হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৩   

এখন ভীড় বেশি। ভীড়টা কমলেই যাব।

হোটেল গ্রেভার ইন

বিকেল চারটায় এক্সরে টেকনিশিয়ান ছুটে এসে বলল, বসে আছাে কেন? এক্ষুণি মেমােরিয়েল ইউনিয়নে চলে যাও। কুইক। কুইক।

ও চারটা থেকে চারটা ত্রিশ, এই আধঘন্টার জন্যে চুমুর দাম কমানো হয়েছে। এই আধঘন্টার জন্যে ডলারে দুটো করে চুমু। | টেকনিশিয়ান যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিল তেমনি ঝড়ের গতিতেই চলে গেল। আমি গেলাম দেখতে। লাইন এখনও আছে। লাইনের শুরুতেই উমেশকে দেখা গেল। সে মনে হয় লাইনে লাইনেই আজকের দিনটা কাটিয়ে দিচ্ছে। আমার প্রফেসরকেও দেখলাম। এক ডলারের একটা নােট হাতে দাড়িয়ে। তিনি আমাকে দেখে হাত ইশারা করে ডাকলেন।

গস্পটা আমি এই জায়গাতে শেষ করে দেই। শ্রোতারা ব্যাকুল হয়ে জানতে চায়, আপনি কি করলেন? বঁড়ালেন লাইনে ?

আমি তাদের বলি, আমি লাইনে দাঁড়ালাম কি দাড়ালাম না, তা মূল গল্পের জন্যে অনাবশ্যক।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৩  

ও অনাবশ্যক হোক আর না হােক, আপনি দাঁড়ালেন কি না বলুন।

আমি কিছুই বলি না। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসি। যে হাসির দু’রকম অর্থই হতে পারে।

প্রথম তুষারপাত

ভিসকোমিটারটা ঠিকমত কাজ করছিল না। একেক সময় একেক রকম রিডিং দিচ্ছে। আমার সঙ্গে কাজ করে পাল রেইমেন। ভিসকোমিটার কাজ করছে

শুনে সে কোথেকে লম্বা একটা ক্রু ড্রাইভার নিয়ে এল এবং পটপট করে ভিসকোমিটারের সব অংশ খুলে ফেলল। আমি মনে মনে বললাম, বাহ বেশ ওস্তাদ ছেলে তাে। এত জটিল যন্ত্র অথচ কী অবলীলায় খুলে ফেলল।

আমি বললাম, পল ! তুমি কি এই যন্ত্র সম্পর্কে কিছু জান? পল বলল, না ! আমি অবাক হয়ে বললাম, জান না তাহলে এটা খুলে ফেললে যে? ও দেখি ব্যাপারটা কী?

পল ভিসকোমিটারের স্ত্রীং খুলে বের করে আনল এবং দু’হাতে কিছুক্ষণ টানাটানি করে বলল-এটা গেছে। বলেই ক্রু ড্রাইভার নিয়ে উঠে চলে গেল। আমি টেবিলের উপর একগাদা যন্ত্রপাতির অংশ ছড়িয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। কী করব কিছু বুঝতে পারলাম না।

আমেরিকানদের এই বিচিত্র অভ্যাসটি সম্পর্কে বলা দরকার। আমি এর নাম দিয়েছি ক্রু ড্রাইভার প্রেম। সব আমেরিকানদের পকেটে কয়েক সাইজের ক্রু ড্রাইভার থাকে বলে আমার ধারণা। প্রথম সুযােগেই এরা সমস্ত ক্রু খুলে ফেলবে।

যন্ত্রপাতি সম্পর্কে আমাদের এক ধরনের ভীতি আছে। ভীতির কারণ আমাদের শৈশব। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি বাড়িতে হয়ত একটা রেডিও আছে। ছােট ছেলে রেডিও ধরতে গেল। বাবা চেঁচিয়ে উঠবেন, খবরদার হাত দিবি না। মা চেঁচাবেন, খোকন হাত দিও না, ব্যথা পাবে? ছােট্ট খােকনের মনের ভেতর ঢুকে গেল যন্ত্রপাতিতে হাত দেয়া যাবে না। হাত দিলেই খারাপ কিছু ঘটে যাবে। বড় হবার পরেও শৈশবের স্মৃতি থেকেই যায়। ঘরের ফিউজ কেটে গেলেও আমরা একজন মিস্ত্রি ডেকে আনি।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৩  

আগের প্রসঙ্গে ফিরে আদি-টবিলে যন্ত্রপাতির অংশ ছড়িয়ে বসে আছি। মনটা খারাপ, এইসব খুঁটিনাটি জোড়া লাগাব কীভাবে তাই ভাবছি। তখন পল আবার ঘরে ঢুকল। উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, তাড়াতাড়ি বাইরে যাও, তুষারপাত হচ্ছে।

আমাদের সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে বর্ষা। মেঘমেদুর আকাশ। শ্রাবণের ধারা। আষাঢ়ের পৃণিমা। তেমনি ইংরেজী সাহিত্যে আছে তুষারপাত। বিশেষ করে বছরের প্রথম তুষারপাতের বর্ণনা। বছরের প্রথম বৃষ্টি বলে আমাদের কিছু নেই। সারা বছরই বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষাকালে বেশি, অন্য সময় কম।

এদেশে তুষারপাতের নিদিষ্ট সময় আছে। সামারে তুষারপাত হবে না। স্প্রীং বা ফলেও হবে না। তুষারপাত হবে শীতের শুরুতে। এবং প্রথম তুষারপাতের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে দীর্ঘ শীতের প্রস্তুতি। ফায়ারিং প্লেস ঠিক করতে হবে। হিটিং সিস্টেম ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে। শীতের দিনের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা দেখতে হবে। দিনের পর দিন ঘর বন্দী হয়ে থাকতে হবে, তার জন্যও প্রস্তুতি দরকার।

ব্রিজার্ড হতে পারে। ব্রিজার্ড হলে ছ’সাত দিন একনাগাড়ে গৃহবন্দী থাকতে হবে। তারও প্রস্তুতি আছে। দেখতে হবে সেলারে প্রচুর মদের বােতল আছে কি না। পছন্দসই বিয়ারের পেটি ক’টা আছে। শীতের সিজনে স্কীইং করার পরিকল্পনা থাকলে তার জন্যও প্রস্তুতি দরকার। অনেক কাজ। সব কাজের শুরুর ঘটা হচ্ছে বছরের প্রথম তুষার।

তুষারপাত দেখবার জন্যে ডানবার হলের বাইরে এসে পঁড়িয়েছি। আকাশ ঘােলাটে। বইপত্রে পড়েছি পেঁজা তুলার মত তুষার পড়ে। এখন সে রকম দেখলাম না, পাউডারের কণার মত গুঁড়াে গুঁড়াে তুষার পড়ছে। গায়ে পড়া মাত্রই তা গলে যাচ্ছে। খুব যে একটা অপরূপ দৃশ্য তা নয়। তবুও মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৩  

দেখতে দেখতে পট পরিবর্তন হলাে। শিমুল তুলার মত তুষার পড়ছে। মনে হচ্ছে মেঘের টুকরো। এই টুকরােগুলি গায়ে পড়া মাত্র গলে যাচ্ছে না। গায়ের সঙ্গে লেগে থাকছে। চেনা এই জায়গা মুহূর্তের মধ্যে অচেনা হয়ে গেল। যেন এটা ডানবার হলের সামনের জায়গা নয়। এটা ইন্দ্রলােকের কোন এক মে

মাত্র দুঘন্টা সময়ে সমস্ত ফার্গো শহর তুষারে ঢাকা পড়ে গেল। চারদিক সাদা। এই সাদা রঙের কী বর্ণনা দেব? তুষারের সাদা রঙ অন্য সদার মত নয়। এই সাদা রঙে একটা হিম ভাব থাকে যা ঠিক কাছে টানে না, একটু যেন দূরে সরিয়ে দেয়। তুষারের শুভ্রতার সঙ্গে অন্য কোন শুভ্রতার তুলনা চলে না। এই শুভ্রতা অপার্থিব ।।

ল্যাবরেটরী বন্ধ করে সকাল সকাল হােটেল গ্রেভার ইনে ফিরছি। বাস নিলাম । তুষারের রূপ দেখতে দেখতে যাবাে। মাইল দুএক পথ। কতক্ষণ আর লাগবে?

পথে নেমেই বুঝলাম খুব বড় বােকামি করেছি। রাস্তা অসম্ভব পিছল। পা ফেলা যায় না, তার উপর ঠাণ্ডা। টেম্পারেচার দ্রুত নেমে যাচ্ছে। গায়ে সেই অনুপাতে গরম কাপড় নেই। ঠাণ্ডায় প্রায় জমে যাচ্ছি। তবু ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী বরফের চাদরে ঢাকা। নিজেকে মনে হচ্ছে ক্যাপটেন স্কট এগুচ্ছি মেরুবিন্দুর খোজে। চারদিকের কী অপরূপ দৃশ্য। সুন্দর ! সুন্দর।। সুন্দর !!! আবেগে ও আনন্দে আমার চোখ ভিজে উঠল।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৩  

“Winter for a moment takes the mind; the snow 

Falls past the archlight ; icicies guard a wall; The wind moans through a crack in the window 

A keen sparkle of frost is no the sill”

জননী

ছােট বেলায় আমার ঘর-পালানাে রােগ হয়েছিল।

তখন ক্লাস থ্রীতে পড়ি। স্কুলের নাম কিশােরীমােহন পাঠশালা। থাকি সিলেটের মীরাবাজারে। বাসার কাছেই স্কুল। দুপুর বারোটায় স্কুল ছুটি হয়ে যায়। বাকি দীর্ঘ সময় কিছুতেই আর কাটে না। আমার বােনেরা তখন রান্নাবাটি খেলে। ওদের কাছে পাত্তা পাই না। মাঝে মাঝে অবশ্যি খেলায় নেয়, তখন আমার ভূমিকা হয় কাকরের। আমি হই পুতুল খেলা সংসারের চাকর। ওদের ফাইফরমায়েশ খাটি। ওরা আমার সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলে। কাজেই ওদের পুতুল খেলায় খুব উৎসাহ বােধ করি না।

ঘর পালানাে রােগ তখন হলাে। এক ঝাঝ দুপুরে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। চমৎকার অভিজ্ঞতা। হাটতে হাটতে অদ্ভুত সব কল্পনা করা যায়। মজার মজার দৃশ্য দেখে থমকে দাড়ানো যায়। কারাে কিছু বলার থাকে না।

আমি রােজই তা-ই করি। সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় ফিরে আসি। আমার মা নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তার ছেলে যে সারা দুপুর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় তা-ও তিনি জানেন না। আর জানলেও যে ভয়ংকর কিছু করতেন তা-ও মনে হয়

। তাঁর দিবানিদ্রায় আমি ব্যাঘাত করছি না—এই আনন্দটাই তার জন্য অনেকখানি ছিল বলে আমরা ধারণা।

যাই হােক, একদিনের ঘটনা বলি। হাঁটতে হাঁটতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বিশ্রাম নেয়ার জন্য একটা বাড়ির বারান্দায় এসে বসলাম।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৪

 

 

 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *