ভেতরে ঢুকে। মাংস ম হয়। মাংসের প্রত্যেকটা আশ আলাদা আলাদা হয়ে যায়। আমার কথা শুনে আজ খেয়ে দেখ। একবার খেলে আর টাটকা পােলাও খেতে পারবি না। শুধু বাসি পােলাও খাবি।
খাওয়ার মত স্থূল ব্যাপারও যে এত দৃষ্টিনন্দন হতে পারে ভাবিনি। আরিফ খাচ্ছে, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। মনে হচ্ছে পোলাওয়ের প্রতিটি দানার স্বাদ সে আলাদা করে পাচ্ছে। হাডিড চুষছে । আনন্দে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। খাওয়ার মাঝখানে একটা আস্ত পেঁয়াজ নিয়ে কচকচ করে চিবিয়ে ফেলল। গাঢ় স্বরে বলল, পেঁয়াজের রস হজমের সহায়ক। ভরপেট বিরানী খাবার পর দু’টা মিডিয়াম সাইজ পেঁয়াজ চিবিয়ে খেয়ে ফেলবি দেখবি আধ ঘন্টার মধ্যে আবার ক্ষিধে পেয়েছে। আমার অবশ্যি হজমের সমস্যা নেই।
বিরানী পর্ব (তিন প্লেট। আর ছিল না। শেষ হবার পর এক বাটি স্যুপের মত তরল পদার্থ এল। স্যুপের উপর গুলমরিচের গুড়া ভাসছে। কুচিকুচি করে কাটা কাঁচা মরিচ তাসছে। আরিফ বাটির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। স্যুপের বাটির দিকে এমন মুগ্ধ প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে এর আগে কি কেউ তাকিয়েছে? মনে হয় না।
আমি বললাম, জিনিসটা কি? আরিফ গাঢ় স্বরে বলল, কাছি-রসা।
কাচ্চি-রসা মানে? এই নাম তাে আগে কখনাে শুনিনি।
শুনবি কি করে? আমার দেয়া নাম –অসাধারণ একটা জিনিস – কাচ্চি বিরিয়ানীর তেল। চুইয়ে চুইয়ে পাতিলের নিচে জমা হয়। হাই প্রােটিন। খেতে অমৃত! হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম, সেও এক ইতিহাস। শুনবি?”
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৮
‘ল শুনি।
‘কিসমত নামে পুরানাে ঢাকায় একটা রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে বিরানী খাচ্ছি হঠাৎ দেখি বাবুর্চি পাতিল থেকে তেল নিংড়ে ফেলে দিচ্ছে। আমি ভাবলাম খেয়ে দেখি জিনিসটা কেমন। খারাপ হবার কথা তাে না, যি পাস গােশতের নির্যাস, পাস পােলাওয়ের চালের নির্যাস। এক চামচ মুখে দিয়ে বিশ্বাস। কর দোস্ত আমার কলজা ঠান্ডা হয়ে গেল। সেই থেকে নিয়মিত খাচ্ছি। চেখে দেখবি একটু?
‘থাক, রােগা পেটে সহ্য হবে না।
ব্যাঙাচি গভীর তৃপ্তিতে কাচ্চি-রসার বাটিতে চুমুক দিল। লম্বা চুমুক না, ধীর লয়ের চুমুক। যেন প্রতিটি বিন্দুর স্বাদ আলাদা আলাদাভাবে নিচ্ছে। তার চোখ বন্ধ । মাথা সামান্য দুলছে। যেন কোন সংগীত রসিক বিথােভেনের ফিফথ সিমফনী শুনছে।
আরিফ হঠাৎ চোখ খুলে গােপন কোন সংবাদ দেবার মত করে বলল, মিরপুরে বিহারীদের একটা দোকান আছে। খাসির চাপ বানায়। এমন চাপ বেহেশতের বাবুর্চিও বানাতে পারবে না। তােকে একদিন নিয়ে যাব। আজই নিয়ে যেতাম ওরা আবার বাকিতে দেয় না। কি কি সব মশলা দিয়ে চাপটাকে চার পাঁচ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখে। তারপর ডােবা তেলে তাজে! মশলার মধ্যেই কারিগরি।
খাওয়া-দাওয়া ছাড়া অন্য কোন প্রসঙ্গ নিয়ে তুই কথা বলিস না?
‘বাব না কেন? বলি তবে বলতে ভাল লাগে না। খাওয়ার জন্যে মরতে বসেছি। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। শরীর ভর্তি চর্বি, হাই ব্লাড প্রেসার, হাই কোলেস্টারল, লিভার ড্যামেজড। ফ্যাটি লিভার। কিডনীর সমস্যা। হয়ত আর বছরখানিক বাঁচব। যার জন্যে মরতে বসলাম তারে নিয়েই কথা বলি। কাচ্চি রসা খেয়েছি এখন তার এফেক্ট কি হয় দেখ তাকিয়ে থাক আমার দিকে।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৮
আমি তাকিয়ে আছি। ব্যাঙাচি ঘামতে শুরু করেছে। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম না, বৃষ্টির ধারার মত ঘাম নেমে আসছে। একটা বড় ফ্লোর ফ্যান তার দিকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। পাখা ফুল স্পীডে ঘুরছে। ব্যাঙাচি ক্লান্ত গলায় বলল, এই রকম ঘাম চলবে আধ ঘন্টার মত। তারপর শরীর নেতিয়ে যাবে। তখন ঘন্টাখানিক শুয়ে থাকতে হবে। তুই চলে যা—এদের এখানে বিছানা আছে। আমি শুয়ে খব।‘চলে যাব?
‘অবশ্যই চলে যাবি। এই নে কার্ডটা রেখে দে। বাসার ঠিকানা আছে। সন্ধ্যার পর চলে আসিস। তােকে স্যান্ডেল কিনে দেব। আমার হাতে তাে এরা টাকা পয়সা দেয় না। তাের ভাবীকে বলব স্যান্ডেল কিনে দিতে। তুই খালি পায়ে হাঁটছিস দেখে খুবই মনে কষ্ট পেয়েছি। ক্লাসের কত অগা-মগা-বগা কোটিপতি হয়ে গেল আর তুই খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করছিস।
“তুই কথা বলিস না, চুপ করে থাক। কথা বলতে তাের কষ্ট হচ্ছে।’ ‘কষ্ট তাে হচ্ছেই। তাের কোন কার্ড আছে?” ‘না।’
‘জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়েছে। খালি পায়ে যে হাঁটে তার আবার কার্ড কি। যাই হােক, আমারটা রেখে দে। সন্ধ্যার পর বাসায় চলে আসবি। দারােয়ান ঢুকতে
দিলে কার্ড দেখাবি। স্ট্রেইট আমার কাছে নিয়ে যাবে। দারােয়ানকে বলা আছে। অপরিচিতদের মধ্যে যারা আমার কার্ড দেখাবে শুধু তাকেই ঢুকতে দেবে।
‘তুই কি খুব মাদার পার্টি না-কি?”
‘কার্ডটা দেখ। কার্ড দেখলেই বুঝবি। আর দোস্ত শােন, তােকে আমি সাহায্য করব। ওয়ার্ড অব অনার । ঐ লােককে খুঁজে বের করব।
ব্যাঙাচির ঘাম আরাে বেড়ে গেল। তাকে ওই অবস্থায় রেখে আমি চলে এলাম। হাতে ব্যাঙাচির কার্ড। হেন্ডশেকের বদলে কার্ডশেক। কিছুদিন পর কার্ড কালচারের আরাে উন্নতি হবে বলে আমার ধারণা। কার্ডে সরকারী বিধিনিষেধ এসে পড়বে।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৮
সাধারণ জনগণ ব্যবহার করবে সাদা রঙের কার্ড, সংসদের সদস্যরা লাল পাসপাের্টের মত লাল কার্ড, কোটিপতি েকার্ড হবে সােনালি, লক্ষপতিদের রূপালী ফকির-মিসকিনদের কার্ডের রঙ হবে ছাই রঙের। তাদের কার্ডে প্রয়ােজনীয় সব তথ্য থাকবে। যেমন— মেছকান্দর মিয়া ভিক্ষুক পিতাঃ কুতুব আলি এক চক্ষু বিশিষ্ট (কানা) ব্যবসায়ের স্থানঃ রামপুরা টতি ভবন হইতে মৌচাক গােলচত্বর ট্রেড মার্ক ঃ গােল পাথর সরকারী রেজিষ্ট্রেশন নম্বরঃ ৭১৯৬৩৩০২/ক
সন্ধ্যাবেলা ভিক্ষুক মেছকান্দর মিয়ার অবস্থানের জায়গাটায় গেলাম।
মেছকান্দর আমাকে দেখে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল। আমি মধুর গলায় বললাম, ‘কেমন আছ মেছকান্দর?
সে জবাব দিল না। পিচ করে থুথু ফেলল। থুথু পড়ল পাথরটার উপর।
আমি বললাম, ‘মেছকার আজ হল ২১ তারিখ। তুমি তারিখ জানতে চাও। কাজেই আমি ঠিক করেছি রােজ এসে তােমাকে ভারিখ জানিয়ে যাব।
মেছকার এক চোখে তাকিয়ে আছে। এক চোখের দৃষ্টি এমনিতেই তীক্ষ্ণ হয়। আজ আরাে তীক্ষ্ণ লাগছে। মেছকাপর বিড়ি বের করে ধরাল। আমি অমায়িক গলায় বললাম, আমাকে একটা বিড়ি দাও তাে!’
মেছকান্দর বিরক্ত গলায় বলল, ‘ক্যান আমারে ত্যাক্ত করতেছেন? আমি আপনের কি ক্ষতি করছি?
বলতে বলতে সে পাথরের উপর আবার বুথু ফেল্ল। আমি বললাম, ‘পাথরের উপর থুথু ফেলাে না। আমি ঠিক করেছি এই পাথরটা আমি আমার এক বন্ধুকে উপহার দেব। সে সর্বভুক। হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে সে খেয়ে ফেলবে। একটু সিরকা দেবে, কিছু লবণ, কিছু গােলমরিচ। পাথরের চাটনি।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৮
মেছকান্দর কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। তার হাতের বিড়ি নিতে গেছে। কিন্তু চোখে আগুন জ্বলছে। আমি পাথরের উপর বসে পড়ল। সন্ধ্যা হচ্ছে। পাথরে বসে সন্ধ্যার দৃশ্য দেখতে ভাল লাগার কথা। মেছকারের মুখ ভর্তি থুথু। মনে হচ্ছে পাথরটা সে ব্যবহার করে থুথু ফেলার জন্যে। আমি পাথরে বসে থাকায় সে থুথু ফেলতে পারছে না।
আমি ইয়াকুব সাহেবকে স্বপ্নে দেখলাম। ভদ্রলােকের কেমন মমি মমি চেহারা । তাঁর চোখেও কোন সমস্যা আছে। সারাক্ষণ পিটপিট করে চোখের পাতা ফেলছেন। শবাসনের মত শিরদাঁড়া সােজা করে আমার বিছানায় বসে আছেন । খালি গা, গা বেয়ে ঘাম পড়ছে। অথচ শীতকাল। আমি চাদর গায়েই স্বপ্নের ভেতর কাঁপছি। ইয়াকুব সাহেব মাঝে মাঝে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। খালি গায়ের কারণে তাঁর পাঁজরের সব হাড় দেখা যাচ্ছে । পাজর বের রা বুদ্ধের মূর্তির সঙ্গে কিছু মিল আছে। বুদ্ধদেবের কানের মত বড় বড় কান! টানা টানা চোখ।
আমি বললাম, ইয়াকুব সাহেব না? তিনি বললেন, জি জনাব । আমার নাম ইয়াকুব।
আপনাকে কদিন ধরেই খুঁজে বেড়াচ্ছি। কেমন আছেন?” জ্বি ভাল। ‘ধ্যান করছিলেন নাকি?” অনেকটা সে রকমই। ‘সরি, আপনার ধ্যান ভাঙ্গালাম।
না, ঠিক আছে। আপনি আসল ইয়াকুব হোে? আপনার বাবার নাম কি? ‘বাবার নাম শ্রী সােলায়মান । ‘নামের আগে শ্রী বসাচ্ছেন কেন? আপনি মুসলমান না? “জ্বি না। আমাদের মানব ধর্ম। “ও আচ্ছা, মানব ধর্ম।
হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৮
‘মানব ধর্মে নামের আগে শ্রী বসানাে যায়, আবার অনাবও বসানাে যায়। আপনার যা ভাল লাগে তাই বসাতে পারেন।জানতাম না।’
“ইয়াকুব সাহেব ধ্যানস্ত হয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ । আমি ইতস্তুত করে বললাম, ধ্যান করে কিছু পাচ্ছেন?
‘কিছু পাওয়ার জন্যে তাে ধ্যান করছি না। মনের শান্তির জন্যে ধ্যান করছি।” ‘শান্তি পাচ্ছেন? ‘এখনাে পাচ্ছি না, তবে পাব।’ ‘ইয়াকুব সাহেব?”
‘আপনার ঠাণ্ডা লাগছে না? ‘জি একটু লাগছে। ‘আমার চাদরটা কি আপনার গায়ে জড়িয়ে দেব? দিতে পারেন। তবে আপনার তাে ঠাণ্ডা লাগবে।
ঠাস্তায় আমার কষ্ট হয় না। ঠাণ্ডা সহ্য করার মন্ত্র আমাকে আমার বাবা শিখিয়ে গেছেন। মন্ত্রটা কি? ‘আপনাকে বলা যাবে না। গুরুমুখী গুপ্ত বিদ্যা। আপনাকে বললেই বিদ্যা চলে যাবে। ‘তাহলে বলার দরকার নেই। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে দিন। ভাল ঠাণ্ডা পড়েছে।
‘এত ঠাণ্ডা জানলে খালি গায়ে ধ্যানে বসতাম না। মিসটেক হয়ে গেছে।
আমি ইয়াকুব সাহেবের গায়ে চাদর জড়িয়ে দিলাম। স্বপ্নের মধ্যেই শীতে আমার নিজের শরীর জমে গেল এবং আমি জেগে উঠে দেখি গায়ের লেপ মেঝেতে পড়ে আছে। আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। এ বছর আবহাওয়ার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কদিন আগেই গরম ছিল – এখন আবার শীত নেমে গেছে। ভয়াবহ শীত : শৈত্য প্রবাহ চলছে। খবরের কাগজ বলছে এক সপ্তাহ থাকবে। নেতাদের খুব সুবিধা হয়েছে।
করুণ মুখ করে – সদ্রঘাট লঞ্চ টার্মিনেলে, গাবতলীতে, কমলাপুর রেল স্টেশনে শীতের কাপড় বিলি করতে পারছেন। সেই ছবি টিভিতে দেখানাে হচ্ছে। পত্রিকায় সচিত্র সংবাদ ছাপা হচ্ছে। ছবির ক্যাপশান শীতার্ত মায়ের মুখে হাসি। দেখা যাচ্ছে মা একজন খালি গায়ের শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা এবং শিশু দুজনের মুখ ভর্তি হাসি। দু’জনই কম্বলের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে।
সবাই খুশি। নেতা খুশি তিনি কম্বল দেয়ার সুযােগ পাচ্ছেন। মা এবং শিশু খুশি তারা কম্বল পাচ্ছে।