকবে। তবে জানালায় মােটা পর্দা দেয়া থাকবে। যখন আকাশ দেখতে ইচ্ছে করবে – পর্দা সরিয়ে দেব।
‘এই হবে আপনার বেহেশত?
‘আপনার স্ত্রী আপনার কন্যা এরা আপনার পাশে থাকবে না?” ‘থাকলে ভাল। না থাকলেও কোন ক্ষতি নেই। ‘ভাল করে ভেবে দেখুন, আপনার বেহেশতে কিছু বাদ পড়ে যায়নি তাে?” ‘না, সব আছে।
‘খুব প্রিয় কিছু হয়ত বাদ পড়ে গেল।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৭
আসাদুল্লাহ সাহেব বিস্মিত হয়ে
বললেন, তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন এক্ষুণি বেহেশতটা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। | আমি হাসলাম। আসাদুল্লাহ সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, ও, একটা জিনিস বাদ
পড়ে গেছে। ভাল একটা আয়না লাগবে। এক সঙ্গে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায় । এ রকম একটা আয়না। আমার একটা মেয়েলি স্বভাব আছে। আয়নায় নিজেকে
দেখতে আমার ভাল লাগে।।
‘সবারই আয়নায় নিজেকে দেখতে ভাল লাগে।
আসাদুল্লাহ সাহেব চুরুট ধরাতে ধরাতে বললেন, তুমি কি জান আয়নায় মানুষ। যে ছবিটা দেখে সেটা আসলে ভুল ছবি? উল্টো ছবি। আয়নার ছবিটাকে বলে মিরর ইমেজ। আয়নায় নিজেকে দেখা যায় না – উল্টোমানুষ দেখা যায়। | এমন একটা আয়না কি বানানাে যায় না যেখানে মানুষ যেমন তেমনই দেখা
‘কি খাবে বল, চা না কফি? একবার বেল টিপলে চা আসবে। দু’বার টিপলে কফি। খুব ভাল ব্যবস্থা।
‘কফি খাব।