আমি বেশ কয়েকবার তাঁর হাত দেখে দিয়েছি। হস্তরেখা-বিশারদ হিসেবে ভদ্রমহিলার কাছে আমার নাম আছে। তিনি অতি আন্তরিক ভঙ্গিতে আমার সঙ্গে তুই তুই করেন। সেই আন্তরিকতার পরােটাই মেকি। পাঁচ বছর পর এই মহিলাও অবিকল তাঁর স্বামীর মত আচরণ করবেন।
স্বাভাবিক গলায় বলবেন, “কি রে হিমু, তাের খবর কি? দে, হাতটা দেখে দে।” তিনি এ জাতীয় আচরণ করবেন আবেগ চাপা দেবার জন্যে না, আবেগহীনতার জন্যে।। | আর মারিয়া? মারিয়া কি করবে? কিছুই বলতে পারছি না। এই মেয়েটি
সম্পর্কে আমি কখনােই আগেভাগে কিছু বলতে পারিনি। তার আচার–আচরণে বােঝার কোন উপায় ছিল না – একদিন সে এসে আমার হাতে এক টুকরা কাগজ ধরিয়ে দেবে – যে কাগজে সাংকেতিক ভাষায় একটা প্রেমপত্র লেখা।
আমি সেদিন আসাদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে একটা কঠিন বিষয় নিয়ে গল্প করছিলাম। বিষয়বস্তু এক্সপান্ডিং ইউনিভার্স। আসাদুল্লাহ সাহেব বলেছিলেন ইউনিভার্সে যতটুক ভর থাকার কথা, ততটুক নেই – বিজ্ঞানীরা হিসাব মিলাতে পারছেন না। নিউট্রিনাের যদি কোনাে ভয় থাকে তবেই হিসাব মেলে।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২৩
এখন পর্যন্ত এমন কোন আলামত পাওয়া যায়নি যা থেকে বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনােকে কিছু ভর দিতে পারেন। নিউট্রিনাের ভর নিয়ে আমাদের দুজনের দুশ্চিন্তার সীমা ছিল না। এমন দুশ্চিন্তাযুক্ত জটিল আলােচনার মাঝখানে মারিয়া এসে উপস্থিত। সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল — বাবা, আমি হিমু ভাইকে পাঁচ মিনিটের জন্য ধার নিতে পারি?
আসাদুল্লাহ সাহেব বললেন, অবশ্যই।
মারিয়া বলল, পাঁচ মিনিট পরে আমি তাঁকে ছেড়ে দেব। তুমি যেখানে আলােচনা বন্ধ করেছিলে আবার সেখান থেকে শুরু করবে।
আসাদুল্লাহ সাহেব বললেন, আয়। ‘তােমরা আজ কি নিয়ে আলাপ করছিলে? ‘নিউট্রিনাের ভর। ‘ও, সেই নিউট্রিনাে? তার কোন গতি করতে পেরেছ?
না। ‘চেষ্টা করে যাও বাবা। চেষ্টায় কি না হয়।
মারিয়া তার বাবার কাঁধে হাত রেখে সুন্দর করে হাসল। আসাদুল্লাহ সাহেব সেই হাসি ফেরত দিলেন না। গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। তাঁর মাথায় তখনাে। নিউট্রিনাে। আমি তাঁর হয়ে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
মারিয়া বলল, হিমু ভাই, আপনি আমার ঘরে আসুন।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২৩
আমি মারিয়ার ঘরে ঢুকলাম। এই প্রথম তার ঘরে ঢােকা। কিশােরী মেয়েদের ঘর যে রকম হয় সে রকম। ব্ল্যাক ভর্তি স্টাফড় অ্যানিমেল। স্টেরিও সিস্টেম, এল পি রেকর্ড সারা ঘরময় ছড়ানাে। ড্রেসিং টেবিলে এলােমেলাে করে রাখা সাজবার জিনিস। বেশিরভাগ কৌটার মুখ খােলা। কয়েকটা ড্রেস মেঝেতে পড়ে আছে। খাটের
মধ্যে একটা কাপে পিপড়া উঠেছে। নিশ্চয়ই কয়েকদিনের বাসি কাপ, সরানাে হয়নি।
আমি বললাম, তােমার ঘর তাে খুব গােছানাে। | মারিয়া বলল, আমি আমার ঘরে কাউকে ঢুকতে দেই না। মাকেও না, বাবাকেও না। আপনাকে প্রথম ঢুকতে দিলাম। আমার ঘর আমি নিজেই ঠিকঠাক করি। ক‘দিন ধরে মন-টন খারাপ বলে ঘর গােছাতে ইচ্ছা করছে না।
‘মন খারাপ কেন? ‘আছে, কারণ আছে। আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
আমি বসলাম। মারিয়া বলল, আমি সাংকেতিক ভাষায় একটা চিঠি লিখেছি। ‘কাকে ? ‘আপনাকে। আপনি এই চিঠি পড়বেন। এখানে বসেই পড়বেন। সাংকেতিক চিঠি হলেও খুব সহজ সংকেতে লেখা। আমার ধারণা, আপনার বুদ্ধি বেশ ভাল। চিঠির অর্থ আপনি এখানে বসেই বের করতে পারবেন।
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে হবে?
মারিয়াদের বাড়ির নাম – চিত্রলেখা।
আমি দীর্ঘ পাঁচ বছর পর চিত্রলেখার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২৩
‘আমার বুদ্ধি খুবই নিম্নমানের। ম্যাট্রিকে অংকে প্রায় ধরা খাচ্ছিলাম। সাংকেতিক চিঠি তাে অংকেরই ব্যাপার। এখানেও মনে হয় ধরা খাব।।
মারিয়া তার রকিং চেয়ার আমার সামনে টেনে আনল। চেয়ারের উপর থেকে বই নামিয়ে বসে দোল খেতে লাগল। আমি সাংকেতিক চিঠির উপর চোখ বুলিয়ে গেলাম। কিছু বুঝলাম না। তাকালাম মারিয়ার দিকে। সে নিজের মনে দোল খাচ্ছে। আমার দিকে তাকাচ্ছে না। তাকিয়ে আছে দেয়ালের দিকে। সেখানে তার ছােটবেলার একখানা ছবি। আমি বললাম, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।
মারিয়া বলল, বুঝতে না পারলে সঙ্গে করে নিয়ে যান। যেদিন বুঝতে পারবেন সেদিন উত্তর লিখে নিয়ে আসবেন।
‘আর যদি কোনদিনই বুঝতে না পারি?
‘কোনদিন বুঝতে না পারলে আর এ বাড়িতে আসবেন না। এখন উফুন, পাঁচ। মিনিট হয়ে গেছে। আপনাকে বাবার কাছে দিয়ে আসি।
আমি চিঠি হাতে উঠে দাঁড়ালাম।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২৩
মানুষ তাদের বাড়ির নাম কেন রাখে? তাদের কাছে কি মনে হয় বাড়িগুলিও জীবন্ত? বাড়িদের প্রাণ আছে – তাদেরও অদৃশ্য হৃদপিণ্ড ধ্বক ধক করে?
কলিংবেল টিপে অপেক্ষা করছি। কেউ এসে গেট খুলছে না। দারােয়ান তার খুপড়ি ঘর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েছে। আসছে না – কারণ উৎসাহ পাচ্ছে না। ঝকঝকে গাড়ি নিয়ে কেউ এলে এরা উৎসাহ পায়। ছুটে এসে গেট খুলে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ায়। যারা দুপুরের রােদে ঘামতে ঘামতে আসে তাদের বেলা ভিন্ন নিয়ম।
ধীরে সুস্থে এসে ধমকের গলায় বলবে – কাকে চান? দারােয়ানদের ধমক খেতে ইন্টারেস্টিং লাগে। এরা নানান ভঙ্গিতে ধমক দিতে পারে। কারাে ধমকে থাকে শুধুই বিরক্তি, কারাে ধমকে রাগ, কারাে ধমকে আবার অবহেলা। একজনের ধমকে প্রবল ঘৃণাও পেয়েছিলাম। তার ঘৃণার কারণ স্পষ্ট হয়নি।
আমি আবারও বেল টিপে অপেক্ষা করত লাগলাম। আমার এমন কিছু তাড়া নেই। ঘণ্টাখানিক গেটের সামনে দাড়িয়ে থাকতে পারি। তাড়া থাকে ভিখিরীদের। তাদের এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যেতে হয়। সময় তাদের কাছে খুবই মূল্যবান। আমার কাছে সময় মূল্যহীন। চিত্রলেখা নামের চমৎকার একতলা এই বাড়িটার সামনে একঘণ্টা দাড়িয়ে থাকাও যা, দুঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকাও তা।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২৩
সময় কাটানাের জন্যে কিছু একটা করা দরকার। বাড়ির নাম নিয়ে ভাবা যেতে পারে। আচ্ছ, মানুষের নামে যেমন পুরুষ–রমণী ভেদাভেদ আছে – বাড়ির নামেও কি তাই আছে? কোন কোন বাড়ি হবে পূরুবাড়ি। কোন কোন বাড়ি রমণীবাড়ি। চিত্ৰলেখা নিশ্চয়ই রমণীবাড়ি। সুগন্ধা, শ্রাবণী, শিউলীও মেয়েবাড়ি। পুরুষবাড়ির কোন নাম মনে পড়ছে না। এখন থেকে রাস্তায় হাঁটার সময় বাড়ির নাম পড়তে পড়তে যেতে হবে, যদি কোন পুরুষবাড়ির নাম চোখে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা ভাল করে দেখতে হবে।।
আমাকে প্রায় ঘণ্টাখানিক অপেক্ষা করতে হল – এর মধ্যে দারােয়ান শ্রেণীর একজন গেটের কাছে এসেছিল। গেট খুলতে বলায় সে বলল, যার কাছে চাবি সে ভাত খাচ্ছে। ভাত খাওয়া হলে সে খুলে দেবে।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২৩
আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনি কি চাবিটা এনে একটু খুলে দিতে পারেন না? এই কথায় সে বড়ই আহত হল। মনে হল তার সুদীর্ঘ জীবনে সে এমন অপমানসূচক কথা আর শােনেনি। কাজেই আমি বললাম, আচ্ছা থাক, আমি অপেক্ষা করি। আপনার কাছে ছাতা থাকলে আমাকে কিছুক্ষণের জন্যে দিন। আমি ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে থাকি,
প্রচণ্ড রােদ।
সে এই রসিকতাতেও অপমানিত বােধ করল। বড় মানুষের বাড়ির কাজের মানুষদের মনে অপমানবোেধ তীব্র হয়ে থাকে।
‘আপনে কার কাছে আসছেন? ‘মারিয়ার কাছে। ‘আপা নাই। না থাকলেও আসবে – আমি অপেক্ষা করব। গেট খুলে দিন। ‘গেট খুলনের নিয়ম নাই।
আগের দারােয়ানদের কেউ নেই – সব নতুন লােকজন। আগেকার কেউ হলে চিনতে পারত। এত ঝামেলা হত না। আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ডাইসাহেব, আপনার নাম?
‘আমার নাম আবদুস সােবহান।
‘সােবহান সাহেব আপনি শুনুন – আমি খুব পাগলা কিসিমের লােক। গেট না খুললে গেটের উপর দিয়ে বেয়ে চলে আসব। আপনার সাহেবের কাছে গিয়ে বলুন – হিমু এসেছে।
‘ও অচ্ছা, আপনে হিমু? আপনের কথা বলা আছে। | দারােয়ান ব্যস্ত হয়ে গেট খুলতে লাগল।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২৩
আমাকে এসকর্ট করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিশাল ড্রয়িংরুম পার হয়ে খানিকটা। খােলামেলা জায়গায় চলে এসেছি। কোন ফার্নিচার নেই। ঘরময় কার্পেট। এটা ফ্যামিলি রুম। ফ্যামিলির সদস্যরা এই ঘরে গল্প-গুজব করে, টিভি দেখে। যাদের ফ্যামিলি যত ছােট তাদের ফ্যামিলি রুমটা তত বিশাল। মারিয়াদের ড্রয়িংরুম আগের মতই ছিল, তবে ফ্যামিলি রুমের সাজসজ্জা বদলেছে। প্রকাণ্ড এক পিয়ানাে দেখতে পাচ্ছি। পিয়ানাে আগে ছিল না। পিয়ানাে কে বাজায় ? মারিয়া?
ফ্যামিলি রুমে কার্পেটের উপর হাসি খালাকে বসে থাকতে দেখলাম। তিনি তার দুহাত মেলে ধরেছেন। সেই হাতের নখে নেল পলিশ লাগাচ্ছেন সিরিয়াস চেহারার এক ভদ্রলোেক। ভদ্রলােকের চোখে সােনালী চশমা, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। তিনি খুব একটা বাহারী পাঞ্জাবি পরে আছেন। ভদ্রলােক নিশ্চয়ই বিখ্যাত ও ক্ষমতাবানদের কেউ হবেন। এ বাড়িতে বিখ্যাত ও ক্ষমতাবান ছাড়া অন্য কারাে প্রবেশাধিকার নেই। নেল পলিশ লাগানাের ব্যাপারে ভদ্রলােকের মনােযােগ দেখে মনে হচ্ছে কাজটা অত্যন্ত
জটিল। হাসি খালাও নড়াচড়া করছেন না। স্থির হয়ে আছেন। হাসি খালা এক ঝলক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হিমু, তাের কি খবর?
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২৩
কোন খবর নেই।।
‘মারিয়া বলেছিল তুই আসবি।
যে জ্বলােক নেল পলিশ লাগাচ্ছেন তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, হাসি, নড়াচড়া করবে না। নড়লে আঙুল নড়ে যায়।
আমি বললাম, খালা, হচ্ছে কি?
হাসি খালা বললেন, কি হচ্ছে তা তাে দেখতেই পাচ্ছিস। নতুন কায়দায় নেল পলিশ লাগানাে হচ্ছে। নখের গােড়ায় কড়া লাল রঙ। আস্তে আস্তে নখের মাথায়। এসে রঙ মিলিয়ে যাবে।
জটিল ব্যাপার মনে হচ্ছে। ‘জটিল তাে বটেই। জিনিসটা দাড়ায় কেমন সেটা হচ্ছে কথা। এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট।
ভদ্রলােক আরেকবার বিরক্ত গলায় বললেন – হাসি, প্লীজ।
আমি কিছুক্ষণ নেল পলিশ দেয়া দেখলাম। গাঢ় লাল, হালকা লাল, সাদা – তিন রঙের কৌটা, নেল পলিশ রিমুভার নিয়ে প্রায় স্কুলস্থূল ব্যাপার হচ্ছে।হাসি খালা বললেন, জামিল, তােমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি। এ হচ্ছে হিমু। ভাল নাম এভারেস্ট, কিংবা হিমালয়। মারিয়ার বাবার অনেক আবিষ্কারের এক আবিষ্কার। খুব ভাল হাত দেখতে পারে। হাত দেখে যা বলে তাই হয়।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২৩
ভদ্রলােক চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললেন। আমি সামনে থেকে সরলে তিনি বাচেন এই অবস্থা। আমি বিনয়ী গলায় বললাম, স্যার, ভাল আছেন? ভদ্রলােক বললেন, ইয়েস, আই অ্যাম ফাইন। থ্যাংক অ্য। ‘আপনার নেল পলিশ দেয়া খুব চমৎকার হচ্ছে, স্যার।
ভদ্রলােকের দৃষ্টি কঠিন হয়ে গেল। হসি খালা বললেন – তুই যা, মারিয়ার বাবার সঙ্গে দেখা করে আয়। আর পােন, চলে যাবার আগে আমার হাত দেখে দিবি। জামিল, তুমি কি হিমুকে দিয়ে হাত দেখাবে?
জামিল নামের ভদ্রলােক নেল পলিশের রঙ মেশানাের ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শীতল গলায় বললেন – এইসব আধিভৌতিক ব্যাপারে আমার বিশ্বাস নেই।
আমি বললাম, আধিভৌতিক বলে কিছু উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না, স্যার। অ্যাস্ট্রলজি ছিল আধিভৌতিক ব্যাপার।
Read More