ফাতেম খালা একটা চিরকুট পাঠিয়েছেন। চিরকুটে লেখা—
এক্ষুনি চলে আয়, ম্যানেজারকে পাঠালাম। খবর্দার দেরি করবি না। খুবই জরুরী। very urgent.
ফাতেম খালা।
ম্যানেজার লােক গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তার গায়ে স্যুট। পায়ে কালাে রঙের জুতা। মনে হয় আসার আগে পালিশ করিয়ে এনেছেন। জুতা জোড়া আয়নার মত চকচক করছে। গলায় সবুজ রঙের টাই। বেশির ভাগ মানুষকেই টাই মানায় না। ইনাকে মানিয়েছে। মনে হচ্ছে ইনার গলাটা তৈরিই হয়েছে টাই পরার জনে। ভদ্রলােক আফটার শেভ লােশন, কিংবা সেন্ট মেখেছেন। মিষ্টি গন্ধ আসছে। তার চেহারাও সুন্দর । ভরাট মূখ। ঝকঝকে শাদা দাঁত। বিদেশী টুথপেষ্টের বিজ্ঞাপনে এই দাঁত ব্যবহার করা যেতে পারে।
ভদ্রলােককে ফাতেমা থালার ম্যানেজার বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। বােঝাই যাচ্ছে, আমার রটা তাঁর খুবই অপছন্দ হচ্ছে। তিনি সম্ভবত কোন বিকট দুর্গন্ধ পাচ্ছেন। কারণ কিছুক্ষণ পরপরই চোখ-মুখ কুচকে ফেলে নিঃশ্বাস টানছেন। পকেটে হাত দিচ্ছেন, সম্ভবত রুমালের খােজে | তবে ভদ্রতার খাতিরে রুমাল দিয়ে নাকচাপা দিচ্ছেন ন। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। সম্ভবত দুর্গন্ধ কোথেকে আসছে তা বের করার চেষ্টা।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
ভদ্রলােক অস্থির গলায় বললেন, ‘বসে আছেন কেন? চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, ‘কোথায় চলব?’ | ভদ্রলােক অতিরিক্ত রকমের বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘আপনার খালার বাসায়। আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি।’
দেরি হবে। হাত-মুখ ধােব, চা-নাশতা করব। ‘চা-নাশতা ম্যাডামের বাসায় করবেন। চট করে মুখটা ধু ধুয়ে নিন।
মুখ ধুতেও দেরি হবে। ঘন্টা দুই লাগবে।
ভদ্রলােক আকাশ থেকে পড়ার মত করে বললেন, ‘মুখ ধুতে দু’ঘন্টা লাগবে?
আমি আবারাে হাই তুলতে তুলতে এবারের হাইটা নকল হাই। বললাম, বেশিও লাগতে পারে। আমাদের এই মেসে একটা মােটে বাথরুম। ত্রিশজন বাের্ডার। ত্রিশজন বাের্ডারের সঙ্গে সব সময় থাকে গােটা দশেক আত্মীয়, কিছু দেশের বাড়ির মানুষ। সব মিলিয়ে গড়ে চল্লিশজন। এই চল্লিশজনের সঙ্গে। আমাকে লাইনে দাঁড়াতে হবে। সকালবেলার দিকে লম্বা লাইন হয়।
দু’ঘন্টা অপেক্ষা করা সম্ভব না। আপনি গাড়িতে উঠুন। হাত-মুখ আপনার খালার বাড়িতে ধুবেন। সেখানকার ব্যবস্থা অনেক ভাল।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
ভদ্রলােকের গলায় এখন হুকুমের সুর বের হচ্ছে। স্যুট-টাই পরা মানুষ অবশ্যি নরম স্বরে কথা বলতে পারে না। আপনাতেই তাদের গলার স্বরে একটা ধমকের ভাব চলে আসে। অবশ্যি স্যুট পরা মানুষ মিনমিন করে কথা বললে শুনতেও ভাল লাগে না। তাদেরকে ঘরজামাই মনে হয়। শ্বশুরবাড়ির স্যুটে পূর্সোনিলিটি আসে না।
‘একি এখনাে এসে আছেন? বললাম না, চলুন।
আমি চৌকি থেকে নামতে নামতে বললাম, ‘আজ কি বার?” মঙ্গলবার।
আমি আবারাে ধপ করে চৌকিতে বসে পড়লাম। চিন্তিত ভঙ্গিতে বললাম, মঙ্গলবার যদি হয়, তাহলে যাওয়া যাবে না। মঙ্গলবার যাত্রা নাস্তি।
যাবেন না? “জ্বি না। আপনি বরং বুধবারে আসুন। ‘বুধবারে আসব? ‘জ্বি। খনার বচনে আছে — বুধের ঘাড়ে নিয়ে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা।’
ম্যানেজার চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে খনার বচন শােনা তাঁর অভ্যাস নেই। তিনি মনে হয় খানিকটা রেগেও যাচ্ছেন। চোখ ছােট ছােট হয়ে গেছে । রাগলে মানুষের চোখ ছােট হয়ে যায়। আনন্দিত মানুষের চোখ হয় বড় বড়।
হিমু সাহেব।
ক।”
আপনাকে যেতেই হবে। ম্যাডাম আমাকে পাঠিয়েছেন, আপনাকে নিয়ে যেতে। আমি না নিয়ে যাব না। আপনি লাইনে দাঁড়িয়ে হত-মুখ ধােন, চা – নাশতা খান, ইচ্ছে করলে আরাে খানিকক্ষণ গড়াগড়ি করুন। আমি কসছি। দু‘ঘন্টা কেন, দরকার হলে সাত ঘন্টা বসে থাকব। কিছু মনে করবেন না, নাশতা কি নিজেই বানাবেন?
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
জি না। ছকু দিয়ে যাবে।‘ ছকুটা কে? বিসমিল্লাহ রেষ্টুরেন্টের বয়। ‘ছকু নাশতা কখন দিয়ে যাবে?
‘হাত-মুখ ধুয়ে এসে উত্তর দিকের এই জানালাটা খুলে দেব। এটাই হল আমার সিগন্যাল। বিসমিল্লাহ রেষ্টুরেন্ট থেকে আমার ঘরের জানালা দেখা যায়। হৰু আমার ঘরের জানালা খােলা দেখে বুঝবে আমি হাত–মুখ ধুয়ে ফেলেছি। সে নাশতা নিয়ে চলে আসবে। পরােটা–ভাজি।
‘কিছু মনে করবেন না, আমি এখনই জানালাটা খুলে দি। আপনার হয়ে সিগন্যাল দিয়ে দি। নাশতা চলে আসুক। নয়ত নাশতার জন্যে আবার এক ঘট বসতে হবে। | ‘আগেভাগে জানালা খােলা ঠিক হবে না। আমার ঘরটা নর্দমার পাশে তাে— বিকট গন্ধ আসবে : আপনি নতুন মানুষ। আপনার অসুবিধা হবে।
শুধু রুমালে কাজ হবে না। গ্যাস মাস্ক পরতে হবে। | ভদ্রলােক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কিছু কিছু মানুষ আছে – সহজে বিম্বিত হয় না। তারা যখন বিস্মিত হয় তখন দেখতে ভাল লাগে। এই ভদ্রলােক মনে হচ্ছে সেই দলের। তার বিস্মিত দৃষ্টি দেখতে ভাল লাগছে। তাকে আরাে খানিকটা ভড়কে দিলে কেমন হয়?
ম্যানেজার সাহেব! আপনার নাম কি? রকিব! রকিবুল ইসলাম। ‘আপনি ভাল আছেন?
রকিবুল ইসলাম জুবাব দিলেন না । সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বােধহয় তার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান
‘ফাতেমা খালার ম্যানেজারী কতদিন হল করছেন?
বেশিদিন না, দুমাস।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
‘খালার অবস্থা কি? তার মাথা কি পুরােপুরি আউলা হয়ে গেছে না। এখনাে কিছু বাকি আছে?
‘কি বলছেন আপনি, মাথা আউলা হবে কেন?
গুপ্তধন পেলে মানুষের মাথা আউলা হয়। খালা গুপ্তধন পেয়েছেন । গুপ্তধন এখনাে আছে, না খরচ করে ফেলেছেন? | ম্যানেজার গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, ম্যাডাম সম্পর্কে আপনার সঙ্গে কোন আলােচনায় যেতে চাচ্ছি না। উনি আপনার খালা। উনার সম্পর্কে আপনি যা ইচ্ছা। বলতে পারেন। আমি পারি না।
আমি তার এমপ্লয়ী । আমার অনেক দায়িত্বের একটি হল তার সম্মান রক্ষা করা। হিমু সাহেব, আপনি অপ্রয়ােজনীয় কথা বলে সময় নষ্ট করছেন। আপনি বরং দয়া করে বাথরুমের লাইনে দাঁড়ান। উত্তরের। জানালা বােলার দরকার নেই। আমি বিসমিল্লাহ রেষ্টুরেন্টে গিয়ে ছক্কুকে নাশতা দিতে বলে আসছি।
ধন্যবাদ। আর আপনি যদি চান, আমি আপনার হয়ে লাইনে দাঁড়াতে পারি।
এই বুদ্ধিটা বারাপ না। আপনি বরং লাইনে দাঁড়ন। আমি চট করে রেষ্টুরেন্ট থেকে এক কাপ চা খেয়ে আসি। কোষ্ঠ পরিষ্কারের জন্যে বালি পেটে চায়ের কোন তুলনা নেই। কড়া এক কাপ চা। চায়ের সঙ্গে একটা আজিজ বিড়ি। ডাইরেক্ট একশান। কোষ্ঠের জগতে তােলপাড়। কোষ্ঠ মানে কি জানেন তাে? কোষ্ঠ মানে হচ্ছে গু। কোষ্ঠ কাঠিন্য মানে কঠিন গু।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
রকিবুল ইসলাম আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এরকম কঠিন চোখে অনেক দিন কেউ আমার দিকে তাকায়নি।
দোতলায় নেমে এলাম। মেসের কেয়ার টেকার হাবীব সাহেব (আড়ালে ডাকা হয় হাবা সাহেব। যদিও তিনি মােটেই হাবা না! চালাকের চূড়ান্ত। সুগার কুটেট কুইনাইনের মত হাবা কোটেট বুদ্ধিমান)। বললেন, “হিমু ভাই, আজকের কাগজ পড়েছেন?
আমি বললাম, ‘না।’
‘তয়াবহ ব্যাপার। আবার একটা ন’ বছরের মেয়ে রেপড হয়েছে। একটু দাঁড়ান, পড়ে শােনাই।’
এখন শুনতে পারব না। আপনি ভাল করে পড়ে রাখুন – পরে শুনে নেব। ‘মেয়েটার নাম মিতু। যাত্রাবাড়িতে বাসা। বাবা রিকশা চালায়।
ও আচ্ছা।
‘আমি একটা ফাইলের মত করছি । সব রেপের নিউজ কাটিং জমা করে রাখছি।
ভাল স্মছেন।
হাবা সাহেবের হাত থেকে সহজে উদ্ধার পাওয়া যায় না। ভাগ্য ভাল তাঁর হাত থেকে আজ সহজেই ছাড়া পাওয়া গেল। ভাগ্য একবার ভাল হওয়া শুরু হলে ভালটা চলতেই থাকে। অতি সহজে বাথরুমেও ঢুকে পড়তে পারলাম। মনের আনন্দে দু লাইন গানও গাইলাম –
“জীবনের পরম শ্ন করাে না হেলা হে গরবিনী ।”রবীন্দ্রনাথ কি কোনদিন ভেবেছিলেন তার গান সবচে বেশি গীত হবে বাথরুমে! এমন কোন বাঙালি কি আছে যে বাথরুমে ঢুকে দু লাইন গুণগুণ করেনি!
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
বাথরুমকে ছােট করে দেখার কিছু নেই। জগতের মহত্তম চিন্তাগুলি করা হয় বাথরুমে। আমি অবশ্যি এই মুহুর্তে তেমন কোন মহৎ চিন্তা করছি না। ফাতেমা খালার কথা ভাবছি—হঠাৎ খোঁজ করছেন, ব্যাপারটা কি?
ফাতেমা খালার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তিনি বেশ সহজ স্বাভাবিক মহিলাই ছিলেন। জর্দা দিয়ে পান খেতেন । আগ্রহ নিয়ে টিভির নাটক, ছায়াছন্দ এবং বাংলা সিনেমা দেখতেন। ম্যাগাজিন পড়তেন (তার ম্যাগাজিন পড়া বেশ অদ্ভুত। মাঝখানের পৃষ্ঠা খুলবেন। সেখান থেকে পড়া শুরু হবে।
খালা দুটা ভিডিও ক্লাবের মেম্বার ছিলেন। ক্লাব থেকে লেটেস্ট সব হিন্দী ছবি নিয়ে আসতেন। তাঁর ঘরের দু’জন কাজের মেয়েকে নিয়ে রাত জেগে হিশী ছবি দেখতেন। কঠিন কঠিন হিন্দী ডায়ালগ ওদের বুঝিয়ে দিতেন। অমিতাভ বচ্চন কেন দিলীপ কুমারের চেয়ে বড় অভিনেত— এই ধরনের উচ্চতর গবেষণা ওদের নিয়ে করতেন এবং ওদের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন।
তাঁর একটা অটোগ্রাফের খাতাও ছিল। বাইরে বেরুলেই সেই খাতা তাঁর সঙ্গে থাকত। যে কোন সময় বিখ্যাত কোন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। খাতা সঙ্গে না থাকলে সমস্যা। নিউ মার্কেটে একদিন রুটি কিনতে গিয়ে। আসাদুজ্জামান নূর সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি ফাতেমা খালাকে অটোগ্রাফ দিলেন – জয় হােক আসাদুজ্জামান নূর।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
আরেকবার এলিফ্যান্ট রােডে দেখা হল চিত্রনায়িকা মৌসুমীর সঙ্গে। মৌসুমী ম্যােম বােরকা পরে ছিলেন। তারপরেও ফাতেমা খালা তাকে চিনে ফেললেন । মৌসুমী ম্যাডামও অটোগ্রাফ দিয়েছেন – মানুষ হও মৌসুমী। খালার জীবন মােটামুটি সুখেই কেটে যাচ্ছিল। সমস্যা বাধালেন খালু সাহেব। তিনি ফট করে একদিন মরে গেলেন।
ফাতেমা খালার জীবনধারায় বিরাট পরিবর্তন হল। তিনি পুরােপুরি দিশাহারা হয়ে গেলেন। খালাকে দোষ দেয়া যায় না। যে কোন মানুষই দিশাহারা হত। কারণ ছােট খালুর মৃত্যুর পর দেখা গেল এই ভদ্রলােক কয়েক কোটি টাকা নানানভাবে রেখে গেছেন। ফাতেমা খালার মত ভয়াবহ খরুচে মহিলার পক্ষেও
এক জীবনে এত টাকা খরচ করার কোন উপায় নেই। | ছােট খালু মােহাম্মদ শফিকুল আমিন বিচিত্র মানুষ ছিলেন। ভদ্রলােককে দেখেই মনে হত মাথা নিচু করে বসে থাকা ছাড়া তিনি কোন কাজ করেন না। বসে থাকা ছাড়া তিনি আর যা করেন তা হচ্ছে গায়ের চাদর দিয়ে চশমার কাচ পরিষ্কার।
শীত এবং গ্রীষ্ম দুই সিজনেই তিনি গায়ে চাদর পরতেন সম্ভবত চশমার কাচ পরিষ্কারে সুবিধার জন্যে। মােহাম্মদ মুকাদ্দেস মিয়াকে দেখে কে বলবে তার নানান দিকে নানান ব্যবসা — ব্রিক ফিল্ড, স্পিনিং মিলের শেয়ার, এক্সপাের্ট-ইমপাের্ট, গারমেন্টসের ব্যবসা, ট্রান্সপাের্ট ব্যবসা।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
ব্যবসায়ী মানুষ মাত্রই উদ্বেগের ভেতর বাস করে। ঘুমের অষুধ খেয়ে রাতে ঘুমায়। পীর-ফকিরের কাছে যাতায়াত করে। হাতে রংবেরং-এর পাথরওয়ালা আংটি পরে। অল্প বয়েসেই তাদের ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, হাই ব্লাড প্রেসার হয়। সবচে বেশি যা হয় তার নাম গ্যাস ব্যবসায়ী মাত্রেরই পেট ভর্তি থাকে গ্যাস। মাঝারি টাইপের যে কোন ব্যবসায়ীর পেটের গ্যাস দিয়ে দুই বার্নারের একটা গ্যাস চুলা অনায়াসে কয়েক ঘন্টা জ্বালানাে যায়।
একমাত্র ছােট খালুকে দেখলাম গ্যাস ছাড়া। পেটে গ্যাস নেই, ব্যবসা নিয়ে কোন উদ্বেগও নেই। তাকে বেশির ভাগ সময়ই দেখেছি জবুথবু হয়ে বসে থাকতে। আগবাড়িয়ে কারাে সঙ্গে কথাও বলতেন না। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা এক বিয়েবাড়িতে। বিয়েবাড়ির হৈচৈ-এর মধ্যে তিনি এক কোণায় সােফায় পা উঠিয়ে বসে আছেন। মনে হল তার শীত করছে, কেমন গুটিসুটি মেরে বসা। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, খালু সাহেব কেমন আছেন?
তিনি নিচু গলায় বললেন, ‘ভাল।” ‘খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
তাহলে শুধু শুধু বসে আছেন কেন, চলে যান। তােমার খালার জন্যে বসে আছি। একটু দেখবে – ও যাবে কিনা। মনে হয় বিয়েবাড়ির মজা ফেলে যাবে।
আমি খালাকে খুঁজে বের করলাম। তিনি হতভম্ব গলায় বললেন, ‘পাগল! আমি এখনি যাব কি? খাওয়া-দাওয়ার পর গান-বাজনা হবে। গান শুনব না? তুই তাের খালুকে চলে যেতে বল । গাড়িটা যেন রেখে যায়। হিমু শােন, তুই একটা উপকার করবি? তাের খালুর সঙ্গে বাসায় চলে যা। আমার অটোগ্রাফের খাতাটা নিয়ে আয়। খাতা ফেলে এসেছ?
‘ই। মাঝে মাঝে এমন বােকামি করি যে ইচ্ছা করে নিজেকেই নিজে চড় মারি। চড় মেরে চাপার দাঁত ফেলে দেই।
‘বিয়েবাড়িতে বিখ্যাত কেউ এসেছে? | ‘তুই কি গাধা নাকি? দেখতে পাচ্ছিস না — জুয়েল আইচ সাহেব এসেছেন, উনার স্ত্রী বিপাশা আইচ এসেছেন। এরা কতক্ষণ থাকবেন কে জানে! তুই চট । করে অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে আয়। আমার ড্রেসিং টেবিলের উপর আছে। শুধু খাতা না, কলমও আনবি।’
আমি খালু সাহেবের সঙ্গে বাসায় গেলাম। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ফাতেমা খালার অটোগ্রাফের খাতা উদ্ধার করলাম। খালু সাহেব গুণে গুণে সাত টাকা দিয়ে দিলেন ফেরার রিকশা ভাড়া। আমাকে বললেন, রিকশাওয়ালা আট টাকা চাইবে। দরাদরি করলে সাত টাকায় রাজি হবে :
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
আমি কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে খালুর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা।’ পরদিন খালু সাহেবকে আমি চার টাকা ফেরত দিয়ে বললাম, ‘শেয়ারে রিকশা পেয়ে চলে গেছি। তিন টাকা নিয়েছে। আপনার চার টাকা বাঁচিয়ে দিলাম।
তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘ঐদিন গুণে গুণে সাত টাকা দিয়েছি বলে রাগ করেছ?
আমি বললাম, ‘না, রাগ করব কেন?
‘মনে হয় রাগ করেছ। রাগ না করলে এই চার টাকা ফেরত দিতে আসতে না। যাই হােক, তুমি কিছু মনে করাে না। হিসেব করে করে এই অবস্থা হয়েছে। সারাক্ষণ হিসেব করি । গাড়িতে যখন তেল ৩রি তখন হিসেব করি কতটুকু তেল
নিলাম । গাড়ি কতক্ষণ চলবে। এর আগে কবে তেল নিয়েছি। বুঝলে হিমু, আমি শান্তিমত পাঁচটা টাকাও খরচ করতে পারি না। ঐদিন কি হয়েছে শােন — গাড়ি করে যাচ্ছি মতিঝিল। শেরাটনের কাছে রেড লাইটে গাড়ি থেমেছে – ফুল বিক্রি করে একটা মেয়ে এসে ঘ্যানঘ্যান শুরু করল, ফুল নেন। ফুল নেন। আমি মুখ শক্ত করে বসে আছি। হঠাৎ দেখি আমার ড্রাইভার ওর পকেট থেকে ফস করে একটা দশ টাকার নােট বের করে মেয়েটাকে দিয়ে দিল। আমি হতভম্ব।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
‘ড্রাইভারের কাণ্ড দেখে খুশি হলেন? | ‘না। আমার মাথায় ঢুকে গেল, ড্রাইভার কি পয়সা মারছে? তেল চুরি করছে? নতুন টায়ার বিক্রি করে পুরান টায়ার লাগিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে? তা না করলে ফুলওয়ালীকে ফস করে দশ টাকার লেট দেয় কি করে?
‘আপনি ডাইভার ছাঁটাই করে দিলেন?
‘ঠিক ধরেছ। নতুন ড্রাইভার নিলাম। আমি অবশ্যি এম্নিতেই এক ড্রাইভার বেশিদিন রাখি না। চার মাসের বেশি কাউকেই রাখি না। ভাইভাররা শুরুতেই চুরি শুরু করে না। একটু সময় নেয়। আমি সেই সময় পর্যন্ত তাদের রাখি। তারপর বিদায়। সবই হচ্ছে আমার হিসেব। আমি বাস করি কঠিন হিসেবের জাতে।
‘তার জন্যে কি আপনার মন খারাপ হয়?’
‘না, মন খারপ হয় না। আমাকে তৈরিই করা হয়েছে এইভাবে — মন খারাপ হবে কেন? সাধু সন্ত মানুষ কি মন খারাপ করে — কেন তারা সাধু প্রকৃতির হল? না করে না। কারণ তাদের মানসিক গড়নটাই এমন। আমার। বেলাতেও তাই। এই যে তুমি হিমু সেজে পথে পথে ঘুরে বেড়াও – তােমার কি মন খারাপ হয়?
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
‘কফি খাবে?” ‘কফিও নিশ্চয়ই আপনার হিসেব করা। আমি খেলে কম পড়বে না?”
না, কম পড়বে না, খাও। কফি খেতে খেতে তােমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি।’
ছােট খালু নিজেই কফি বানালেন টিনের কৌটা খুলে বিসকিট বের করলেন। কেক বের করলেন। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন, ‘অলসারের মত হয়েছে, ডাক্তার শুধু চা কিংবা কফি খেতে নিষেধ করেছে। গরু ছাগলের মত সারাক্ষণই কিছু খাই।’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘নিজের জন্যে এক্সট্রা খরচ করতে হচ্ছে – এই জন্যে মনটা সব সময় খচখচ করে?”
খালু সাহেব লজ্জিত মুখে বললেন, ‘হ্যা, করে।
আহা খালু সাহেব, আপনার ঠিক কত টাকা আছে বলুন তাে?” তেমনভাবে হিসেব করিনি। ভালই আছে। ‘ভালই মানে কি? ‘বেশ ভাল। ‘কোটির উপর হবে?”
তা তাে হবেই।
একটা মানুষের কোটির উপর টাকা আছে, সে নির্বিকার ভঙ্গিতে কফি বনাঙ্গে তেবেই আমার শীত শীত করতে লাগল। অবশ্যি আজ এম্নিতেই শীত।
কোন্ড ওয়েভ। শীতটা টের পাচ্ছিলাম না। এখন পাচ্ছি।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
খালু সাহেব চলুন একটা কাজ করি। এক রাতে আমরা দু’টা ফিফটিন সিটার মাইক্রোবাস তাড়া করি। বাস ভরতি থাকবে কম্বল। শীতের রাতে আমরা শহরে ঘুরব— যেখানেই দেখব খালি গায়ে লােকজন শুয়ে আছে— ওমি দূর থেকে তাদের গায়ে একটা কম্বল ছুঁড়ে দিয়েই লাফ দিয়ে মাইক্রোবাসে উঠে পালিয়ে যাব। যাকে কম্বল দেয়া হয়েছে সে যেন ধন্যবাদ দেয়ার সুযােগও না পয়?
‘কাজটা কি জন্যে করব, সােয়াবের জন্যে? বেহেশতে যাতে হুরপরী পাই?”
না সােয়াৰ-টোয়াব না, হঠাৎ দামী কম্বল পেয়ে লােকগুলির মুখের ভাব দেখে মজা পাওয়া। আপনার জীবনে নিশ্চয়ই মজার অংশ খুব কম। যাদের জীবনে মজার অংশ কম তারা অন্যদের মজা দেখে আনন্দ পায়। দুধের স্বাদ তাতের মাড়ে মেটানাের মত।
খালু সাহেব সিগারেট ধরালেন। শান্ত মুখে সিগারেট টান দিচ্ছেন, কিছু বলছেন না। আমি কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। ছােট খালু আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে। বাস ভর্তি কম্বল দেয়া যাক। কবে দিতে চাও?
‘পুরােটাই তাে আপনার উপর। আপনি যে রাতে ঠিক করবেন, সেই রাতেই যাব। চলুন আজই যাই।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
‘আজ না, তুমি আগামী সােমবারে এসে। রাত নটার দিকে চলে এসাে। এক সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে বের হয়ে পড়ব। রাত বারােটার দিকে বের হব।
‘ঠিক আছে। ‘আমি কম্বল কিনিয়ে রাখব। হাজার পাচেক কম্বল কিনলে হবে না?
হিমু-২
‘অবশ্যই হবে। কম্বল দিয়ে একবার যদি মজা পেয়ে যান তাহলে আপনি কম্বল দিতেই থাকবেন। কে জানে আপনার নামই হয়ত হয়ে যাবে শফিকুল আমিন কম্বল।
বালু সাহেব আমার রসিকতা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিচুগলায় বললেন, ‘কম্বল দেয়া যেতে পারে। আমার যে মাঝে মাঝে দিতে ইচ্ছা করে না, তা না।
কেন জানি শেষ পর্যন্ত দেয়া হয় না। | সােমবার রাত বারােটায় তাঁর কম্বল নিয়ে বেরুবার কথা, উনি মারা গেলেন শনিবার সকাল দশটায়। অফিসে যাবার জন্যে কাপড় পরেছেন, ফাতেমা খালাকে বললেন, ‘একটা সুয়েটার দাও তাে। ভাল ঠাণ্ডা লাগছে, শুধু চাদরে শীত মানছে।’
খালা রান্নাঘরে রান্না করছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমার হাত বন্ধ, তুমি নিজে খুঁজে নাও। আলমিরায় আছে। নিচের তাকে দেখ।”
খালু সাহেব নিজেই সুয়েটার খুঁজে বের করলেন। স্যুয়েটার পরলেন না। হাতে নিয়ে খাবার ঘরে বসে রইলেন। ফাতেমা খালা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘কি ব্যাপার, তুমি অফিসে যাওনি?
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১
‘শরীরটা ভাল লাগছে না। দেখি এক কাপ লেবু চা দাও তাে। ‘স্যুয়েটার হাতে নিয়ে বসে আছ কেন? ‘পরতে ইচ্ছা করছে না। অাঁস ফাঁস লাগছে।’
ফাতেমা খালা আদা চা বানিয়ে এসে দেখেন খালু সাহেব কাত হয়ে চেয়ারে পরে আছেন। ক্রীম কালারের সায়েটারটা তার পায়ের কাছে পরে আছে। প্রথম দেখায় তার মনে হল- মানুষটা বুঝি ক্লান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে।
আমি সকাল বেলাতেই খবর পেলাম – ঠিক করলাম একটু রাত করে খালাকে দেখতে যাব। সন্ধ্যার মধ্যে চিৎকার, কান্নাকাটি থেমে যাওয়ার কথা। যে বাড়িতে মানুষ মারা যায় সে বাড়িতে মৃত্যুর আট থেকে ন’ ঘন্টা পর একটা শান্তি শান্তি ভাব চলে আসে। আত্মীয়-স্বজনরা কান্নাকাটি করে চোখের পানির স্টক। ফুরিয়ে ফেলে। চেষ্টা করেও তখন কান্না আসে না।
তবে বাড়ির সবার মধ্যে দুঃখী দুঃখী ভাব থাকে। সবাই সচেতনতাবেই হােক বা অবচেতনভাবেই হােক — দেখাবার চেষ্টা করে মৃত্যুতে সে-ই সবচে বেশি কষ্ট পেয়েছে। মূল দুঃখের চেয়ে অভিনয়ের দুঃখই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র ব্যতিক্রম সন্তানের মৃত্যুতে মায়ের দুঃখ। যে বাড়িতে মায়ের কোন সন্তান মারা যায় সে বাড়িতে আমি এখনই যাই না। সন্তান শােকে কাতর মায়ের সামনে দাঁড়ানাের ক্ষমতা হিমুদের দেয়া হয়নি।
Read More