হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১২     

অনুষ্ঠান সন্ধ্যায়। বিকেলে এক অদ্ভুত ব্যাপার হলো। অবাক হয়ে দেখি দূর দূর থেকে গাড়ি নিয়ে বাঙালী ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। শুনলাম মিজান নাকি আশপাশের যত ইউনিভার্সিটি আছে সব ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশ নাইটের খবৰ দিয়ে চিঠি দিয়েছিল। দেড় হাজার মাইল দূরে মন্টানাে স্টেট ইউনিভার্সিটি, সেখান থেকে একটি মেয়ে গ্রে হাউণ্ড বাসে করে একা একা চলে এসেছে। মিনেসােটা থেকে এসেছে দশজনের একটা বিরটি দল। তারা সঙ্গে নানান রকম পিঠা নিয়ে এসেছে।

হোটেল গ্রেভার ইন

গ্রাও ফোকস থেকে এসেছেন করিম সাহেব, তার ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রী। এই অসম্ভব কর্মঠ মহিলাটি এসেই আমাদের খিচুড়ি ফেলে দিয়ে নতুন খিচুড়ি বসালেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে সাউথ ডাকোটার ফলস স্প্রিং থেকে একদল ছেলেমেয়ে এসে উপস্থিত হল।

মিজান আনন্দে লাফাবে না চেঁচাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। চুপচাপ বসে আছে, মাঝে মাঝে গম্ভীর গলায় বলছে –দেখ শালা বাংলাদেশ কী জিনিস। শালা দেখে যা।

অনুষ্ঠান শুরু হল দেশাত্মবােধক গান দিয়ে।

—এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি …।অন্যান্য স্টেট থেকে মেয়েরা যারা এসেছে তারাই শুধু গাইছে। এত সুন্দর গাইছে। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে গান শুনে দেশের জন্যে আমার বুক হু-হু করতে লাগল। চোখে জল এসে গেল। কেউ যেন তা দেখতে না পায় সে জন্যে মাথা নিচু করে বসে রইলাম।

পরদিন ফার্গো ফোরম পত্রিকায় বাংলাদেশ নাইট সম্পর্কে একটা খবর ছাপা হল। খবরের অংশবিশেষ এ রকম–একটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতির অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় দেশের গান দিয়ে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম গান শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা সব কাদতে শুরু করল। আমি আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা-জীবনে এমন মধুর দৃশ্য দেখিনি …।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১২ 

কিসিং বুথ

আমেরিকানদের বিচিত্র কাণ্ডকারখানার গল্প বলার সময় কিসিং বুথের গল্পটা আমি খুব আগ্রহ করে বলি। শ্রোতারা চোখ বড় বড় করে শােনে। যুবক

বয়েসীরা গল্প শেষ হবার পর মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হয়ত-ব| ভাবে, অহা

তারা কী ই না আছে।

গল্পটা বলা যাক।

আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে “হােম কামিং” বলে একটি উৎসব হয়। এই উৎসবে আনন্দ মিছিল হয়, হৈচৈ গান-বাজনা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচে সুন্দরী ছাত্রীটিকে হোম কামিং কুইন নির্বাচিত করা হয়। এই হােম কামিং রানীকে ঘিরে সারাদিন ধরে চলে আনন্দ-উল্লাস।

আমার আমেরিকাবাসের প্রথপুষে হােম কামিং কুইন হল আণ্ডার-গ্রাজুয়েট ক্লাসের এক ছাাস্ত্রী। স্পেণীশ আমেরিকান, রূপ ফেটে পড়ছে। কিছুক্ষণ এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে বুকের মধ্যে এক ধরনের হাহাকার জমে উঠতে থাকে, জগৎ-সংসার তুচ্ছ বােধ হয়। সম্ভবত এই শ্রেণীব রূপবতীদের প্রসঙ্গেই বল। হয়েছে, মুনীগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল।

মেয়েটিকে নিয়ে ভাের এগারোটার দিকে একটা মিছিল বের হল। আমার ইচ্ছা করল মিছিলে ভীড়ে যাই। শেষ পর্যন্ত লজ্জা লাগল। ল্যাবরেটরীতে চলে এলাম। অনেকগুলি স্যাম্পল জমা হয়েছে। এদের এক্সরে ডিফ্রেকশান প্যাটার্ন জানতে হবে। ডিফ্লেকশান মেশিনটা ভাল কাজ করছে না। ছবি পরিষ্কার আসছে না। দুপুর একটা পর্যন্ত কাজ করলাম। ঠিক করে রাখলাম লাঞ্চ সারার ন্যে আধ ঘন্টার বিরতি দেব।

মেমােরিয়াল ইউনিয়নে লাঞ্চ খেতে গিয়েছি। লক্ষ্য করলাম মেমােরিয়াল ইউনিয়নের দোতলায় অস্বাভাবিক ভীড়। কৌতূহলী হয়ে দেখতে গেলাম।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১২ 

জটলা আমাদের হােম কামিং কুইনকে ঘিরেই। এই রূপবতী বড় বড় পােস্টার স্যজ্জাচ্ছে। পােস্টারগুলিতে লেখা ও নীল তিমিরা আজ বিপন্ন। নীল তিমিদের বাচান।

জানা গেল এই হােম কামিং কুইন—নীল তিমিদের বাঁচও-সংঘের একজন কমী। সে আজ নীল তিমিদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করবে।

নীল তিমিদের ব্যাপারে আমি তেমন কোন আগ্রহ বােধ করলাম না। মানুষই যেখানে বিপন্ন সেখানে নীল তিমি নিয়ে লাফালাফি করার কোন অর্থ হয় না। তবু পঁড়িয়ে আছি। রূপবতী মেয়েটির আনন্দোজ্জ্বল মূর্তি দেখতে ভাল লাগছে।

আমি লক্ষ্য করলাম, কাঠগড়ার মত একটা বেষ্টনী তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে লাল কালিতে ঠোটের ছবি এঁকে নিচে লেখা হল “কিসিং বুথ”—চুম্বন কক্ষ। তার নিচে লেখা চুমু খাবার নিয়মকানুন।

(১) জড়িয়ে ধরবেন না, মুখ বাড়িয়ে চুমু খান। {২} চুমু খাবার সময় খুবই সংক্ষিপ্ত। (৩) প্রতিটি চুমু এক ডলার। (৪) চেক গ্রহণ করা হবে না। ক্যাশ দিতে হবে। (৫) বড় নােট গ্রহণযােগ্য নয়।

ব্যাপারটা কী কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার পাশে পঁড়ানাে আমেরিকান ছাত্র বুঝিয়ে দিল।

হােম কামিং কুইন কিসিং বুথে পঁড়িয়ে থাকবে। অন্যরা তাকে চুমু খাবে এবং প্রতিটি চুমুতে এক ডলার করে দেবে। সেই ডলার চলে যাবে নীল তিমি বঁচাও ফাণ্ডে।

আমি হতভম্ব।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১২ 

প্রথমে মনে হল পুরাে ব্যাপারটাই হয়ত এক ধরনের রসিকতা। আমেরিকানরা রসিকতা পছন্দ করে। এটাও বােধ হয় মজার রসিকত।

দেখা গেল ব্যাপারটা মােটেই রসিকতা নয়। মেয়েটি কিসিং বুথে পঁাড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে লাইন। এক একজন এগিয়ে আসছে, ডলার দিচ্ছে, মেয়েটিকে চুমু খেয়ে সরে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে দ্বিতীয় জন। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি।

মেয়েটির মুখ হাসি হাসি। তার নীল চোখ ঝকমক করছে। যেন পুরাে ব্যাপারটায় সে খুবই আনন্দ পাচ্ছে। আনন্দ ছেলেরাও পাচ্ছে। একজনকে দেখলাম দশ ডলারের একটা নােট দিয়ে পর পর দশবার চুমু খেল। এতেও তার স্বাদ মিটল না। মানি ব্যাগ খুলে বিশ ডলারের আরেকটি নােট বের করে উঁচু করে সবাইকে দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড হাত তালি, যার মানে চালিয়ে যাও।

ইউনিভার্সিটির মেথর, ঝাড়ুদার এরাও ডলার নিয়ে এগিয়ে এল। এরা বেশ গম্ভীর। যেন কোন পবিত্র দায়িত্ব পালন করছে। চুমু খেল খুবই শালীন ভঙ্গিতে মন্দিরের দেবীমূর্তিকে চুমু খাবার ব্যবস্থা থাকলে হয়ত এভাবেই খাওয়া হত।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতীয় ছাত্ররা চলে এল। এরা চুমু খাবার লাইনে দাড়াল না। এক জায়গায় দাড়িয়ে জটলা পাকাতে লাগল। এ ওকে ঠেলাঠেলি করছে। কেউ যেতে চাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত একজন এগিয়ে এল, এর নাম উমেশ। বােমের ছেলে। মানুষ যে বানর থেকে এসেছে এটা উমেশকে দেখলেই বােঝা যায়। তার জন্যে ডারউইনের বই পড়তে হয় না। উমেশ চুমু খাবার পর পরই অন্য ভারতীয়দের লজ্জা ভেঙে গেল। তারও লাইনে দাড়িয়ে গেল। আমি ল্যাবরেটরীতে চলে এলাম। আমার প্রফেসর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই এক্সরের কাজ কী হচ্ছে তার খােজ নিতে এলেন। ডিকেশন প্যাটার্ন দেখতে দেখতে বললেন, তুমি কি ঐ মেয়েটিকে চুমু খেয়েছ?

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১২

আমি বললাম, না। না কেন? মাত্র এক ডলারে এমন রূপবতী একটি মেয়েকে চুমু খাবার সুযােগ নষ্ট করা কি উচিত?

আমি বললাম, এভাবে চুমু খাওয়াটা আমাদের দেশের নীতিমালায় বাধা

ও বাধা কেন? চুমু হচ্ছে ভালবাসার প্রকাশ। তুমি যদি তােমার শিশুকন্যাকে প্রকাশ্যে চুমু খেতে পার তাহলে একটি তরুণীকে চুমু খেতে পারবে না কেন? মূল ব্যাপারটা হচ্ছে ভালবাসা

আমি বললাম, এই মেয়েটির ব্যাপারে তো ভালবাসার প্রশ্ন আসছে না।

তিনি অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, আসবে না কেন? এই মেয়েটিকে তুমি হয়ত ভালবাসছ না, কিন্তু তার রূপকে তুমি ভালবাসছ। বিউটি ইজ টুথ। তাই নয়

আমি চুপ করে রইলাম। তিনি বললেন, একটি নির্জন দ্বীপে যদি তােমাকে ঐ মেয়েটির সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হত তাহলে তুমি কী করতে? চুপ করে বসে থাকতে?

আমি নিচু গলায় বললাম, মুনীগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল। অধ্যাপক বিরক্ত গলায় বললেন, এর মানে কি? আমি ইংরেজীতে ঠিক ব্যাখ্যা করে দিলাম। অধ্যাপক পরম প্রীত হলেন। আমি বললাম, তুমি কি চুমু খেয়ে এসেছ? না।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৩ 

 

 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *