– সে তাে কেঁদে-কেটে অস্থির। আমাকে বলে কি, কাজল দিতে গিয়ে এ রকম দেখাচ্ছে। একটা চোখে কাজল বেশি পড়েছে – একটায় কম পড়েছে।
‘মা চোখে কাজল দিত? ‘হ্যা। শ্যামলা মেয়েরা যখন চোখে কাজল দেয় তখন অপূর্ব লাগে।
‘কিন্তু বাবা, একটা ব্যাপার কি জান? আমার ধারণা, এই যে স্বপ্নটা দেখছি এটা
‘বাবা।
‘এই যে মারিয়া সম্পর্কে তুমি জানতে চাচ্ছ কেন? ‘তাের মা‘র সঙ্গে মেয়েটার মিল আছে কি–না তা জানার জন্যে।
‘বাবা শশান, তুমি এত সব জানতে চাচ্ছ কারণ মেয়েটার বিষয়ে আমার নিজের কারাে সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আমার অবচেতন মন সেই ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্যে তােমাকে নিয়ে এসেছে।
হতে পারে।। হতে পারে না। এটাই হল ঘটনা। তুমি আমার নিজের তৈরি স্বপ্ন ছাড়া কিছু। ‘পুরাে জগতটাই তাে স্বপ্ন রে বােকা।
‘তুমি সেই স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন। আমি এখন আর স্বপ্ন দেখতে চাচ্ছি না। আরাম করে ঘুমাতে চাচ্ছি। ‘চলে যেতে বলছিস?” ‘হ্যা, চলে যাও। ‘তুই বুমা, আমি পাশে বসে থাকি। ‘কোন দরকার নেই বাবা। তুমি বিদেয় হও।
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। বিষন্ন মুখে চলে গেলেন। তার পরপরই আমার ঘুম ভাঙল। মনটা একটু খারাপই হল। বাবা আরাে কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকলে তেমন কোন ক্ষতি হত না।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২১
আমার বাবা তাঁর পুত্রের জন্য কিছু উপদেশবাণী রেখে গিয়েছিলেন। ব্রাউন প্যাকেটে মােড়া সেইসব উপদেশবাণীর উপর লেখা আছে কত বয়সে পড়তে হবে। আঠারাে বছর হবার পর যে উপদেশবাণী পড়তে বলেছিলেন – তা হল।
পাঠ কর। তরুণ–তরুণীর আকর্ষণের সমগ্র বিষয়টাই পুরাপুরি জৈবিক। ইহা পধর্ম। এই আকর্ষণের ব্যাপারটিকে আমরা নানানভাবে মহিমান্বিত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। প্রেম নিয়া কবি, সাহিত্যিক মাতামাতি করিয়াছেন। চিত্রকররা প্রেমিক-প্রেমিকার ছবি অংকন করিয়াছেন। গীতিকাররা গান রচনা করিয়াছেন। গায়করা সেই গান নানান ভঙ্গিমায় গাহিয়াছেন।
প্রিয় পুত্র, প্রেম বলিয়া জগতে কিছু নাই। ইহা শরীরের প্রতি শরীরের আকর্ষণ। এই আকর্ষণ প্রকৃতি তৈরি করিয়াছেন যাহাতে তাহার সৃষ্টি বজায় থাকে। নর–নারীর মিলনে শিশু জন্মগ্রহণ করিবে। প্রকৃতির সৃষ্টি বজায় থাকিবে।
একই আকর্ষণ প্রকৃতি তাহার সমস্ত জীবজগতে তৈরি করিয়াছেন। আশ্বিন মাসে কুকুরীর শরীর দুই দিনের জন্য উত্তপ্ত হয়। সে তখন কুকুরের সঙ্গের জন্য প্রায় উন্মত্ত আচরণ করে। ইহাকে কি আমরা প্রেম বলিব ? প্রিয় পুত্র, মানুষ ভান করিতে জানে, পশু জানে না – এই একটি বিষয় ছাড়া মানুষের সঙ্গে পশুর কোন তফাৎ নাই। যদি কখনাে কোনাে তরুণীর প্রতি তীব্র আকর্ষণ বােধ কর, তখন অবশ্যই তুমি সেই আকর্ষণের স্বরূপ অনুসন্ধান করিবে। দেখিবে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু তুচ্ছ শরীর। যেহেতু শরীর নম্বর সেহেতু প্রেমও নম্বর।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২১
প্রিয় পুত্র, তােমাকে অনেকদূর যাইতে হইবে। ইহা সুরণ রাখিয়া অগ্রসর হইও। প্রকৃতি তােমার সহায় হউক – এই শুভ কামনা।
হিমালয় তুমি অষ্টাদশ বর্ষে পদার্পণ করিয়াছ। আমার অভিনন্দন। অষ্টাদশ বর্ষকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। এই বয়সে নারী ও পুরুষ যৌবনপ্রাপ্ত হয়। তাহাদের চিন্তা-চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনের ফল শুভ যেমন হয় – মাঝে মাঝে অশুভও হয়।।
প্রিয় পুত্ৰ, তােমাকে আজ আমি তরুণ–তরুণীর আকর্ষণের
আমার বাবা কি আসলেই অপ্রকৃতিস্থ? কাদের আমরা প্রকৃতিস্থ বলব? যাদের চিন্তাভাবনা স্বাভাবিক পথে চলে তাদের। যারা একটু অন্যভাবে চিন্তা করে তাদের আমরা আলাদা করে ফেলি। তা কি ঠিক? আমার বাবা তার পুত্রকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন।
তাঁর ইচ্ছার কথা শােনামাত্রই আমরা তাঁকে উন্মাদ হিসেবে আলাদা করে ফেলেছি। কোন বাবা যদি বলেন, আমি আমার ছেলেকে বড় ডাক্তার বানাব তখন আমরা হাসি না, কারণ তিনি চেনা পথে হাঁটছেন। আমার বাবা তাঁর সমগ্র জীবনে হেঁটেছেন অচেনা পথে। আমি সেই পথ কখনাে অস্বীকার করিনি।
কাটানাের জন্যে কি করা যায়? মন আরাে বিষন্ন হয় এমন কিছু করা। যেমন রূপার সঙ্গে কথা বলা। অনেকদিন তার সঙ্গে কথা হয় না।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২১
মন এখন বিষণ্ড, রূপার সঙ্গে কথা বলার পর মন নতুন করে বিষন্ন হবে। পুরানাে বিষতা এবং নতুন বিষন্নতায় কাটাকাটি হয়ে আমি স্বাভাবিক হব। তারপর যাব আসগর সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর কি ? চিত্রলেখা নামের ঐ বাড়িতে কি যাব? দেখে আসব মারিয়াকে?
অনেকবার টেলিফোন করলাম রূপাদের বাসায়। টেলিফোন যাচ্ছে, রূপাই টেলিফোন ধরছে, কিন্তু সে হ্যালাে বলার সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে যাচ্ছে। প্রকৃতি চাচ্ছে না আমি রূপার সঙ্গে কথা বলি। ফুপার বাড়িতে আজ উৎসব।
বাদল তার কেরােসিন টিন ব্যবহার করতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাশ হয়েছে। খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেছেন। দুই দলের মর্যাদা বহাল আছে। দুদলই দাবি করছে তারা জিতেছে। দুদলই বিজয় মিছিল বের করেছে। সব খেলায় একজন জয়ী হন, অন্যজন পরাজিত হন। রাজনীতির খেলাতেই শুধুমাত্র দুটি দল একসঙ্গে জয়ী হতে পারে অথবা এক সঙ্গে পরাজিত হয়। রাজনীতির খেলা বড়ই মজাদার খেলা। এই খেলায় অংশগ্রহণ তেমন আনন্দের না, দূর থেকে দেখার আনন্দ আছে।
আমি গভীর আনন্দ নিয়ে খেলাটা দেখছি। শেষের দিকে খেলাটায় উৎসব ভাব এসে গেছে। ঢাকার মেয়র হানিফ সাহেব করেছেন জনতার মঞ্চ। সেখানে বক্তৃতার সঙ্গে গান–বাজনা চলছে। | খালেদা জিয়া তৈরি করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চ। সেখানে গান বাজনা একটু কম, কারণ বেশিরভাগ শিল্পীই জনতার মঞ্চে।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২১
তাঁরা গান বাজনার অভাব বক্তৃতায় পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। গণতন্ত্র মঞ্চ একটু বেকায়দা অবস্থায় আছে বলে মনে হচ্ছে। তেমন জমছে না। উদ্যোক্তারা একটু যেন বিমর্ষ। | দুটি মঞ্চ থেকেই দাবি করা হচ্ছে – আমরা ভারত বিরােধী। ভারত বিরােধিতা আমাদের রাজনীতির একটা চালিকাশক্তি হিসেবে উঠে আসছে। ব্যাপারটা বােঝা যাচ্ছে না।
আমাদের স্বাধীনতার জন্যে তাদের সাহায্য নিতে হয়েছিল, এই কারণে কি আমরা কোন হীনমন্যতায় ভুগছি? শুধুমাত্র হীনমন্যতায় ভুগলেই এইসব জটিলতা দেখা দেয়। এই হীনমন্যতা কাটানাের প্রধান উপায় জাতি হিসেবে মাথা উচু করে দাঁড়ানাে। সবাই মিলে সেই চেষ্টাটা কি করা যায় না?
আমাদের সারাদেশে অসংখ্য স্মৃতিস্তম্ভ আছে – যে সব ভারতীয় সৈন্য আমাদের স্বাধীনতার জন্যে জীবন দিয়েছেন তাঁদের জন্যে আমরা কিন্তু কোন স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করিনি। কেন করিনি? করলে কি জাতি হিসেবে আমরা ছােট হয়ে যাব ?
আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা স্বাধীনতা নিয়ে কত চমৎকার সব কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখলেন – সেখানে কোথাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয়। সেনাবাহিনীর অবদানের কোন উল্লেখ নেই। উল্লেখ করলে ভারতীয় দালাল আখ্যা। পাবার আশংকা।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২১
বাংলাদেশে এই রিস্ক নেয়া যায় না। অন্য একটি দেশের স্বাধীনতার জন্যে ওঁরা প্রাণ দিয়েছেন। এঁদের ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীর কাছে অন্য দেশের স্বাধীনতা কোন ব্যাপার না। স্বামীহারা স্ত্রী, পিতাহারা সন্তানদের অশ্রুর মূল্য আমরা দেব না? আমরা কি অকৃতজ্ঞ ?
বাংলাদেশের আদর্শ নাগরিক কি করবে? ভারতীয় কাপড় পরবে। ভারতীয় বই পড়বে, ভারতীয় ছবি দেখবে। ভারতীয় গান শুনবে, ছেলে–মেয়েদের পড়াতে পাঠাবে ভারতীয় স্কুল কলেজে। চিকিৎসার জন্যে যাবে বােম্বাই, ভ্যালাের এবং ভারতীয় গরু খেতে খেতে চোখ-মুখ কুঁচকে বলবে – শালার ইন্ডিয়া। দেশটাকে শেষ করে দিল! দেশটাকে ভারতের খর থেকে বাঁচাতে হবে।
আমাদের ফুপা মদের গ্লাস হাতে নিয়ে বিজ্ঞ বিজ করে বললেন, বুঝলি হিম, দেশটাকে ভারতের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। এটা হচ্ছে রাইট টাইম।
আমি বললাম, অবশ্যই। ‘ইণ্ডিয়ান দালাল দেশে যে কটা আছে, সব কটাকে জুতাপেটা করা দরকার।
আমি বললাম, অবশ্যই। ‘দালালদের নিয়ে মিছিল করতে হবে। সবার গলায় থাকবে জুতার মালা। ‘এত জুতা পাবেন কোথায়? ‘জুতা পাওয়া যাবে। জুতা কোন সমস্যা না। ‘অবশ্যই।
ফুপা অল্প সময়ে যে পরিমাণ মদ্যপান করেছেন তা তার জন্যে বিপজ্জনক।। তাঁর আশে-পাশে যারা আছে তাদের জন্যেও বিপজ্জনক। এই অবস্থায় ফুপার প্রতিটি কথায় ‘অবশ্যই বলা ছাড়া উপায় নেই। | আমরা বসেছি ছাদে। বাদল আগুনে আত্মাহুতি দিচ্ছে না এই আনন্দ সেলিব্রেট করা হচ্ছে। ফুপা মদ্যপানের অনুমতি পেয়েছেন। ফুপু কঠিন গলায় বলে দিয়েছেন – শুধু দুই পেগ খাবে। এর বেশি এক ফোঁটাও না। খবর্দার ! হিমু, তাের উপর। দায়িত্ব, তুই চোখে চোখে রাখবি।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২১
আমি চোখে চোখে রাখার পরেও – ফুপার এখন সপ্তম পেগ যাচ্ছে। তাঁর কথাবার্তা সবই এলােমেলাে। একটু হিক্কার মতােও উঠছে। বমিপর্ব শুরু হতে বেশি দেরি হবে না।।
‘অবশ্যই। ‘দেশমাতৃকা অনেক বড় ব্যাপার। ‘দ্ধি, ঠিকই বলেছেন। দেশপিতৃকা হলে দেশটাকে রসাতলে নিয়ে গেলেও কোন ক্ষতি ছিল না।
‘দেশপিকা আবার কি? ‘ফাদারল্যান্ডের বাংলা অনুবাদ করলাম। ‘ফাদারল্যান্ড কেন বলছিস? জন্মভূমি হল জননী। জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপী। গরিয়সী।
‘ফুপা, আর মদ্যপান করাটা বােধহয় ঠিক হচ্ছে না।
‘খুব ঠিক হচ্ছে। তাের চেখে দেখার ইচ্ছা থাকলে চেখে দেখ। আমি কিছুই মনে করব না। এইসব ব্যাপারে আমি খুবই লিবারেল।
‘আমার ইচ্ছা করছে না ফুপা।
‘ইচ্ছা না করলে থাক। খেতে হয় নিজের রুচিতে, পরতে হয় অন্যের রুচিতে। ঠিক না?
‘অবশ্যই ঠিক। ‘বুঝলি হিমু, দেশ নিয়ে নতুন করে এখন চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে। ভারতের আগ্রাসন বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
Read More