আমি দেখব আমার নিজের জীবন, আমার কেরিয়ার।।
‘খুবই ভাল কথা।
আমি উঠে দাড়ালাম। মারিয়া বলল, ও আচ্ছা, আরাে কয়েক মিনিট বসুন, আপনাকে নিয়ে কি সব পাগলামি করেছি তা বলে নেই। আপনার শােনার শখ ছিল। আমি বসলাম। মারিয়া আমার দিকে একটু ঝুঁকে এল। দামী কোন পারফিউম সে গায়ে দিয়েছে। পারফিউমের হালকা সুবাস পাচ্ছি। হালকা হলেও সৌরভ নিজেকে জানান দিচ্ছে কঠিনভাবেই। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। মারিয়ার চুল খােলা। এই খােলা চুল ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। কিছু এসে পড়ছে আমার মুখে। ভয়াবহ সুন্দর একটি দৃশ্য।
‘হিমু ভাই।
‘বাবার সঙ্গে মার কিভাবে বিয়ে হয়েছিল সেটা কি আপনি জানেন?
না, জানি না। ঐ গল্প থাক – তােমার গল্পটা বল। কিশােরী বয়সে কি পাগলামি করলে?
‘আমার গল্পটা বলছি কিন্তু মার গল্পটা না শুনলে আমারটা বুঝতে পারবেন। মা হচ্ছেন বাবার খালাতাে বােন। মা যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়তেন তখন বাবার জন্যে মার মাথা খারাপের মত হয়ে গেল। বলা চলে পুরাে উন্মাদিনী অবস্থা। বাবা সেই অবস্থাকে তেমন পাত্তা দিলেন না। মা কিছু ডেসপারেট মৃত নিলেন।
তাতেও লাভ হল না। শেষে একদিন বাবাকে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখে সিনেমার প্রেমিকাদের মত একগাদা ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেললেন। মা’র জীবন সংশয় হল। এখন মরে তখন মরে অবস্থা। বাবা হাসপাতালে মাকে দেখতে গেলেন। মা’র অবস্থা দেখে তার করুণা হল। বাবা হাসপাতালেই ঘােষণা করলেন – মেয়েটা যদি বাচে তাকে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি নেই। মা বেঁচে গেলেন। তাদের বিয়ে হল। গল্পটা কেমন?
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম শেষ খন্ড
‘ইন্টারেস্টিং।
‘ইন্টারেস্টিং না, সিনেমাটিক। ক্লাসিক্যাল লাভ স্টোরি। প্রেমিককে না পেয়ে আত্মহননের চেষ্টা। এখন হিমু ভাই, আসুন, মার ক্ষেত্রে বাবার নীলপদ্ম থিওরি অ্যাপ্লাই করি। থিওরি অনুযায়ী মা তার নীলপদ্মগুলি বাবাকে দিয়েছিলেন – সব ক’টা দিয়ে দিয়েছিলেন। তাই যদি হয় তাহলে পড়ন্ত যৌবনে মা জামিল চাচাকে দেয়ার জন্যে নীলপদ পেলেন কোথায়? জামিল চাচা বিবাহিত একজন মানুষ। তার বড় মেয়ে মেডিকেলে পড়ছে। তিনি যখন-তখন এ বাড়িতে আসেন। মা’র শােবার ঘরে দুজনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেন। শােবার ঘরের দরজাটা তারা পুরােপুরি বন্ধও করেন না, আবার খােলাও রাখেন না। সামান্য ফাক করে রাখেন। মজার ব্যাপার না?
আমি কিছুই বললাম না। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে মারিয়ার হাসি হাসি মুখের।
একটা সময়ে আমি পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। ভয়ংকর কষ্টের কিছু সময় পার করেছি। রাতে ঘুম হত না। রাত্রে পর রাত জেগে থাকার জন্যেই হয়ত মাথাটা খানিকটা এলােমেলাে হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ব্যাপার হত। অনেকটা হেলুসিনেশনের মত।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম শেষ খন্ড
মনে করুন পড়তে বসেছি, হঠাৎ মনে হল আপনি পেছনে এসে দাড়িয়েছেন। আমার বই-এ আপনার ছায়া পড়েছে। তখন বুক ধুক ধুক করতে থাকত। চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখতাম – কেউ নেই। আপনাকে তখনই চিঠিটা লিখি। আপনি তার জবাব দেননি। আমাদের বাড়িতে আর আসেননি। ‘না এসে ভালই করেছি। তােমার সাময়িক আবেগ যথাসময়ে কেটে গেছে। তুমি ভুল ধরতে পেরেছ।
‘হ্যা, তা পেরেছি। ঐ সময়টা ভয়ংকর কষ্টে কষ্টে গেছে। রােজ ভাবতাম, আজ আপনি আসবেন। আপনি আসেননি। আপনার কোন ঠিকানা নেই আমাদের কাছে যে আপনাকে খুঁজে বের করব। আমার সে বছর এ লেভেল পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। আমার পরীক্ষা দেয়া হয়নি। প্রথমত, বই নিয়ে বসতে পারতাম না। দ্বিতীয়ত, আমার মনে হত আমি পরীক্ষা দিতে যাব আর আপনি এসে আমাকে না পেয়ে ফিরে যাবেন। আমি রােজ রাতে দরজা বন্ধ করে কাঁদতাম।।
বলতে বলতে মারিয়া হাসল। কিন্তু তার চোখে অনেকদিন আগের কান্নার ছায়া। পড়ল। এই ছায়া সে হাসি দিয়ে ঢাকতে পারল না।
আমি বললাম, তারপরেও তুমি বলছ নীলপদ্ম কিছু না – পুরাে ব্যাপারটাই জৈবিক?
‘হা বলছি। তখন বয়স অল্প ছিল। তখন বুঝতে পারিনি, এখন বুঝছি। চারপাশে কি ঘটছে তা দেখে শিখছি।
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, তােমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য খুবই দুঃখিত। ‘চলে যাচ্ছেন? ‘আপনার চিঠি নিয়ে যান। আট তারার চিঠি। এই হাস্যকর চিঠির আমার
মারিয়া তার হাত এগিয়ে দিল। মারিয়ার হাত দেখার জন্যে আমি আবার বসলাম।
‘খুব ভাল করে দেখবেন। বানিয়ে বানিয়ে বলবেন না।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম শেষ খন্ড
‘তােমার খুব সুখের সংসার হবে। স্বামী-স্ত্রী এবং একটি কন্যার অপূর্ব সংসার। কন্যাটির নাম তুমি রাখবে — চিত্রলেখা। মারিয়া খিল খিল করে হাসতে হাসতে হাত টেনে নিয়ে গভীর গলায় বলল – থাক, আপনাকে আর হাত দেখতে হবে না। বানিয়ে বানিয়ে উদ্ভট কথা! আমি আমার মেয়ের নাম চিত্রলেখা রাখতে যাব কেন? দেশে নামের আকাল পড়েছে যে বাড়ির নামে মেয়ের নাম রাখব? যাই হােক, আমি অবশ্যি ভবিষ্যত জানার জন্য আপনাকে হাত দেখতে দেইনি। আমি আপনার হাত কিছুক্ষণের জন্য ধরতে চাচ্ছিলাম। এম্নিতে তাে আপনি আমার হাত ধরবেন না। কাজেই অজুহাত তৈরি করলাম। হিমু ভাই, আপনি এখন যান। প্রচণ্ড রােদ উঠেছে, রােদে আপনার বিখ্যাত হাঁটা শুরু করুন।
মারিয়ার গলা ধরে এসেছে। সে আবার মাথা নিচু করে ফেলেছে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে আমার ভেতর এক ধরনের বিভ্রম তৈরি হল। মনে হল আমার আর হাঁটার প্রয়ােজন নেই। মহাপুরুষ না, সাধারণ মানুষ হয়ে মমতাময়ী এই তরুণীটির পাশে এসে বসি। যে নীলপদ্ম হাতে নিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম, সেই পদ্মগুলি তার হাতে তুলে দেই। তারপরই মনে হল –এ আমি কি করতে যাচ্ছি। আমি হিমু — হিমালয়।
মারিয়া বলেছিল সে গেট পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিতে আসবে না। কিন্তু সে এসেছে। গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ভেতর মনে হচ্ছিল মারিয়া চাপা রঙের শাড়ি পরে আছে, এখন দেখি শাড়ির রঙ নীল। রােদের আলােয় রঙ বদলে গেল, নাকি প্রকৃতি আমার ভেতর বিভ্রম তৈরি করা শুরু করেছে ?
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম শেষ খন্ড
‘হিমু ভাই? ‘বল।। যাবার আগে আপনি কি বলে যাবেন আপনি কে? আমি বললাম, মারিয়া, আমি কেউ না। I am nobody ।
আমি আমার এক জীবনে অনেককে এই কথা বলেছি – কখনাে আমার গলা ধরে যায়নি, বা চোখ ভিজে ওঠেনি। দুটা ব্যাপারই এই প্রথম ঘটল।
মারিয়া হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
দরকার নেই।
আমি চিঠি নিয়ে পকেটে রাখলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, আসাদুল্লাহ সাহেবের নীলপদ থিওরি ঠিক আছে। এই তরুণী তার সমস্ত নীলপদ্ম হিমু নামের এক ছেলের হাতে তুলে দিয়ে তীব্র কষ্ট ও যন্ত্রণার ভেতর বাস করছে। এই যন্ত্রণা, এই কষ্ট থেকে তার মুক্তি নেই। আমি তাকালাম মারিয়ার দিকে। সে এখন মাথা নিচু করে বসে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। অশ্রু গােপন করার জন্যে মেয়েরা ঐ ভঙ্গিটা মাঝে মাঝে ব্যবহার করে।
‘মারিয়া। ‘জি। ‘ভাল থেকো। ‘আমি ভালই থাকব। ‘যাচ্ছি, কেমন?
“আচ্ছা যান। আমি যদি বলি – আপনি যেতে পারবেন না, আপনাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে আপনি কি থাকবেন? থাকবেন না। কাজেই যেতে চাচ্ছেন, যান।
‘গেট পর্যন্ত এগিয়ে দাও!
‘না। ও আচ্ছা, আমার হাতটা দেখে দিয়ে যান। আমার ভবিষ্যৎটা কেমন হবে। বলে দিয়ে যান।
প্রচণ্ড রােদে আমি হাঁটছি। ঘামে গা ভিজে চপচপে হয়ে গেছে। বড় রাস্তায় এসে জামের ভেতর পড়লাম, কার যেন বিজয় মিছিল বের হয়েছে। জাতীয় পার্টির মিছিল। ব্যানারে এরশাদ সাহেবের ছবি আছে। আন্দোলনের শেষে সবাই বিজয়।
Read More