হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৮

আসাদুল্লাহ সাহেব দুবার বেল টিপলেনআবারও হাসলেনতার হাসি আগের মতই সুন্দর। প্রকৃতি তাকে বিছানায় ফেলে দিয়েছে কিন্তু সৌন্দর্য হরণ করেনিসেদিন বরং হাসিটা আরাে বেশি সুন্দর লাগল।

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম

“হিমু সাহেব। 

যাবে

‘সেই চেষ্টা কেউ করেনি| আসাদুল্লাহ সাহেব ঠাৎ খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন, ভুরু কুঁচকে ফেললেন। আমি বললাম, এত চিন্তিত হয়ে কি ভাবছেন? 

‘ভাবছি, বেহেশতের পরিকল্পনায় কিছু বাদ পড়ে গেকিনা। 

| ‘জীবিত অবস্থাতেই আমি আমার কল্পনার বেহেশত পেয়ে গেছি। আমার কি উচিত না গড অলমাইটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হওয়া ? 

‘ঠিক বুঝতে পারছি না।’ আমিও ঠিক বুঝতে পারছি নাকবিতা শুনবে?” ‘আপনি শুনাতে চাইলে শুনব‘আগে কবিতা ভাল লাগতাে না। ইদানীং লাগছে – শােন ...‘ 

আসাদুল্লাহ সাহেব কবিতা আবৃত্তি করলেন। ভদ্রলােকের সব কিছুই আগের মত আছে। শুধু গলার স্বরে সামান্য পরিবর্তন হয়েছেনে হয় অনেক দূর থেকে কথা বলছেন – 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৮

এখন বাতাস নেই – তবু শুধু বাতাসের শব্দ হয় বাতাসের মত সময়ের। কোনাে রৌদ্র নেই, লু আছেকোনাে পাখি নেই, তবু রৌদ্রে সারা দিন হংসের আলাের কণ্ঠ রয়ে গেছে।” 

আসাদুল্লাহ সাহেব মৃত্যুর আগেই তার বেহেশত পেয়ে গেছেনতার চারটা গাড়ি থাকা সত্ত্বেও এক মে মাসে ঢাকা শহরে রিকশা নিয়ে বের হলেন। গাড়িতে চড়লে আকাশ দেখা যায় নারিকশায় চড়লে আকাশ দেখতে দেখতে যাওয়া যায় বলেই রিকশা নেয়া। আকাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছিলেন, একটা টেম্পাে এসে রিকশাকে ধাক্কা দিল। এমন কিছু ভয়াবহ ধাক্কা না, তারপরেও তিনি রিকশা থেকে পড়ে গেলেন – মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেলপেরােপ্লাজিয়া হয়ে গেল। সুষুম্নাকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হল। তার বাকি জীবনটা কাটবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। ডাক্তাররা সে রকমই বলেছেন। 

মি তাকে একদিন দেখতে গেলাম। যে রে তিনি আছেন তার ঠিক মাঝখানে বড় একটা বিছানাবিছানায় পাচ-ছটা বালিশতিন পাশে আলমিরা ভর্তি বইহাতের কাছে স্টেরিও সিস্টেমবিছানার মাথাকাছে বড় জানালাজানালায় ভিনিসিয়ান ব্লাইন্ড। সবই আছে, শুধু কোন

আয়না চোখে পড়ল না। 

আমাকে দেখেই আসাদুল্লাহ সাহেব হাসিমুখে বললেন, খবর কি হিমু সাহে? আমি বললাম, জি ভাতােমার কাজ তাে শুনি রাস্তায় হাঁটাহাটি করা – হাটাহাটি ঠিকমত হচ্ছে

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৮

হচ্ছে। 

‘বল দেখি কার কবিতা? বলতে পারছি না, আমি কবিতা ড়ি না‘কবিতা পড় না? 

‘ছি না। আমি কিছুই পড়ি না। দু-একটা জটিকবিতা মুখস্থ করে রাখি মানুষকে ভড়কে দেবার জন্যেআমার কবিতা-প্রীতি বলতে এইটুকুই। 

কফি চলে এসেছে। গন্ধ থেকেই বােঝা যাচ্ছে খুব ভাল কফিআমি কফি খাচ্ছিআসাদুল্লাহ সাহেব উপুড় হয়ে শুয়ে আছেনতার হাতে কফির কাপতিনি কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন না। তাকিয়ে আছেজানালার দিকেসেই জানালায় ভারি পর্দাআকাশ দেখার উপায় নে। আসাদুল্লাহ সাহেবেখন হয়ত আকাশ দেখতে ইচ্ছা করে না। 

দূরে বসে চিকন কলমে একজন কপাল ভর্তি লেখা লেখেনসেই লেখার উপরে জীবন চলে। 

‘ইমাঝে মাঝে ওনার কলমের কালি শেষ হয়ে যায়, তখন কিছু লেখেন নামুখে বলে দেন যা ব্যাটা নিজের মত চড়ে খা” – এই বলে নতুন কলম নিয়ে 

অন্য একজনের কপালে লিখতে বসেন। 

‘বড়ই রহস্য এই দুনিয়া! রহস্য তাে বটেই এখন বলুন আপনার চিকিৎসাকি হচ্ছে? অপারেশন হবার কথা‘হবার কথা হচ্ছে না কে

‘দেশে এমন সমস্যা। ডাক্তাররা ঠিকমত আসতে পারেন নাঅল্প সময়ের জন্যে অপারেশন থিয়েটার খােলেআমার চেয়েও যারা সিরিয়াস তাদের অপারেশন 

ও আচ্ছা। মৃত্যু নিয়ে আমার কোন ভয়ভীতি নাই হিমু ভাই। 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৮

আমি আবারও বললাম, আচ্ছা‘ভালমত মরতে পারাও একটা আনন্দের ব্যাপারআপনি শিগগিরই মারা যাচ্ছেন? 

‘কেমন আছেন আসগর সাহেব? 

“জ্বি ভাল। ‘কি রকম ভাল

আসগর সাব্বে হাসলেন। তার হাসি দেখে মনে হল না তিনি ভালমৃত্যুর ছায়া যাদের চোখে পড়ে তারা এক বিশেষ ধরনের হাসি হাসে। উনি সেই হাসি হাসছেন। 

আমি একবার ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল জেলে এক ফাসির আসামী দেখতে গিয়েছিলামফাসির আসামী কিভাবে হাসে সেটা আমার দেখার শখফাঁসির আসামীর নাম হােসেন মােল্লা, তাকে খুব স্বাভাবিক মনে হল। শুধু যক্ষ্মা রােগীর মত জ্বলজ্বলে চোখ। সেই চোখও অস্থির, একবার এদিকে যাচ্ছে, একবার ওদিকেবেচারাফাসির দিন-তারিখ জেলার সাহেব ঠিক করতে পারছেন না, কারণ বাংলাদেশে নাকি দুইভাই আছে যারা বিভিন্ন জেলখানায় ফাসি দিয়ে বেড়ায়তারা ডেট দিতে পারছে নাদুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যক্রমে আমি যেদিন গিয়েছি সেদিনই দুই ভাই চলে এসেছে।

পরদিন ভােরে হােসেন মােল্লার সময় ধার্য হয়েছেহােসেন মােল্লা আমাকে শান্ত গলায় বলল, “ভাই সাহেব, এখনাে হাতে মেলা সময়এই ধরেন, আইজ সারা দিন রা আছে, তার পরে আছে গােটা একটা রাইতঘটনা ঘটনের এখনাে মেলা দেরিবলেই হােসেন হাসলসেই হাসি দেখে আমার সারা গায়ে কাটা দিল। প্রেতের হাসি। | আসগর সাহেবের হাসি দেখেও গায়ে কাঁটা দিল। কি ভয়ংকর হাসি! আমি বললাম, ভাই, আনার কি হয়েছে? ডাক্তার বলছে কি? | ‘আলসাসারাজীবন অনিয়ম করেছি – খাওয়াদাওয়া সময়মত হয় নাই, সেখান থেকে আলসার। 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৮

‘পেটে রােলারের গুতাও তাে খেয়েছিলেন। 

‘রােলারের গুতা না খেলেও যা হবার হত। সব কপালের লিখন, তাই না হিমু ভাই

তা তাে বটেই। 

মরে গেলে সাত হাজার টাকাটার কি হবে? লােযে কোনদিন চলে আসতে পারে। 

ও আসবে না‘বুঝলেন কি করে আসবে না? তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে“তার সঙ্গে কথা হয়েছে মানে? সে কি হাসপাতালে এসেছিল?” 

‘আসগর ভাই, ব্যাপাটা ভালমত বুঝিয়ে বলুন তাে। আমি ঠিকমত বুঝতে পাছি না। 

আসগর সাহেব মৃদু গলায় কথা বলতে শুরু করলেনবােঝা যাচ্ছে যা বলছেন – খুআগ্রহ নিয়ে বলছেন। 

‘বুঝলেন হিমু ভাই – প্রচণ্ড ব্যথার জন্য রাতে ঘুমাতে পারি নাগত রাতে ডাক্তার সাহেব একটা ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেরাত তিনটার দিকে ঘুমটা ভেঙে গেলদেখি খুপানির পিপাসাহাতের কাছে টেবিলের উপর একটা পানির জগ আছে। জগে পানি নাইজেগে আছি নাদের কেউ এদিকে আসলে পানির কথা বলবকেউ আসছে না। হঠাৎ কে যেন দু’লর কাশল। আমার টেবিল

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৯

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *