হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৬

ছেলেটাকে একটা লেগাে সেট উপহার দেব। জামানের বােন ভাল আছে তাে? 

‘তামান্নার কথা বলছিস? 

হিমুর রূপালী রাত্রি

 ‘আশ্চর্য, এখনো তাের মাথায় তামান্না আছে? আমি তাে ভেবেছি সব ভুলে বসে আছিস। তাের যা নেচার। তােকে তাে আমি আজ থেকে চিনি না। যাই হােক, তুই তামান্নার ব্যাপারে ভাবিস না। আমি সব ব্যবস্থা করব। আমি তামান্নাকে কিছু হিস দিয়েছি। সরাসরি তাের কথা বলিনি— ঘুরিয়ে বলেছি। ও দেখি খুবই লজ্জা পাচ্ছে। 

‘অতিরিক্ত লজ্জার জন্যে আবার পিছিয়ে পড়বে না তাে? ‘পিছিয়ে যাবে কোথায় – আমি এমন চাল চালব!’ 

খালা ব্যাংক। ‘তাের পরিবর্তন দেখে আমি খুবই অবাক হচ্ছি। শােন হিমু, তাের জীবনটা আমি বদলে দেব। আমার ফার্মে তােকে চাকরি দেব।” 

‘সট-টাই পরতে হবে? 

পরতে হলে পরবি। স্যুট-টাই কি খারাপ? তাের হলুদ পাঞ্জাবীর চেয়ে তাল।’ 

| তােমার মাথার যন্ত্রণা এখন একটু কম না? 

‘হা কম। সকালে তাে মাথা তুলতে পারছিলাম না এমন অবস্থা। তুই ইয়াকুবের খোঁজ পেলেই আমাকে জানাবি। আমি ঘুমিয়ে থাকলে ঘুম থেকে ডেকে তুলবি। 

‘আচ্ছা, খালা একটা কথা —ইয়াকুব লােকটা দেখতে কেমন তা কি জান? মােটা না রােগ, লম্বা না বেঁটে? 

“কিছুই জানি না। | না জানলেও অসুবিধা নেই। দু’একদিনের মধ্যেই জানা যাবে লােকটা কেমন। আজও জানা যেতে পারে। কুড়ি হাজার টাকা ক্যাশ দিয়াে খালা। ক্ৰশড চেক দিলে বিরাট সমস্যা হবে। আমার ব্যাংকে একাউন্ট নেই।” 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৬

একটা টেলিফোন করলে বালে পড়ার সম্ভাবনা। আমি আবার সাঁতার জানি । কাজেই বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় টেলিফোন করলাম। তামান্নার ব্যাপারটা রূপাকে জানানো দরকার। আজকাল রূপাকে টেলিফোনে ধরা সমস্যা হয়েছে। প্রথম একজন কাজের লােক টেলিফোন ধরে তার কাছে নাম ঠিকানা দিতে হয়। 

অনেকক্ষণ টেলিফোনের রিসিভার কানে নিয়ে বসে থাকার পর দ্বিতীয় একজন টেলিফোন ধরে। তার কাছে দ্বিতীয় দফা নাম ঠিকানা দিতে হয়। সে বায়ােডাটা পুরােটা শােনার পর বলে, ধরেন দেখি আপা বসায় আছে কিনা। খুব সম্ভব নই। 

আজো তাই হল। ফাস্ট রাউন্ড শেষ করে আমি সেকেন্ড রাউন্ডে উঠলাম। পুরুষ কণ্ঠ বল, কার সঙ্গে কথা বলবেন রুপা আপার সঙ্গে? 

আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, জ্বি। আপনার নাম? আমার নাম মেছকান্দর? ‘কি বললেন? কি কার?” 

মেছকান্দর।’ ‘আপনার পরিচয়? 

‘আমি ধর্মমন্ত্রী মাওলানা এজাজুল কবীর সাহেবের পিএ। ধর্মমন্ত্রী আপার সঙ্গে কথা বলবেন। বিশেষ প্রয়ােজন।’ 

লাইনে থাকুন দিচ্ছি।’ 

একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে। জোহরের নামাজের টাইম হয়ে গেছে মন্ত্রী সাহেব নামাজে দাঁড়াবেন। 

‘ড়ি দিচ্ছি।’ 

একটা সেকেন্ড। আপনার নাম তাে ইয়াকুব তাই না?” তদ্রলােক হততই গলায় বললেন, জ্বি। আপনি কি করে জানেন? 

আমি হাই তােলার মত শব্দ করতে করতে বললাম, আমাদের সব খোঁজ খবর রাখতে হয়। জুমার নামাজ পড়া ছেড়ে দিয়েছেন ব্যাপার কি? 

টেলিফোনের ওপাশ থেকে বিড় বিড় জাতীয় শব্দ হচ্ছে। ইয়াকুব সাহেবের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করেছে। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৬

‘স্যার একটু ধরেন আপাকে দিচ্ছি। ‘চার কলমা জানেন? প্রথমটা শুধু জানি। ‘চারটা কলমাই শিখে রাখবেন। পরে আবার ধরব। 

জ্বি আচ্ছা। রূপা টেলিফোন ধরেই বলল, কে হিমু? 

আমি বললাম, হ্য‘সবার সঙ্গে তামাশা কর কেন? ইয়াকুবকে উল্টাপাল্টা কথা বলছ কেন? 

‘উল্টাপাল্টা কথা তাে কিছু বলছি না। চার কলমা মুখস্ত করতে বলেছি।” 

ওর নামই বা জানলে কিভাবে? ‘আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছি। ঢিল লেগে গেছে। আজকাল যে কোন লােকের সঙ্গে কথা হলে প্রথমেই জানতে চাই—তার নাম কি ইয়াকুব? কেন জানতে চাই বলব?’ 

‘নিশ্চয়ই উদ্ভট কোন কারণ আছে। আমি এখন আর উদ্ভট কিছু শুনতে আগ্রহী না। তােমার উদ্ভট আচার-আচরণ এক সময় ভাল লাগতাে। একটা বয়স। থাকে যখন বিভ্রান্ত হতে ভাল লাগে। সেই বয়স আমি পার হয়ে এসেছি। হিমু শােন, আমার বয়স তােমার মত একটা জায়গায় স্থির হয়ে নেই। আমার বয়স 

‘আমারাে বয়স বাড়ছে। আমি এখন আর আগের হিমু না। পরিবর্তিত হিমু।’ 

তাই বুঝি? ‘হ্যা তাই। এখন আমার মধ্যে পাখিদের স্বভাব দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা হলে পাখিদের মত ঘরে ফিরে আসি। গত দু’টা পূর্ণিমায় আমি ঘর থেকে বের হইনি। 

‘আচ্ছ। 

‘শুধু তাই না, আমি ঠিক করেছি বিয়ের কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়েছে। মেয়েটার নাম তামান্না। নাম সুন্দর না?” 

‘হ্যা, নাম সুন্দর । 

‘চেহারা ছবি তেমন না। বেশ খানিকটা ভাউন। তা আমার মত ছেলেকে ডাউন মেয়েরাই তাে বিয়ে করবে। আর মেয়েরা কেন করবে? 

তাও ঠিক। ভাবছি তামান্নাকে নিয়ে একদিন তােমার বাসায় যাব।” 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৬

‘প্লীজ দয়া করে এই কাজটি করবে না। তােমার কোন কর্মকান্ডের সঙ্গে আমি নিজেকে জড়াতে চাচ্ছি না। এবং আমি খুব খুশী হব যদি তুমি ঐ মেয়েটিকে আর বিভ্রান্ত না করা | ‘তুমি ভুল করছ রূপা। আমি তামান্নাকে মােটেই বিভ্রান্ত করছি না। বরং সেই আমাকে বিভ্রান্ত করছে। 

‘হিমু আমি এখন রাখি। আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার শরীর ভাল না, জুর। গায়ে র্যাশের মত হয়েছে। 

‘দেখতে আসব?’ ‘না। রাখি কেমন? রূপা খুব সহজভাবেই টেলিফোন নামিয়ে রাখল। 

আমি টেলিফোন রেখে জগলু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম। জগলু ভাই বললেন, হিমু সাহেব কিছু পেমেন্ট করবেন না। আপনার 

তাে মেলা জমে গেল। একটা একটা করে বালি জমে মরুভূমি হয়ে যায়। 

আমি আনন্দিত গলায় বললাম, মরুভূমি বলেই মরুদ্যানের খোঁজ থাকে। এক সপ্তাহের মধ্যে সব ক্লিয়ার করে দেব। কুড়ি হাজার টাকা পাচ্ছি। 

চা খাবেন? ‘চা তাে খাবই। ভাল কথা, আপনার কর্মচারীদের মধ্যে ইয়াকুব নামে কেউ আছে? 

‘তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ইয়াকুব নামে কেউ আছে?” ‘জানি না, খোঁজ নিয়ে দেখব। ‘ভাল কার খোঁজ নেবেন। আপনার মুখ এমন শুকনাে কেন? শরীর ভাল । “জ্বি শরীর তাল) ‘মন খারাপ? ‘ই মন খারাপ। খুবই খারাপ। ‘ব্যবসা হচ্ছে না? ‘না।’ 

জগলু ভাই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, বাবা কিছু ক্যাশ রেখে গিয়েছিল বলে ভেঙ্গে খাচ্ছি। ক্যাশ শেষ হলে কি হবে জানি না। আপনার মত হলুদ পাঞ্জাবী পরে পথে পথে ঘুরতে হবে। ভাগ্য, বুঝলেন হিমু ভাই, সবই ভাগ্য। 

জগলু ভাই বিমর্ষমুখে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। জগলু ভাইয়ের দোকানের নাম সুরমা স্টেশনারী। রাস্তার মােড়ে বেশ বড় দোকান। জিনিসপত্র ভালই আছে। দোকানটা দেখতেও সুন্দর । দু’জন কর্মচারী আছে। সুদর্শন, কথাবার্তায় শুদ্র। অথচ এই দোকানে কোন কাস্টমার আসে না আসলেই আসে না।

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৬

ঈগলু ভাই এর আগে কলাবাগানে একটা দোকান দিয়েছিলেন সগর স্টোর। সেখানেও একই অবস্থা। আশপাশে সব দোকানে ভাল বিক্রি— সাগর স্টোরে মাছিও উড়ে না যে কর্মচারীরা মাছি মারবে। জগলু ভাই দোকানের জায়গা বদলালেন, নাম বদলালেন। আগে যে কর্মচারী ছিল তাকেও বদলালেন। কোন লাভ হল না। এখানেও এই অবস্থা। সব দোকানে রমরমা ব্যবসা —তারটা আঁকা। 

‘হি সাহেব। 

‘ভাগ্যটা কেমন জিনিস দেখলেন? আমি সারাদিন চুপচাপ বসে থাকি, চা খাই আর মনে মনে ভাগ্য কি সেটা ভাবি। কেন আমার দোকানে লােক আসবে ? আমি জিনিসের দাম বেশি রাখি না, কাস্টমারের সঙ্গে তাল ব্যবহার করি। তারপরেও এই অবস্থা কেন? বড় ধরনের পীর-ফকির পেলে ডেকে জিজ্ঞেস করতাম। আপনার সন্ধানে কোন পীর-ফকির থাকলে নিয়ে আসবেন। উনাদের দোয়াতে যদি কিছু হয়। খরচপাতি যা লাগে আমি দিব। কথাটা মনে রাখবেন হিম সাহেব। 

‘ িমনে রাখব।‘চা কি আরেক কাপ খাবেন? 

কি না । আজ উঠি কাজ আছে। ‘বসে গল্প করি। চুপচাপ বসে থাকি – কথা বলার মানুষ নাই।” 

‘আরেক দিন এসে গল্প করব। আমার প্রচুর কাজ একটা লােকের সন্ধান করছি। নাম ইয়া ? 

‘শুধু নাম দিয়ে তােক খুঁজে বের করে ফেলবেন? এক কোটি লােক থাকে ঢাকা শহরে। 

আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, চেষ্টা করে দেখি। | দুপুরে চলে আসুন। আজ খিচুড়ি রাঁধতে বলেছি। আমার কাজের ছেলেটা ভাত-মাছ রাঁধতে পারে না, খিচুড়ি পােলাও এইসব ভাল রাঁধে।‘দেখি সময় পেলে চলে আসব। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৬

আমি আবারাে পথে নামলাম। পায়ের ভাঙ্গা নখ কষ্ট দিচ্ছে। মানুষের দু টা অংশ শরীর এবং মন। মন অনেক কষ্ট সহ্য করতে পারে। শরীর কেন পারে না? শরীরের বয়স বাড়ে। মনের বাড়ে না। জড়া শরীরকে গ্রাস করতে পারে। মনকে পারে না। শরীরের মৃত্যু আছে মনের কি অবস্থা? যে মন জড়াকে জয় করতে পারে সে নিশ্চয়ই মৃত্যুকেও জয় করতে পারে। এই জাতীয় দার্শনিক চিন্তা করতে করতে এগুচ্ছি। 

রাস্তায় প্রচুর মানুষ। তাদের ব্যস্ততাও দেখার মত রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে যে চা খাচ্ছে সেও ব্যস্ত। স্থির হয়ে চা খাচ্ছে না, সারাক্ষণ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রহস্যময় ইয়াকুব। 

ঢাকা শহরের মানুষদের ঠিকঠাক পরিসংখ্যান থাকলে দেখা যেত এই শহরে মােট কতজন ইয়াকুব আছে। তিন থেকে পাঁচ হাজার থাকার কথা এদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই অসম্ভব বিত্তবান। কেউ হতদরিদ্র। দু একজন

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৭

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *