হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৭

পাওয়া যাবে সাধু সন্ত—মহাপুরুষ পর্যায়ের, কয়েকজন নিশ্চয়ই ভয়ংকর অপরাধী

হিমুর রূপালী রাত্রি খুনটুন করে ফেলেছে। কিছু থাকবে রেপিষ্ট , ন দশ বছরের বালিকা রেপ করে লুকিয়ে আছে। 

ঢাকা শহরের সব ক’টা ইয়াকুবকে একত্র করে একটা গ্রুপ ছবি তুলতে পারলে ভাল হত। এদের নিয়ে গবেষণাধর্মী একটা বইও লেখা যেত – 

A comprehensive study in the lives of Yakub’s of Dhaka city.

বাংলায়—’ঢাকা শহরের ইয়াকুবদের জীবন চর্চা।’ না বাংলা নামটা ভাল লাগছে না। গবেষণাধর্মী বইয়ের নাম ইংরেজীতেই ভাল খুলে। 

গরম লাগছে । শীতকালের রােদ খুব কড়া হয়। রােদটা জামা-কাপড় ভেদ করে চামড়ার ভেতর ঢুকে পড়ে। রােদ থেকে ছায়াতে গেলেই লাগে ঠাণ্ডা শীতকাল হল এমন এক কাল যে কালে রােদেও থাকা যায় না, ছায়াতেও থাকা যায় না। 

আমি ভিক্ষুক মেকার মিয়ার সন্ধানে বের হলাম। আজ সতেরাে তারিখ এই খবরটা তাকে জানানাে দরকার। বেচারা তারিখ জানতে চাচ্ছিল। যে পাথর আমাকে বাথা দিয়েছে তাকেও দেখে আসতে ইচ্ছা করছে। জগৎ অতি রহস্যময় । কে জানে একদিন হয়ত বৈজ্ঞাকিরা বের করে ফেলবেন জড় পদার্থেরও মন আছে। তাদের জীবনেও আছে আনন্দবেদনার কথা। আমার বাবা তার জবেদা খাতায় লিখে গেছেন 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৭

“মহাপ্রাণ নানান ভঙ্গিতে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। তিনি মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন, পশু কীটপতঙ্গ হিসেবেও নিজেকে প্রকাশ করেছেন। গাছপালাও মহাপ্রাণেরই অংশ। নদী, সাগর, বালি ধূলিকণাতেও তিনি নিজেকে প্রকাশিত করেছেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকলই মহাপারে নানান রূপান্তর ।” 

আমার পিতার কথা সত্যি হলে পাথরেরও প্রাণ থাকবে। যেহেতু সে পাথর তার প্রাণ হবে কোমল। সে মানুষকে ব্যথা দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু নিজে সেই কারণে অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছে। 

‘কে হিমু না?” 

আমি থমকে দাঁড়ালাম। পায়ের পাতা গরমে চিড়চিড় রছে । এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা ভয়াবহ ব্যাপার। শীতকাল এখনাে শেষ হয়নি। অথচ দিনের বেলায় চৈত্র মাসের গরম পড়ছে। আলনিনাের এফেক্ট হবে। রাস্তার পিচ এখনাে গলা শুরু করেনি। তবে মনে হচ্ছে করবে। ভরদুপুর হলেও কথা ছিল। বেলা চারটার মত বাজে। বিকে শুরু হয়েছে। এখনাে এত গরম। 

‘কথা বলছিস না কেন? তুই হিমু না?” 

আমি বলতে যাচ্ছিলাম— ‘ক্তি না। রং নাম্বার। 

বলা হল না। এমন তাে হতে পারে যে প্রশ্ন করছে—তাকেই আমি খুজছি। তার নামই ইয়াকুব। বাবার নাম সােলায়মান। আমার অনুসন্ধানের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে গড় অলমাইটি তাকেই আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালাম : প্রশ্নকর্তা মিডিয়াম সাইজ পর্বতের কাছাকাছি। টকটকে লাল শার্ট গায়ে দিয়ে আছেন। তাঁর বিশাল দুরী শার্ট ছিড়ে যে কোন মুহর্তে বের হয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে।

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৭

মাথা পরিষ্কার করে কামানাে। নেংটি পরিয়ে ছেড়ে দিলে জাপানী সুমাে কুস্তিগীর হয়ে যাবে। জাপানীদের সঙ্গে চেহারার খানিকটা মিলও আছে। নাক চ্যাপ্টা ! চোখ ছােট ঘােট। এর নাম ইয়াকুব হবার কোন কারণ নেই। | প্রশ্নকর্তা আহত গলায় বলল, মাই ডিয়ার ও ফ্রেও, তুই কি এখনাে আমাকে চিনতে পারছিস না? 

 আমি বললাম, না এবানাে চিনতে পারিনি। তাতে কোন অসুবিধা নেই। তুই আছিস কেমন দোস্ত? শরীরটা তাে মাশাল্লাহ ভাল বানিয়েছিস। 

প্রশ্নকর্তা বিষন্ন গলায় বলল, কেউ আমাকে চিনতে পারে না। তাদের দোষ দিয়ে কি হবে। আমি নিজেই নিজেকে চিনি না। তাের সঙ্গে কিশােরী মােহন পাঠশালায় পড়তাম। আমি আরিফ। আরিফুল আলম জোয়ার্টার : এখনাে চিনতে পারিসনি? 

‘চেনা চেনা কি লাগছে? না তাও লাগছে না?” ‘তাও লাগছে না। অবশ্যি শুরুতে ভেবেছিলাম তুই ইয়াকুব।। ‘ইয়াকুব কে? 

ইয়াকুব হল সােলায়মানের ছেলে। ‘সােলায়মানটা কে? ‘বাদ দে, চিনতে পারবি না। কেমন আছিস বল? 

দোস্ত সত্যি করে বল তুই এখনাে আমাকে চিনতে পারছিস না? 

‘চিনতে না পারলে এমন আন্তরিকভাবে কথা বলছিস কেন? ‘তুই আন্তরিকভাবে কথা বলছিস দেখে আমিও বলছি। 

আরিফুল আলম জোয়ার্দার গলা নিচু করে বলল, ক্লাস ফোরে পড়ার সময় একদিন বেঞ্চিতে ‘ইয়ে করেছিলাম। যার জন্যে টিফিনের সময় ক্লাস ছুটি হয়ে গেল। অংক স্যার আমাকে ডাকতেন — ‘ব্যাঙাচি। 

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি, ব্যাঙাচির এই অবস্থা? 

ইউনিভার্সিটির পুরানাে বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে মুখ হাসি হাসি করে জিজ্ঞেস করা হয়— ‘তারপর কি খবর তাল আছেন? এখন কি করছেন?’ কলেজের পুরানাে বন্ধুর সঙ্গে বলা হয়- ‘আরে তুমি? কেমন আছ?’ আর স্কুল লেতেলের বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে একজন আরেকজনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে — তাই মিম। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৭

আমি ব্যাঙাচির উপর কীপ দেব কি দেব না ভাবছি। বেচারা যেভাবে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে আমার ঝাঁপের অপেক্ষা করছে। ঝাঁপ দেয়াই মনস্থ করলাম। 

দু’হাতেও তাকে ঠিক জড়িয়ে ধরা গেল না। ব্যাঙাচি ধরা গলায় বলল, দোস্ত গরমের মধ্যে জড়াজড়ি করিস না ছাড়। শরীর ভর্তি চর্বি। জড়াজড়ি করলে অস্বস্তি লাগে। 

আমি বললাম, লাগুক অস্বস্তি। তােকে ছাড়ব না। তুই এমন মটু হয়েছিস কি ভাবে? 

‘খেয়ে খেয়ে মটু হয়েছি দোস্ত । দিন-রাত খাই।’ 

বলিস কি? ‘কেন খাব না বল – আল্লাহপাক মানুষকে খাওয়ার জন্যেই তাে সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই মানুষের খাদ্যদ্রব্য। গরু-মহিষ, ছাগল ভেড়া, পোকা-মাকড়, গাছ-গাছড়া বই তাে আমরা খাচ্ছি। বাচ্ছি না?” 

ও 

এ ‘খাচ্ছি। 

আমার এক চাচী ছিলেন পেটে সন্তান এলেই তিনি মাটি খেতেন। মাটির চুলার তিনটা মাথা ভেঙ্গে একদিন খেয়ে ফেললেন। সেদিন রান্না হল না। রাঁধবে কোথায়? চুলা নেই। চাচীর শাশুড়ি চাচীর উপর খুব রাগ করল —বৌমা এতই যদি মাটি খেতে হয়— ক্ষেতে চলে যাও। ক্ষেতে গিয়ে মাটি খাও। আমি চোখের আড়াল হলে তুম দেখি বাড়িঘর সব খেয়ে ফেলবে। তাদের আবার মাটির ঘর বাড়ি তাে, এই জন্যে চিন্তাটা বেশি। 

আমি হাে হাে করে হাসছি। বড় হয়ে ব্যাঙাচি যে এমন রসিক হবে তা বােঝা যায়নি। ছটবেলায় তার প্রতিভা বেঞ্চিতে ‘ইয়ে’ করে দেবার ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ ছিল। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৭

ব্যাঙাচি ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তাের সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগছে রে দোস্ত। তুই যখন জড়িয়ে ধরলি তখন প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম। দেখা হলে জড়িয়ে ধরার মত বন্ধু মানুষের এক দু টার বেশি থাকে না। অয় কোথাও বসে চা-টা কিছু খাই। ভাল কথা, চাকরি-বাকরি কিছু করছিস? 

‘পার্ট টাইম চাকরি। 

‘পার্ট টাইম চাকরি ভাল রে দোস্ত । টেনশান কম। কাজটা কি? বেতন কত? বেতন কম হলে বলিস না। তােকে লজ্জা দেবার জন্যে জিজ্ঞেস করিনি পুরানাে বন্ধু সেই দাবিতে জিজ্ঞেস করা। 

অনুসন্ধানের কাজ। একটা লােককে খুঁজে বের করা। খুজে বের করতে পারলে কুড়ি হাজার টাকা পাব। খুঁজে না পেলে লবডঙ্গা। 

দোস্ত চিন্তা করিস না। আমি তােকে সাহায্য করব। ওয়ার্ড অব অনার। পুরানাে বন্ধুর জন্যে এইটুকু না করলে কি হয়। তাছাড়া আমার কাজকর্মও কিছু নেই। আয় কোথাও বসে চা-টা কিছু খাই। ফর ওল্ড টাইম সেক। তাের সঙ্গে টাকা-পয়সা কিছু আছে? 

না। আমার পাঞ্জাবীর পকেট নেই । ‘এটা তাল করেছিস। পকেটই ফেলে দিয়েছিস। টাকা আমার কাছেও নেই। বউ টাকা দেয় না। টাকা দিলেই খাওয়া-দাওয়া করব এই জন্যে দেয় না। সে যেমন বুনাে ওল আমিও তেমন বাঘা তেতুল। আমিও ব্যাঙাচি –ঢাকা শহরে তিনটা জায়গায় ব্যবস্থা করা আছে। বাকিতে থাই, মাসকাবারি টাকা দেই। চল আমার সঙ্গে একটু হাঁটতে হবে। পারবি না? 

‘তোকে দেখে এমন ভাল লাগছে দোস্ত। আবার খারাপও লাগছে। খালি পায়ে হাঁটছিস দেখে মনে ব্যথা পেয়েছি। আই এম হার্ট। ভিক্ষা করে যে ফকির সেও স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দেয়। আর তুই হাঁটছিস খালি পায়ে? তুই কোন চিন্তা করিস না তােকে আমি ভাল এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে দেব। প্রমিস্। টাকা থাকলে আজই কিনে দিতাম। জুতার দোকানে বাকি দেয় না।’ 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৭

ব্যাঙাচি আমাকে নিয়ে মালীবাগের এক কাবাব হাউসে চুল। পিয়া কাবাব এও বিরানী হাউস। সাইনবাের্ডে রােগা পটকা এক খানির ছবি। খাসির মুখটা হাসি হাসি। হাস্যমুখী ছাগল যে পেইন্টার এঁকেছে তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী হাসতে পারে না বলে যে ধারণা প্রচলিত তা যে সম্পূর্ণ ভুল হাস্যমুফ ছাগল দেখে তা বােঝা যায়। 

‘দোস্ত কি খাবি? যা খেতে ইচ্ছে করে খা। এটা বলতে গেলে আমার নিজেরই দোকান মালিক আমার ভাগ্নে। আপন না, পাতানাে । আপন ভাগের চেয়ে পাতানাে ভাগের জোর বেশি তাতো জানিসই। জানিস না? বিরান হাবি?” 

‘বিকাল বেলা বিরানী খাব?’ 

‘বাসি বিরানী। এর টেস্ট আলাদা। গরম করে দিবে, নাশতার মত । বিরানী যত বাসি হয় তত স্বাদ হয় — ঘি

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৮

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *