হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৪

‘তুই পাশ করবি। তাের কাজই তাে পথে পথে ঘােরা। আর ইয়াকুব লােকটা খুব সম্ভব পথে পথেই থাকে। 

‘যদি পাই কি করব? কানে ধরে তােমার কাছে নিয়ে আসব?

হিমুর রূপালী রাত্রি 

‘আমার কাছে আনতে হবে না। খবর্দার আমার কাছে আনবি না। তুই ত’র সঙ্গে গল্পগুজব করবি। 

‘ইয়াকুব সাহেবকে খুঁজে বের করে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করব, এই আমার কাজ? 

খালা আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। কি ধরনের গল্পগুজব করব? দেশের রাজনীতি? যসিনা-খালেদা সংবাদ? 

খালা ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দাঁড়া, তােকে পুরাে ব্যাপারটা খুলে বলি। পুরাে ঘটনা না শুনলে তুই গুরুত্বটা বুঝবি না। আমাকে কথা দে যে দ্বিতীয় কেউ জানবে না। কসম কাট। 

‘কসম কাটছি কেউ জানবে না।’ ‘এইভাবে কেউ কসম কাটে? তাের কোন প্রিয় মানুষের নামে কসম কাট। 

তামান্নার কসম। দ্বিতীয় কেউ জানবে না।’ 

খালা অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বললেন, তাের সবকিছু নিয়ে ফাজলামিটা আমার অসহ্য লাগে । তােকে খবর দিয়ে আনাই ভুল হয়েছে। তামান্নার নামে কসম কাটছিস কোন হিসেবে? ও তাের অতি প্রিয়জন হয়ে গেল? 

‘তুমিও আমার অতি প্রিয়। তােমার নামে কসম কাটব?” 

থাক কসম কাটতে হবে না। ঘটনাটা শােন – তােকে আল্লাহর দোহাই 

লাগে কেউ যেন না জানে। 

কেউ জানবে না খালা। আপনি নিশ্চিন্ত মনে বলুন। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৪

দরজা ভেজানােই ছিল। খালা উঠে গিয়ে লক করে দিলেন। এতেও তার মন ভাল না। তিনি আবার দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে আবার দরজা বন্ধ করলেন। চেয়ার টেনে আমার কাছে নিয়ে এলেন। গলার স্বর আরাে নামিয়ে ফেললেন, ‘তাের খালুজান ছিল খুব বেষয়িক মানুষ।

তার বিলি-ব্যবস্থা, হিসাব-নিকাশ খুব পরিষ্কার। তার মৃত্যুর পর টাকা-পয়সার কি করতে হবে না করতে হবে সব সে লিখে গেছে। উকিলকে দিয়ে সাক্ষি- সাবুদ দিয়ে উইল করে গেছে। সেই উইল ঘাটতে গিয়ে দেখি সর্বনাশ ইয়াকুব নামের এক লােককে সে মালীবাগের বাড়ি আর নগদ দশ লাখ টাকা দিয়ে গেছে। 

 ‘সে কি, কেন?” | ‘আমারাে তে সেটাই প্রশ্ন— কেন? তাের খালুজানের কাছে সারাজীবনে একবার তার নাম শুনলাম না কোথাকার কোন ইয়াকুব —তাকে বাড়ি আর দশ লাখ টাকা। তাের খালুর কি ভীমরতি হয়েছে। 

‘ভীমরতিফতি খালুজানের হবে না।’ 

‘ঠিক বলেছিস সে ঐ টাইপের ন । টাকা যখন দিয়েছে তখন কোন কারণেই দিয়েছে। 

এ লােককে খুঁজে বার কর তোমার জন্যে খুব বােকামি হবে। ও আসবে বাড়ি আর নগদ টাকা নিয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাবে। তিনি ভিডি ভিসি।। 

গাধার মত কথা বলিস না তাে হিমু। বাড়ি আর টাকা নেয়া অত সহজ আমি শুধু জানতে চাই তাের খালুজানের সঙ্গে লােকটার সম্পর্ক কি ছিল? আমার ধারণা ফিসফাস কোন ব্যাপার?” 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৪

‘ফিসফাস ব্যাপার মানে? ফিসফাসটা কি?” ‘মেয়েঘটিত কিছু।’ 

কিছুটা কি?” ‘সেটা কি আর আমি জানি নকি? 

‘খালুজান যেমন মানুষ তাঁর তেমন ভীমরতি হওয়া সম্ভব না, তেমনি ফিসফাস হওয়াও সম্ভব না। 

পুরুষ মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব । পুরুষ জাতি বড়ই আজব জাতি। ‘তাহলে আমার কাজ হচ্ছে ইয়াকুবকে খুঁজে বের করে তার পেটের ভেতর থেকে গল্প টেনে বের করে নিয়ে আসা। 

পারবি না? ‘ইয়াকুব সাহেবকে খুজে বের করতে পারলে পারব।” 

‘বুঝলি হিমু, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন দিয়ে লোেকটাকে পাওয়া যেত, কেন বিজ্ঞাপন দিচ্ছি না— বুঝতেই পারছিস।” 

তা পরছি।” ‘তুই এই উপকারটা আমার কর। লােকটাকে খুঁজে বের কর । আমি তােকে খুশি করে দেব। 

আচ্ছা। খুঁজে বের করতে পারবি না? মনে হয় পারব।” ‘কিভাবে খুজবি?” 

‘রাস্তায় রাস্তায় হাঁটব সন্দেহজনক কাউকে দেখলে জিজ্ঞেস করব, স্যার। আপনার নাম কি ইয়াকুব? নাম যদি ইয়াকুব না হয় তাহলে আমার কোন কথা নেই। আর নাম যদি ইয়াকুব হয় তাহলে আমার একটা কথা আছে। কথাটা হচ্ছে আপনার পিতার নাম কি? 

“হিমু‘কি খালা? | ‘তুই তাে মনে হয় আমার সঙ্গে ইয়ারকি করছিস। তােকে ইয়ারকি করার জন্যে আমি ডাকিনি। আমি খুব ভাল করে জানি ইয়াকুব নামের লােকটাকে খুঁজে বের করা তাের কাছে কোন ব্যাপার না। ইচ্ছা করলে তুই তিন দিনের মাথায় লােকটাকে বের করে ফেলবি। এই জন্যেই তােকে ডাকিয়েছি।” 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৪

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’ ‘তুই লােকটাকে খুঁজে বের কর। আমি কথা দিচ্ছি তােকে খুশি করে দেব।’ 

‘আমি তাে সব সময় খুশি হয়েই আছি। তুমি এরচে বেশি খুশি কি করে করবে 

‘বললাম তাে তােকে খুশি করব। কিভাবে করব সেটা তখন দেখবি। 

আজ তাহলে বিদায় হই খালা? ‘আচ্ছা য। 

‘স্যান্ডেল চশমা এইসব রেখে যাই? তামান্নার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা যখন হবে তখন পরব। খালি পায়ে হেঁটে অত্যাস হয়ে গেছে। সান্ডেল পায়ে পথে 

নামলে হমড়ি খেয়ে চলন্ত ট্রাকের সামনে পড়ে যেতে পারি। তেমন কিছু ঘটলে ইয়াকুব সাহেবের সন্ধান পাবে না। সেটা ঠিক হবে না। | ‘তাের যা ইচ্ছা কর। তাের কথাবার্তা একনাগাড়ে শােনা অসম্ভব ব্যাপার। তুই যে কি বলিস না বলিস তা বােধহয় তাের নিজেরাে জানা নেই। 

আমি স্যান্ডেল, চাদর, চশমা রেখে খালার বাড়ি থেকে বের হলাম। গেটের দারােয়ান সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আচ্ছা, এই দারােয়ানের নাম। ইয়াকুব না তাে? বাঘের ঘরে ঘােগের বাসা। অনুসন্ধান খালার বাড়ির গেট থেকেই শুরু হােক। দারােয়ানের বয়স চল্লিশের উপরে। কাজেই তাকে সন্দেহভাজনদের তালিকায় রাখা যেতে পারে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। দারােয়ানের কাছে এগিয়ে এসে বললাম, ‘কে ইয়াকুব না? ইয়াকুব কেমন আছ? ভাল? 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৪

 দারােয়ান থতমত খেয়ে বলল, ‘স্যার আমার নাম কালম। 

ও আচ্ছা, কালাম তােমার চেহারা অবিকল ইয়াকুবের মত। সেই রকম নাক, সেই রকম মুখ। তােমার চোখও ইয়াকুবের মতই ট্যারা। ভাল কথা, ইয়াকুব নামে কাউকে চেন?” 

‘জেনা।” ‘না চেনাই ভাল। ডেনজারাস লােক। 

আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুচ্ছি। দারােয়ানের বিস্ময় এখনাে কাটছে না। সে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা, বিস্ময় নামক মানবিক আবেগ কত ধরনের হতে পারে? কি কি কারণে আমরা বিস্মিত হই

অন্যের বােকামি দেখে বিস্মিত হই। অন্যের বুদ্ধিমত্তা দেখেও বিস্মিত হই। 

এখানেও সমস্যা আছে। যে মহাবােকা সে অন্যের বােকামি দেখে বিস্মিত হবে না। সে সেটাই স্বাভাবিক ধরে নেবে। বিজ্ঞানীদের উচিত বিস্ময় ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা করা । বিস্ময় মিটার জাতীয় যন্ত্র বের করে ফেলা। যে যন্ত্র মানুষের চোখের পলকে বিষয় মেপে ফেলবে। বিস্ময় মাপা হবে এক থেকে দশের মধ্যে। লগারিদমিক স্কেলে । দশ হবে বিস্ময়ের সর্বশেষ সীমা। একজন মানুষের জীবনে মাত্র দু’বার বিস্ময় মিটারের সর্বশেষ মাপ দশে উঠবে। 

প্রথমবার হবে যখন সে মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হবে। পৃথিবী দেখে বিশ্বয় দশ। আর শেষবার আবারাে বিস্ময় মিটারের মাপ দশ হবে যখন সে মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়াবে। পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করবে, সে হতভম্ব হয়ে ভাববে— কি হতে যাচ্ছে? একি, আমি কোথায় যাচ্ছি? 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৪

যারা খুব ভাগ্যবান মানুষ তাদের কেউ কেউ এক জীবনে বিস্ময় মিটার আরাে এক দু’বার হয়ত দশ স্কোর করবেন। নেইল আর্মস্ট্রং যখন চাঁদে নামলেন তখন তিনি দশ স্কোর করলেন। 

টমাস আলভা এডিসন ফনােগ্রাফ আবিষ্কার করলেন। এমন এক যন্ত্র যা মানুষের কথা বন্দি করে ফেলতে পারে। আসলেই তা পারে কিনা তা পরীক্ষার জন্যে নিজেই যন্ত্রের সামনে বসে বিড়বিড় করে একটা ছড়া বললেন – 

Mary had a little lamb 

Its fleece was as white as snow And every where that Mary went

That lamb was sure to go. | ছড়া শেষ করে উত্তেজনায় কপালের ঘাম মুছলেন। তার গলার শব্দ। আসলেই কি যন্ত্রটা বন্দি করতে পেরেছে? তিনি যন্ত্র চালু করলেন – যন্ত্রের ভেতর থেকে শব্দ আসতে লাগল – 

Mary had a little lamb সেদিন বিস্ময় মিটার ফিট করে রাখলে টমাস আলভা এডিসনের বিস্ময় দশ বা দশের কাছাকাছি হত । 

আচ্ছা আমি এইসব কি ভাবছি? মূল দায়িত্ব পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। আমাকে ইয়াকুব সাহেবের সন্ধান করতে হবে। রশি ফেলে তার পেটের ভেতর থেকে কথা বের করে নিয়ে আসতে হবে। 

পাজেরাে একটা জীপ রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছে । জীপের মালিক বিরসমুখে বসে আছে। বিরসমুখের কারণ গাড়ির চাকার হাওয়া চলে গেছে। ডাইভার চাকা বদলাচ্ছে। আচ্ছা পাজেরাের মালিকের নাম কি ইয়াকুব হতে পারে ? আমি কেন ধরে নিচ্ছি ইয়াকুব লােকটা হবে হতদরিদ্র? সে বিত্তশালীও তাে হতে পারে। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৪

আমি ভদ্রলােকের কাছে এগিয়ে গেলাম । তদ্রলােক তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে খানিকটা সন্দেহও আছে। পাজেরাের মালিকরা সবার দিকে খানিকটা সন্দেহ নিয়ে তাকান। ‘স্যার কিছু মনে করবেন না, আপনার নাম কি ইয়াকুব?” 

কোন জবাব আসছে না। আমি হাসিমুখে বললাম, ‘স্যার আপনার যে জাইকার তার নাম কি? বাই এনি চান্স ইয়াকুব না তাে? আমি ইয়াকুবের সন্ধানে বের হয়েছি। আমাকে একটু সাহায্য করুন।। 

I need your friend help.’ পাগলদের দিকে মানুষ যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, ভদ্রলােক সেই দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এতক্ষণ তার চোখ ভর্তি ছিল সন্দেহ’ এখন সেই সন্দেহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়। তিনি দ্রুত গাড়ির কাচ উঠাচ্ছেন। গাড়ির কাছে নাক চেপে ভদ্রলোেককে ভেংচি কাটলে কেমনে হয়। তয়ে তার নিশ্চয়ই পিলে চমকে যাবে। পাজেরাের মালিকরা ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে আমার মত নিরীহ পথচারীকে ভয় দেখান।

কাজেই সুযােপ মত তাদেরকেও ছােটখাট ভয় দেখাবার অধিকার আমার আছে। আমি গাড়ির কাচে নাক চেপে জিত বের করে সাপের মত এদিক-ওদিক করতে লাগলাম এবং ঘেঁষ ঘেষ জাতীয় শব্দ করতে লাগলাম। পাজেরাে মালিক ভয়ে এবং আতংকৈ কেমন জানি হয়ে গেছেন। তার সঙ্গে নিশ্চয়ই মােবাইল ফোন নেই। থাকলে পুলিশকে খবর দিতেন। 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৫

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *