হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১১

অতীশ দীপংকর রােডের পােস্টম্যান হল আমাদের সার্কেলের কেন্দ্রবিন্দু। তারপর ধীরে ধীরে সার্কেলটা বড় করব। পাঁচ বছর আগে হলে লী থেকে চট করে বের করে ফেলা যেত। এখন আর যাবে না। ঢাকা শহরে ই। লােকজন এখন আর ধােপাখানায় কাপড় ধােয় না।হিমুর রূপালী রাত্রি

‘এটা তাে লক্ষ্য করিনি। 

‘তাের লক্ষ্য না করলেও হবে। আমি করছি। ব্যাটাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব এখন আমার। তাের অন্নঋণ শােধ দিতে হবে। চল উঠি, একশানে নেমে পড়ি। 

‘যে খাওয়া খেয়েছিস হাঁটতে পারবি তাে?” 

ব্যাঙাচি করুণ গলায় বলল, হাঁটতে পারব না দোস্ত। রিকশা নিতে হবে। এখন হাঁটলে আবার ক্ষিধে পেয়ে যাবে। অনেক কষ্টে ক্ষিধেটা চাপা দিয়েছি। 

রেস্টুরেন্টে বাকি খাওয়া যায় বাকিতে রিকশা পাওয়া কষ্টকর ব্যাপার। সম্ভব না বলেই আমার ধারণা। লিফট পাওয়া গেলে হত। বিদেশে এই সব ক্ষেত্রে বুড়ো আঙ্গুল তুলে লােকজন দাড়িয়ে থাকে। কারাের দয়’ হলে তুলে নেয়। বাংলাদেশে লিফট প্রথা চালু হয়নি। কার দায় পড়েছে নিজের কেনা গাড়িতে অন্যকে চড়ানাে। 

অবশ্যি এ জাতীয় পরিস্থিতিতে গাড়িওয়ালা মানুষের কাছ থেকে মাঝে মধ্যে আমি উসাহব্যঞ্জক সাড়া পেয়েছি। শুধু উৎসাহব্যঞ্জক বললে ভুল হবে, খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। একবার উত্তরার কাছে এক পান-সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। রাত একটার মত বাজে। পান-সিগারেটের একটা দোকান খােলা। সেও বন্ধের উপক্রম করছে। হেটে হেটে ঢাকায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না।

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১১

একটা মিলিটারী জীপ এসে থামল। জীপের ড্রাইভার নেমে এল সিগারেট কিনতে। ড্রাইভারের পাশে বিষমুখে যে অফিসারটি বসে আছেন মনে হয় তাঁর জন্যেই সিগারেট কেনা হচ্ছে। অফিসার কোন স্তরের বুঝতে পারছি না। এত বিষন্ন কেন তাও বুঝতে পারছি না। যুদ্ধটুদ্ধ হচ্ছে না বলেই মনে হয় বিষন্ন। যুদ্ধ নেই কাজেই কাজও নেই। আমি এগিয়ে গেলাম। তিনি মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।

আমি বললাম, স্যার আপনার গাড়ির পেছনটা তাে ফাঁকা। আপনি কি একজনকে পেছনে বসিয়ে ঢাকা নিয়ে যাবেন? তার খুব উপকার হয়। | অফিসার কিছু বললেন না। একবার আমাকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ইতিমধ্যে ড্রাইভার সিগারেট নিয়ে ফিরেছে। তিনি সিগারেট নিয়ে প্যাকেট খুলে সিগারেট বের করতে শুরু করেছেন। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিতে যাচ্ছে। তিনি ড্রাইভারকে নিচু গলায় কি যেন বললেন—ড্রাইভার অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে নেমে এল। জীপের পেছনটা আমাকে খুলে দিল।। 

আমি উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। সেই অফিসার আমাকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি সিগারেট খেলে ধোঁয়াতে আপনার কি অসুবিধা হবে?”। 

আমি বললাম, ‘অসুবিধা হবে না, স্যার। বরং সুবিধা হবে। অনেকক্ষণ সিগারেট খাচ্ছি না। আপনার সেকেন্ড হ্যান্ড ধোঁয়া পাব।’ 

‘তিনি তাঁর পাকেট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, নিন, সিগারেট নিন। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১১

আমি সিগারেট নিলাম। তিনি জীপের ড্যাসবাের্ডে কি একটা টিপলেন, ওমনি ক্যাসেটে রবীন্দ্র সংগীত শুরু হয়ে গেল — “বধূ কোন আলাে লাগল চোখে | মিলিটারী জীপ হুস-হাস করে অনেক সময়ই আমার পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। সেখান থেকে কখনাে রবীন্দ্র সংগীত ভেসে আসতে শুনিনি। আমার ধারণা মিলিটারী জীপে ক্যাসেট বাজানাের যন্ত্রই থাকে না। আর থাকলেও ট্রাম্পেট জাতীয় বাজনা বাজবে। রবীন্দ্রনাথ না। 

আমি বললাম, স্যার, আমাকে ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি যে কোন জায়গায় নামিয়ে দিলেই হবে। 

বিষন্ন চেহারার ভদ্রলােক তার জবাব দিলেন না। মনে হচ্ছে তিনি আপনমনে গান শুনছেন। মিলিটারীর গান শােনাও অদ্ভুত। মাথা দুলানাে না। পা দুলানাে না। এটেনশন ভঙ্গিতে গান শােনা। 

ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি তিনি আমাকে নামিয়ে দিলেন না। গাড়ি প্রথমেই চলে গেল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। স্যালুটের পর স্যালুট পড়তে লাগল। ভদ্রলােক 

যে বিরাট বড় দরের কেউ এখন বুঝলাম : 

তিনি জ্বীপ থেকে নামলেন। ড্রাইভারকে বললেন, উনাকে তাঁর বাড়িতে পৌছে দাও। 

আমি বললাম, ‘স্যার, কোন দরকার নেই। আমার হেটে অত্যাস আছে?” 

ভদ্রলােক বললেন, ‘অনেক রাত হয়েছে। আপনাকে বাসায় পৌছে দেবে, কোন সমস্যা নেই। নিন আরেকটা সিগারেট নিন। ওয়ান ফর দ্য রােড়। অস্থা, রেখে দিন। প্যাকেটটা রেখে দিন । আমি সিগারেট ছেড়ে দেবার চেষ্টা করছি। আজ লােভে পড়ে কিনে ফেলেছি। 

ড্রাইভার অবশ্যি আমাকে আমার মেস পর্যন্ত নিয়ে গেল না। ক্যান্টনমেন্ট থেকে গাড়ি বের করে সামান্য এগিয়ে কঠিন ব্রেক করে গাড়ি থামাল। তার চেয়ে কঠিন গলায় বলল, ‘নামেন। 

আমি বিনীত ভঙ্গিতে ড্রাইভারকে বললাম, ভাই সাহেব আপনার না আমাকে বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে যাবার কথা? 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১১

‘নামতে বলছি নামেন। 

আমি হড়মুড় করে নেমে পড়লাম। মিলিটারী মানুষ রেগে গিয়ে চড়-থাপ্পর মেরে বসতে পারে। কি দরকার। 

কাজেই আমাদের দেশের গাড়িওয়ালারা পথচারীদের প্রতি একেবারেই যে দয়া দেখান না, তা না। মাঝে মধ্যে দেখান। সেই মাঝে মধ্যেটা আজও হতে পারে। মিষ্টি কথায় চিড়া ভেজে না বলে গাড়িওয়ালাদের মন ভিজবে না কেন। গাড়িওয়ালাদের মন এমনিতেই খানিকটা ভেজা অবস্থায় থাকে। 

আমি ব্যাঙাচিকে নিয়ে গাড়ির সন্ধানে বের হলাম। আমাদের টার্গেট ঝকঝকে নতুন গাড়ি। দামী গাড়ি। পাজেরাে টাইপ। চড়বই যখন দামী গাড়িতেই চড়ি। যেসব গাড়ি পছন্দ হচ্ছে তার কোনটাই দাঁড়াচ্ছে না হােস করে চলে যাচ্ছে। গাড়িগুলি থামানাের একমাত্র উপায় হচ্ছে, রাস্তার ঠিক মাঝখানে কাকতাড়ুয়ার মত দুহাত মেলে দাঁড়ানাে। আমি আর ব্যাঙাচি দুজন হাত ধরাধরি করে রাস্তা আটকালে গাড়ি থামতে বাধ্য। প্রথমে একটা থামবে তার পেছনে আরেকটা।

দেখতে দেখতে সিরিয়াস যানজট লেগে যাবে। গাড়িতে গাড়িতে গিটু। কেউ বুঝতে পারবে না যানজট কেন হচ্ছে। এক সময় গুজব ছড়িয়ে পড়বে— যানজট হচ্ছে কারণ সামনে মিছিল বের হয়েছে, গাড়ি ভাঙ্গাঙ্গি হচ্ছে। বিশ্বাসযােগ্য গুজব বলেই সবাই সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করে ফেলবে। পেছনের গাড়িগুলি তপন চেষ্টা করবে উল্টো দিকে ঘুরাতে। এই চেষ্টার ফলে এমন যানজট হবে যে সারাদিনের জন্যে নিশ্চিন্ত। রাজনৈতিক নেতারা খবর পাবেন যে মিছিল বের হয়েছে, গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে।

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১১

তাঁরা ভাববেন যেহেতু তাঁরা মিছিল করেননি —কাজেই বিপক্ষ দল মিছিল বের করেছে। তাঁরা আন্দোলনে পিছিয়ে পড়েছেন। কি সর্বনাশ! তাঁরা তড়িঘড়ি করে জঙ্গি মিছিল বের করবেন। এবং তখন সত্যি সত্যি শুরু হবে গাড়ি ভাঙ্গাঙ্গি। | পুলিশের টিয়ার গ্যাস নিয়ে ছােটাছুটি। টিয়ার গ্যাসের সেল মারবে কি, মারবে না বুঝতে পারছে না। সরকারী দলের মিছিলে টিয়ার গ্যাসের শেল মারতে খবর আছে। এই হাঙ্গামার মধ্যে কেউ না কেউ মারা যাবে। নাম পরিচয়হীন সেই লাশ নিয়ে পড়ে যাবে কাড়াকড়ি। একদল বলবে এই লাশ বিএনপি কর্মীর, আরেক দল বলবে আওয়ামী লীগের। অথচ কেউ জানে না মৃত মানুষের কোন দল থাকে না। 

আমি ব্যাঙাচিকে আমার সঙ্গে রাস্তায় দাঁড় করাতে রাজি করতে পারলাম । সে চোখ কপালে তুলে বলল, দোস্ত তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি? গাড়ি আমাকে চাপা দিয়ে চলে যাবে। তুই শেষ মুহুর্তে লাফ দিয়ে পার পাবি। আমি তাে লাফও দিতে পারি না। নাম ব্যাঙাচি হলে কি হবে লাফাতে তাে পারি না।। আমি বরং রাস্তার পাশে দাঁড়াই। 

 ব্যাঙাচি চিন্তিত মুখে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। আমি দু’হাত মেলে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ালাম। দেখতে দেখতে ফল পেলাম। প্রায় নতুন একটা পাজেরাে জীপ (আমার খুব পছন্দের গাড়ি। আমার সামনে এসে দাঁড়াল । ড্রাইভারের পাশের সীট থেকে এক সানগ্লাস পরা লােক মাথা বের করে বলল, কি ব্যাপার? 

ভদ্রলােককে খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি বুঝতে পারছি না। সানগ্লাস খুললে হয়ত চিনতে পারব। 

‘আপনি কি চাচ্ছেন? 

‘স্যার, আমরা দুই বন্ধু আপনার কাছে লিফট চাচ্ছি। আমাদের অতীশ দীপংকর রােডে নামিয়ে দিন। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১১

লিফটের জন্যে হাত উচিয়ে গাড়ি থামালেন?” 

‘আসুন, উঠে আসুন : আপনার বন্ধুকেও ডাকুন। 

ব্যাঙাচি গাড়িতে উঠতে উঠতে ফিফিস করে আমাকে বলল, ‘দোস্ত, তাের প্রতিভা দেখে আমি মুগ্ধ। তুই তাে মানব না, মহামানব। গাড়িতে লােকজন না থাকলে আমি তাের পায়ের ধুলা নিতাম।’ 

গাড়ি অতীশ দীপংকর রােডের দিকে গেল না। রমনা থানার সামনে মল । চশমা পরা ভদ্রলােক বললেন, ‘আপনারা নামুন। আমি আপনাদের পুলিশের কাছে হ্যাভওতার প্রব! 

আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?” ‘আমাকে চিনতে পারছেন না?” ‘চেনাচেনা লাগছে। আপনি কি বিখ্যাত কেউ?” 

‘আমি বিখ্যাত কেউ না। আগে একদিন আপনি আমাকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন। আমি গাড়ির কাচ তুলে দিলাম—আপনি বাইরে থেকে ভেংচি কাটছিলেন। নানান অঙ্গভঙ্গি করছিলেন। এখন চিনতে পেরেছেন? 

‘জ্বি। এখন চিনতে পারছি! চোখে সানগ্লাস থাকায় চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল। 

“আজ আবার গাড়ি আটকেছেন। ইউ আর এ পাবলিক ইসেন্স। পুলিশের উচিত আপনাদের সম্পর্কে খোঁজখবর করা। 

ব্যাঙাচি শুকনাে গলায় বলল, ‘স্যার আপনি কিছু মনে করবেন না। আমরা হেটে হেটে অতীশ দীপংকর রােডে চলে যাব। হাঁটাটা স্বাস্থ্যের জন্যেও ভাল । আপনি চলে যান, আনাকে শুধু শুধু দেরি করিয়ে দিলাম। আমরা দুই বন্ধুই আন্তরিক দুঃখিত। আওয়ার এলজি। 

এপলজিতে কাজ হল না। রমনা থানার সেকেন্ড অফিসার বিরসমুখে আমাদের হাজতে ঢুকিয়ে দিলেন। এছাড়া তার উপায়ও ছিল না। যে ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে এসেছেন তিনি এক প্রতিমন্ত্রীর শালা। মন্ত্রীর শালাদের ক্ষমতা মন্ত্রীদের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। মন্ত্রী তাঁর পাজেরাে গাড়ি নিয়ে যত ঘুরেন — তার শালা তার চেয়ে বেশি ঘুরেন। এটাই নিয়ম। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১১

 ব্যাঙাচি পুরােপুরি হকচকিয়ে গেছে। তার করুণ মুখ দেখে মায়া লাগছে। কেঁদেটেদে ফেলবে কিনা বুঝতে পারছি না। সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত এটাই তার প্রথম হাজত বাস। 

ব্যাঙাচি হতভম্ব গলায় বলল, ‘দোস্ত, সর্বনাশ হয়ে গেলাে তাে। আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, ‘সর্বনাশের কি আছে? ‘তাের ভাবী যখন শুনবে আমি হাজতে তখন অবস্থাটা কি হবে বুঝতে পারছিস না? 

‘ভাবী খুশিও হতে পারে। হাজতে থাকা মানে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। ভাবীর তাে খুশি হবারই কথা। 

‘হাজতে খাওয়া-দাওয়া বন্ধু মানে? এরা খেতে দেয় না? 

‘পার হেড এক টাকা পঞ্চাশ পয়সা বাজেট। এই টাকায় কি খাবি? এর আগে একবার হাজতে আমি সারাদিনে একটা কলা খেয়েছিলাম। অবশ্যি বেশে বড় সাইজ কলা। 

‘তুই কি এর আগেও হাজতে ছিলি নাকি?” ‘থাকি মাঝে মধ্যে।’ ‘কি সর্বনাশ বলিস কি? তাের সঙ্গে মেশা, তাে ঠিক হয়নি। 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১২

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *