বরফের উপর দিয়ে দুজন আসছি। হঠাৎ উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, হুমায়ুন ইনিই একমাত্র আমেরিকান যিনি শুদ্ধভাবে আমার নাম উচ্চারণ করতেন ? তুমি কি দয়া করে এখন থেকে আমাকে মা ডাকবে?
আমি স্তম্ভিত। বলেন কী এই মহিলা।
আমি চুপ করে রইলাম। লেভারেল শান্ত গলায় বললেন, তুমি আমাকে মা ডাকলে আমার খুব ভাল লাগবে। সব সময় ভাবতে হবে না। এই হঠাৎ হঠাৎ।
কী বলব ভেবে পেলাম না। আমাদের মধ্যে আর কোন কথা হল না। আমি বিরাট সমস্যার মধ্যে পড়ে গেলাম।
ভদ্রমহিলার আদরযত্নে খুব অস্বস্তি বােধ করি। কেউ আমার প্রতিটি ব্যাপার লক্ষ্য রাখছে তাও আমার ভাল লাগে না।
আমি পড়াশুনা করি, তিনি চুপচাপ পাশে বসে থাকেন। বারবার জিজ্ঞেস করেন, আমি পাশে বসে থাকায় কি তােমার অসুবিধা হচ্ছে? আমি ভদ্রতা করে বলি “না”।
স!!
ঠাণ্ডা লেগে একবার খানিকটা জ্বরের মত হল, তিনি তার নিজের ইলেকট্রিক ব্লাংকেট আমাকে দিয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে একটা কার্ড, সেখানে লেখা ? তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠ। তােমার মা-লেভারেল।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৫
ভদ্রমহিলার এখানে বেশিদিন থাকতে হলাে না। ইউনিভাসিটি আমাকে বাড়ি দিল। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বিদায়ের সময় তিনি শিশুদের মত চিৎকার করে কাদতে লাগলেন। ভদ্রমহিলার স্বামী বিরক্ত হয়ে বারবার বললেন, এসব কী হচ্ছে? ব্যাপারটা কি আমি তাে কিছুই বুঝতে পারছি না। লেভারেল, তুমি এত আপসেট কেন?
আমার হৃদয় খুব সম্ভব পাথরের তৈরি। এই দুজনের কাউকেই আমি মুখ ফুটে মা ডাকতে পারিনি।
এই পরবাসে অকর্মা লােক খুব ভাল চিঠি লিখতে পারে বলে একটা প্রবচন আছে। অকর্মাদের কাজকর্ম নেই ইনিয়ে-বিনিয়ে দীর্ঘ চিঠি তাদের পক্ষেই লেখা সম্ভব।
আমি নিজেও এইসব অকর্মাদের দলে। গুছিয়ে চিঠি লিখবার ব্যাপারে আমার জুড়ি নেই। পাঠকরা হয়ত ভুরু কুঁচকে ভাবছেন—এই লােকটা দেখি খুব অহংকারী।
তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আমি আসলেই অহংকারী, তবে লিখিতভাবে সেই অহংকার কখনাে প্রকাশ করিনি। আজ করলাম। আমি যে চমৎকার চিঠি লিখতে পারি তার এখন একটি প্রমাণ দেব। আমার ধারণা, যে-সব পাঠক একণ ভুরু কুঁচকে ছিলেন-প্রমাণ দাখিলের পর তাদের মুখের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
প্রবাস জীবনের সাত মাস পার হয়েছে। আমার স্ত্রী গুলতেকিন আমার সঙ্গে নেই। সে আছে দেশে। হলিক্রস কলেজ থেকে আইএসি পরীক্ষা দেবে। কোমর বেঁধে পড়াশােনা করছে। পরীক্ষার আর মাত্র মাস খানেক দেরি। এই অবস্থায় আমি আমার বিখ্যাত চিঠিটি লিখলাম। চার পাতার চিঠিতে একা থাকতে যে কী পরিমাণ খারাপ লাগছে, তার প্রতি যে কী পরিমাণ ভালবাসা জমা করে রেখেছি এইসব লিখলাম। চিঠির শেষ লাইনে ছিল—আমি এনে দেব তােমার উঠোনাে সাতটি অমরাবতী।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৫
এই চিঠি পড়ে সে খানিকক্ষণ কাদল। পরীক্ষা-টরীক্ষার কথা সব ভুলে গিয়ে সাত মাস বয়সী শিশু কন্যাকে কোলে নিয়ে চলে এল আমেরিকায়। আমি আমার চিঠি লেখার ক্ষমতা দেখে স্তম্ভিত। পরীক্ষা-টরীক্ষা সব ফেলে দিয়ে চলে আসায়
আমি খানিকটা বিরক্ত। দু মাস অপেক্ষা করে পরীক্ষা দিয়ে এলেই হত।
গুলতেকিন চলে আসায় আমার জীবনযাত্রা বদলে গেল। দেখা গেল সে একা আসেনি, আমার জন্যে কিছু সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে, সে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিভার্সিটি আমাকে একটা বাড়ি দিল।
দুতলা বাড়ি। এক তলায় রান্নাঘর, বসার ঘর এবং স্টাডি রুম। দুলায় দুটি শােবার ঘর। এত বড় বাড়ির আমার প্রয়ােজন ছিল না। ওয়ান বেডরুমই যথেষ্ট ছিল। তবে নর্থ ডাকোটা স্টেটের নিয়ম হচ্ছে বাচ্চার জন্যে আলাদা শােবার ঘর
থাকতে হবে। বাচ্চাদের মধ্যে একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে হলে তাদের জন্যে আলাদা আলাদা শােবার ঘর থাকতে হবে। তবে দু’জনই ছেলে বা মেয়ে হলে একটি শােবার ঘরেই চলবে ।
আমরা নতুন বাড়িতে উঠে এলাম। বলতে গেলে প্রথমবারের মত আমার সংসার শুরু করলাম। এর আগে থেকেছি মা-র সংসারে। আলাদা সংসারের আনন্দ বেদনার কিছুই জানি না। প্রকৃল উৎসাহে আমরা ঘর সান্ধাবার কাজে লেগে পড়লাম। রােজই দোকানে যাই! যা দেখি তাই কিনে ফেলি। এমন অনেক জিনিস আমরা দুজনে মিলে কিনেছি যা বাকি জীবনে একবারও ব্যবহার হয়নি। এই মুহূর্তে দুটি জিনিসের নাম মনে পড়ছে—টুল বক্স, যেখানে করাত-ফরাত সবই আছে। এবং ফুট বাথ নেবার জন্যে প্লাস্টিকের গামলা জাতীয় জিনিস।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৫
গুলতেকিন প্রবল উৎসাহে রান্নাবান্না নিয়েও ঝাপিয়ে পড়ল। ভাত মাছ ছাড়াও নানান পরীক্ষামূলক রান্না হতে লাগল। অতি অখাদ্য সেই সব খাদ্যদ্রব্য মুখে নিয়েআমি বলতে লাগলাম, অপূর্ব।
খুব সুখের জীবন ছিল আমাদের। সাত মাস বয়সের পুতুলের মত একটি মেয়ে যে কাউকে বিরক্ত করে না, আপন মনে খেলে। মাঝে মাঝে তার মনে গভীর ভাবের উদয় হয় সে তার নিজস্ব ভাষায় গান গায়–
গিবিজি গিবিজি, গবিজি গিবিজি
গিবি। গিবিজি গিবিজি গিবিজি গিবিজি সিবি আহা, সে বড় সুখের সময়।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই দেশে প্রবাসী ছাত্রদের স্ত্রীর ভয়াবহ জীবন যাপন করেন। এদের কিছুই করার থাকে না। স্বামী কাছে চলে যায়, ফেরে গভীর রাতে। এই দীর্ঘ সময় বেচারীকে কাটাতে হয় একা একা। এর সময় কাটায় টিভির সামনে বসে থেকে কিংবা শফিং মলে ঘুরে ঘুরে।।
রাতে স্বামী যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে তখন অতি অল্পতেই খিটিমিটি লেগে যায়। স্ত্রী বেচারীর ফুপিয়ে কাদা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। আমি এক ভদ্রলােককে জানত্যম যিনি রাত একটায় তার স্ত্রীকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন। একবারও ভাবেননি এই বিদে-বিভূঁইয়ে আত্মীয়-পরিজনহীন শহরে মেয়েটি কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৫
যাক ওসব, নিজের গল্পে ফিরে আসি। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছিলাম, প্রবাসী স্বীবনে আমি কখনাে আমার স্ত্রীর উপর রাগ করব না। কখনো তাকে একাকীত্বের কষ্ট পেতে দেব না। | আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আঠারাে বছরের এই মেয়ে আমেরিকান জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে খুব সহজেই মানিয়ে নিচ্ছে। অতি অল্প সময়ে সে চমৎকার ইংরেজী বলা শিখল। সুন্দর একসেন্ট। আমি অবাক হয়ে বললাম, এত চমৎকার ইংরেজী কোথায় শিখলে?
সে বলল টিভি থেকে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ১৪ ঘন্টা টিভি খােলা থাকে। ইংরেজী শিখব না তো করব কি?
একদিন বাসায় এসে দেখি ফুটফুটে চেহারার দুটি আমেরিকান বাচ্চা আমার মেয়ের সঙ্গে ঘুরঘুর করছে। অবাক হয়ে বললাম, এরা কারা?
গুলতেকিন হাসিমুখে বলল, বেবী সিটিং শুরু করেছি। সে কি?
ও অসুবিধা তাে কিছু নেই। আমার নিজের বাচ্চাটিকে তাে আমি দেখছি, এই সঙ্গে এই দুজনকেও দেখছি। আমার তাে সময় কাটাতে হবে।
গুলতেকিন খুবই অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে। ওদের ধানমণ্ডির বাসায় আমি প্রথম কাপড় ধােয়া এবং কাপড় শুকানাের যন্ত্র দেখি। ওদের পরিবারে ম্যানেজার জাতীয় একজন কর্মচারী আছে, তিনজন আছে কাজের মানুষ। ড্রাইভার আছে, মালী আছে। এদের প্রত্যেকের আলাদা শােবার ঘর আছে। এরী যেন নিজেরা রান্না বান্না করে খেতে পারে সে জন্যে আলাদা রান্নাঘর এবং বাবুর্চি আছে।
সেই পরিবারের অতি আদরের একটি মেয়ে বেবী সিটিং করছে। ভাবতেও অবাক লাগে। কাজটা হচ্ছে আয়ার। এই জাতীয় কাজের মানসিক প্রস্তুতি নিশ্চয়ই তার ছিল না। বিদেশের মাটিতে সবই বোধহয় সম্ভব। বেবী সিটিং-এর কাজটি সে চমৎকারভাবে করতে লাগল। বাসা ভরতি হয়ে গেল বাচ্চায়। সবাই গুলতেকিনকে বেবী সিষ্টার হিসেবে পেতে চায়।
মাঝে মাঝে দুপুরে বাসায় খেতে এসে দেখি পুরােপুরি স্কুল বসে গেছে। বাড়ি ভর্তি বাচ্চা। তারা আমার মেয়ের দেখাদেখি গুলতেকিনকে ডাকে আম্মা, আমাকে ডাকে আব্বা।
Read More