হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-২

কাতর মায়ের সামনে দাঁড়ানাের ক্ষমতা হিমুদের দেয়া হয়নি। 

আমি রাত নটার দিকে ফাতেমা খালার বাড়িতে উপস্থিত হলাম। বাড়ি ও মানুষ। ফাতেমা খালা নাকি এর মধ্যে কয়েকবার অজ্ঞান হয়েছেন। এখন এ সুস্থ। ডাক্তার রিলাক্সেন খেয়ে অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকতে বলেছে। তিনি তার শােবার ঘরে শুয়ে আছেন। সেই ঘরে কারাের যাবার হকুম নেই।

হিমুর রূপালী রাত্রি 

বকুম ছাড়াই আমি শােবার ঘরে ঢুকে গেলাম। খালা আমাকে দেখে হেচকি মত শব্দ তুলে বললেন, ‘হিমু রে, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল রে। লেবু চা খেতে চেয়েছিল – বুঝলি। ঘরে লেবু ছিল না বলে আদা চা বানিয়ে নিয়ে গিয়ে দেখি এই অবস্থা। নড়ে না, চড়ে না, চেয়ারে কাত হয়ে আছে। মানুষটার 

শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হল না। সামান্য লেবু চা, ৩াও খেতে পারল না। 

‘ঘরে লেবু ছিল না?” 

বুঝলি হিয়, আসলে ছিল। পরে আমি ফ্রিজের দরজা খুলে দেখি ভেজা ন্যাকা দিয়ে মুড়ানাে চার-পাঁচটা কাগজি লেবু। 

ভেজা ন্যাকরা দিয়ে মুড়ানাে কেন? 

কাজের মেয়েটা যে আছে জাহেদার মাসে কি যে বােকা তুই চিন্তাও করতে পারবি না। তাকে একবার বলেছিলাম, পান ভেজা ন্যাকরা দিয়ে মুড়ে রাখতে। এর পর থেকে সে করে কি, যা-ই পায় ভেজা ন্যাকরা দিয়ে মুড়ে রব। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-২

খালা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে বসলেন। আমি এখন স্বস্তি বোেধ করছি। খালাকে মৃত্যুশােক থেকে বের করে কাজের মেয়ের সমস্যায় এনে ফেলে দেয়া হয়েছে। 

‘হিমু শােন, এই মেয়েটা আমাকে যে কি যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে তুই কনাও করতে পারবি না। মাঝে-মধ্যে ইচ্ছা করে ওর গায়ে এসিড ঢেলে ই।” 

‘সে কি? ‘তাের খালু মারা গেছে সকাল দশটায় । এগারােটা থেকে লােকজন আসতে 

করেছে। আর তখন জাহেদার মা শুরু করেছে কান্না। আছাড় পিছাড় কান্না। বাড়িঘর ভেঙ্গে পড়ে যায় এমন অবস্থা। আমি তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে 

লাম, খবর্দার, চোখের পানি, চিৎকার সব বন্ধ। আরেকটা চিৎকার যদি করিস গলা টিপে মেরে ফেলব। 

‘কেন? | ‘আরে বুঝিস না কেন তার কান্নাকাটি দেখে লােকজন ভাববে না বাড়ির বুয়া এত কাঁদে কেন? রহস্যটা কি? তার উপর মেয়েটা দেখতে ভাল। শরীর স্বাস্থ্যও ভাল। ভারী বুক, ভারী কোমর। মাথার চুলও লম্বা। চুলে গােপনে 

গােপনে শ্যাম্পু দেয়। আমার শ্যাম্পুর বােতল ফাঁক করে দেয়। এত সাজগােজ লােকজন উল্টাপাল্টা ভাবতে পারে না?” 

‘তা তাে পারেই। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-২

‘এইসব কথা তাে কাউকে বলতেও পারি না। তুই এসেছিস, তােকে বলে মনটা হালকা হল। চা খাবি?’ 

না। | ‘খা এক কাপ চা। তাের সঙ্গে আমিও খাই। যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। আমি তাে আর এই অবস্থায় চা দিতে বলতে পারি না। সবাই বলবে স্বামীর লাশ কবরে নামিয়েই চা কফি খেয়ে বিবিয়ানা করছে। ভাঙ্গা দরজারও ছিটকিনি আছে। মানুষের মুখের তাে আর ছিটকিনি নেই। তুই যা, চায়ের কথা বলে আয়। 

চা খেতে খেতে খালা পুরােপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। কোথায় শােক, কোথায় কি? সব জলে ভেসে গেল। 

বুকলি হিমু, তোর সঙ্গে কথা বলে আরাম আছে। তুই যে কোন কথা সহজভাবে নিতে পারিস, বেশির ভাগ মানুষ তা পারে না। একটা সাধারণ কথার দশটা বাঁকা অর্থ বের করে। এখন থেকে তুই আমাকে পরামর্শ দিবি, বুঝলি। তাের পরামর্শ আমার দরকার। 

“কি পরামর্শ? ‘তাের খালু মেলা টাকা রেখে গেছে। বিলি ব্যবস্থার ব্যাপার আছে। ‘কত রেখে গেছেন? 

নি না । আন্দাজ করতে পারছি। ভয়ে আমার হাত-পা পেটে ঢুকে যাচ্ছেরে হিমু। 

‘টাকাওয়ালা মানুষের দিকে সবার নজর। তাছাড়া আমি মেয়েমানুষ। তাের খালুর আত্মীয়-স্বজনরা এখন সব উদয় হবে। মড়া কান্না কাঁদতে কাঁদতে আসবে। তারপর সুযােগ বুঝে হায়েনার মত খুবলে ধরবে।’ 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-২

‘তুমি বড় হায়েনা হয়ে হাহা করে এমন হাসি দেবে যে হাসি শুনে ওরা পালাবার পথ পাবে না।’ | ‘রসিকতা করিস না। সব দিন রসিকতা করা যায় না। এই বাড়িতে আজ একটা মানুষ মারা গেছে— এটা মনে রাখিস। এখনাে কবরে নামেনি। আচ্ছ’ শােন— কুখানির একটা ভাল আয়ােজন করা দরকার না?” 

 ‘অবশই দরকার। এমন খাওয়া আমরা খাওয়া যে সবার পেটে অসুখ হয়ে যাবে। পরের এক সপ্তাহ ওরস্যালাইন খেতে হবে। 

খালা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘হিমু, তুই আবার ফাজলামি শুরু করেছিল। মেকে অসহ্য লাগছে। একটা মৃত মানুষের জন্যে তাের সম্মান থাকবে না? তুই কি মানুষ? 

‘ঠিক জানি না খালা। আমি কি তা পরে সবাই মিলে ঠিক করলেই হবে। আপাতত এসে কুলখানির মেনু ঠিক করি। তুমি কি খেতে চাও

আমি কি খেতে চাই মানে? ফাজিল বেশি হয়েছিস। ধরাকে সরা জ্ঞান করসি আমার সঙ্গে রসিকতা। তুই এক্ষুনি বিদেয় হ। এই মুহূর্তে। চলে যাব?

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-২

 খালা রাগে জ্বলতে জ্বলতে বললেন, ‘অবশ্যই চলে যাবি। আমি কি খেতে চাই জিজ্ঞেস করতে তাের মুখে বাধল না? শােন হিমু, আর কোনদিন তুই এ বাড়িতে আসবি না। 

আমি খুবই সহজভাবে বললাম, ‘তুমি ডাকলেও আসব না?” 

খালা তীব্র গলায় বললেন, ‘না, আসবি না। তাের জন্যে এ বাড়ির দরজা বন্ধু। বাবার মত বসে আছিস কেন? চলে যেতে বললাম, চলে যা। 

আমি চলে এলাম। খালা আর ডাকলেন না, আমিও গেলাম না। 

দু’বছর হয়ে গেল। ফাতেমা খাল কাঁটায় কাঁটায় দু’বছর পর ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি আবারাে যাচ্ছি। তার মধ্যে কি পরিবর্তন দেখব কে জানে। ম্যানেজার সাহেবকে দেখে শংকিত বােধ করছি। মনে হচ্ছে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখতে পাব ? কে জানে, হয়ত দেখব শাড়ি ফেলে দিয়ে স্কার্ট টপ ধরেছেন। চুল বব করিয়ে ফেলেছেন : মাথার সাদা চুলে আগে মেন্দি দিলে। এখন সম্ভবত ব্লিচ করাচ্ছেন। 

ম্যানেজার সাহেব। 

ফাতেমা খালা – আপনার ম্যাডাম আছেন কেমন? 

ভাল আছেন। গ্যাসের প্রবলেম হচ্ছে, চিকিৎসার জন্যে শিগরিই সিঙ্গাপুর যান। 

গ্যাসের প্রবলেম মানে কি? পেটে গ্যাস হচ্ছে? 

খুবই দুঃসংবাদ। মেয়েদের পেটে গ্যাস একেবারেই মানায় না। গ্যাসের অন্য সিঙ্গাপুর যেতে হচ্ছে? 

‘গ্যাসটাকে তুচ্ছ করে দেখবেন না। গ্যাসের প্রবলেম থেকে অন্যান্য মেজর প্রবলেম দেখা দেয়। গ্যাস বেশি হলে উপরের দিকে ফুসফুসের ডায়াফ্রেমে চাপ দেয়, হার্টের ফাংশানে ইন্টারফেয়ার করে । 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-২

আমি বিস্মিত গলায় বললাম, ভাই আপনি তাে মনে হচ্ছে জ্ঞানী ম্যানেজার। ডাক্তারীও জানেন। 

ভদ্রলােক আমার রসিকতা পছন্দ করলেন না। গম্ভীর হয়ে গেলেন। সারা পথে তার সঙ্গে আমার আর কোন কথাবার্তা হল না। এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে ছিলাম ম্যানেজার সাহেব কঠিন গলায় বললেন, ‘গাড়িতে এসি চলছে। সিগারেট ফেলে দিন। 

আমি বড়ই সুবােধ ছেলে হয়ে গেলাম। সিগারেট ফেলে দিলাম। 

ফাতেমা খালাকে দেখে আমি ছােটখাট একটা চমক খেলাম। স্কার্ট টপ না, তিনি সাধারণ শাড়ি-রাউজই পরে আছেন। সাধারণ মানে বেশ সাধারণ সুতি শাড়ি। হালকা সবুজ রঙে সাদা সুতার কাজ করা। তার পরেও তাঁকে দেখে চমকাবার কারণ হচ্ছে তাঁকে খুক খুক দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে দশ বছর বয়স। কমে গেছে। মূব হাসি হাসি। পান খেয়েছেন বলে ঠোট লাল হয়ে আছে। সারা শরীরে সুখী সুখী ভাব। চোখে সােনালি ফ্রেমের চশমা। 

খালা বললেন, ‘হা করে কি দেখছিস?” ‘তােমাকে দেখছি। তােমার ব্যাপারটা কি? “কি ব্যাপার জানতে চাস?” ‘তােমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ‘মেন দেখাচ্ছে? 

খুকী খুকী দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে দশ বছর বয়স কমিয়ে ফেলেছ।” ‘ফাজলামি করিস না হিমু। 

‘ফাজলামি করছি না। আমার এই হলুদ পাঞ্জাবীর শপথ, তােমাকে দেখে মনে হচ্ছে তােমার বয়স কুড়ি বছর কমেছে। 

একটু আগে তাে বললি দশ বছর কমেছে। শুরুতে দশ বছর মনে হচ্ছিল — এখন মনে হচ্ছে কুড়ি । ব্যাপারটা কি?” 

খালা আনন্দিত গলায় বললেন, ‘ফুড হেবিট চেঞ্জ করেছি। এখন এক বেলা ভাত খাই। শুধু রাতে। তাও গাদা খানিক খাই না, চায়ের কাপের এক কাপ ভাত। আতপ চালের ভাত। দিনে শাকসজি, ফলমূল খাই। সেই সঙ্গে ভিটামিন। কি ভিটামিন?

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৩

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *