মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে আমেরিকান দম্পতি দুপুর রাতে তাদের বাচ্চা নিয়ে উপস্থিত। লজ্জিত গলায় বলছে, আমার বাচ্চাটা চেঁচামেচি করছে রাতে তােমার
সঙ্গে ঘুমুবে। কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না। আমরা খুবই সজ্জিত। কী করব বুঝতে পারছি না।
গুলতেকিন হাসিমুখে বলল বাচ্চাকে রেখে যান। ও এর জন্যে আমি তােমাকে পে করব। ও পে করতে হবে না। রাতের বেলা তােমার বাচ্চা আমার গেস্ট।
গুলতেকিন শুয়েছে, একদিকে তার গলা জড়িয়ে ধরেছে আমাদের নিজের মেয়ে নােভা। অন্যদিকে আমেরিকান বাচ্চা। চমৎকার দৃশ্য।
টিচিং অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে আমি যত টাকা পেতাম সে তারচে অনেক বেশি পেতে লাগল। আমরা চমৎকার একটা গাড়ি কিনলাম—ডজ কোম্পানির পােলারা।
ছুটির দিনগুলিতে গাড়ি করে ঘুরে বেড়াই। প্রায়ই মনে হয় আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়টা কাটাচ্ছি।
টাকা-পয়সা নিয়ে আমরা যত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই করি, সুখের উপকরণগুলির মধ্যে টাকা-পয়সার ভূমিকাটা বেশ বড়। যতই দিন যাচ্ছে ততই তা বুঝতে পারছি। কিংবা কে জানে ধনবাদী এই সমাজ আমার চিন্তা-ভাবনাকে পাল্টে দিতে শুরু করেছে কিনা।
পরবাসে আমার রুটিনটা হল এরকম ৪ ভােরবেল ল্যাবরেটরীতে চলে যাই। সন্ধ্যাবেলা ফিরে আসি। ঘরে পা দেবার পর ক্লাসের বইপত্র ছুঁয়েও দেখি না। টিভি চালিয়ে দেই, গান শুনি, লাইব্রেরী থেকে নিয়ে আসা গাদা গাদা গল্পের বইয়ের পাতা উল্টাই। নােভাকে বাংলা শেখাতে চেষ্টা করি। গ্লাসের পানি দেখিয়ে বলি এর নাম পানি বল, পানি সে বলে, গিবিজি। ও গিবিজি নয়। বল পানি .. গিবিজি, গিবিজি।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৬
মেয়েটিকে নিয়ে তার মা খুব দুশ্চিন্তায় ভােগে। শুধুমাত্র গিবিজি শব্দ সম্বল করে সে এই পৃথিবীতে এসেছে কিনা কে জানে। তার দেড় বছর বয়স হয়ে গেছে, এই বয়সে বাচ্চারা চমৎকার কথা বলে। অথচ সে শুধু বলেগিবিজি। আমি নিজেও খানিকটা চিন্তিত বােধ করলাম।
দু’বছর বয়সে হঠাৎ করে সে কথা বলতে শুরু করল। ব্যাপারটা বেশ মজার, কারণ সে কথা বলা শুরু করল ইংরেজীতে একটা দুটা শব্দ নয়, প্রথম থেকে বাক্য। এবং বেশ দীর্ঘ বাক্য। বাসায় দুটো ভাষা চালু ছিল—ইংরেজী ও বাংলা। আমরা নিজেরা বাংলা বলতাম। যে সব বাচ্চারা সারাদিন বাসায় থাকত তারা বলতইংরেজি। সে দুটি ভাষাই দীর্ঘদিন লক্ষ্য করেছে। বেছে নিয়েছে একটি। ভাষা বিজ্ঞানীদের জন্যে এই তথ্যটি সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ।
আমার দীর্ঘ সাত বছরের প্রবাস জীবনের অনেক সুখ-দুঃখের গল্প আছে। সবই ব্যক্তিগত গল্প। তার থেকে দু একটি বলা যেতে পারে।
একদিনের কথা বলি। সন্ধ্যা মিলিয়েছে বলে রাখা ভাল সামারে সন্ধ্যা হয় রাত নটার দিকে । আমি পাের্চে বসে চা খাচ্ছি, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ন’দশ বছরের একটি বালিকা আমার বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করছে। মেয়েটির চেহারা ভল পুতুলের মত। ফ্রকের হাতায় সে চোখ মুছছে। আমি বললাম, কী হয়েছে পুকী।
সে বলল, কিছু হয়নি। আমি কি তােমার বাসার সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি?
ও অবশ্যই পারাে। ভেতরে এসেও বসতে পারি। ও না। আমার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভাল লাগছে।
রাত সাড়ে দশটায় খাবার শেষ করে বাইরে এসে দেখি মেয়েটি তখনাে দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, এখনো দাড়িয়ে আছাে?
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৬
সে কাঁদো কাদো গলায় বলল, আমি তো তােমাকে বিরক্ত করছি না। শুধু দাড়িয়ে আছি।
ও ব্যাপারটা কি তুমি আমাকে বলবে? মেয়েটি ঘটনাটা বলল।
তার মা একজন ডিভাের্সি মহিলা। মেয়েকে নিয়ে থাকে। সম্প্রতি একটি ছেলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠত হয়েছে। ছেলেটিকে নিয়ে সে ডেটিং-এ যায়। মেয়েটিকে একা বাড়িতে রেখে যায়। সন্ধ্যা মেলাবার পর মেয়েটির একা একা ভয় করতে থাকে। সে তখন ঘর বন্ধ করে বাইরে এসে দাড়ায়। মায়ের জন্য অপেক্ষা, করে। আশার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ানাের কারণ হচ্ছে আমার ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত বাতি জ্বলে। সে লক্ষ্য করেছে আমি খুব রাত জাগি। | মেয়েটির কষ্টে আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি বললাম, খুকী তুমি আমার ঘরে এসে মার জন্য অপেক্ষা কর।
সে কঠিন গলায় বলল, না।
সেবারের পুরাে সামারটা আমার নষ্ট হয়ে গেল। মেয়েটি রােজ গভীর রাত পর্যন্ত আমার দরজার সামনে দাড়িয়ে তার মার জন্যে অপেক্ষা করে। ভদ্রমহিলা মধ্যরাতে মাতাল অবস্থায় ফেরেন। আমার ইচ্ছা করে চড় দিয়ে এই মহিলার সব
কটি দাত ফেলে দেই। তা করতে পারি না। কান পেতে শুনি মহিলা তার মেয়েকে বলছেন—আর কখনাে দেরি হবে না। তুমি কি খুব বেশি ভয় পাচ্ছিলে?
ও আমি তােমাকে ভালবাসি, মা । ও আমিও তােমাকে ভালবাসি।
আই লাভ ইউ কথাটি একজন আমেরিকান তঁার সমগ্র জীবনে কত লক্ষ বার ব্যবহার করেন আমার জানতে ইচ্ছে করে। এই বাক্যটির আদৌ কি কোন অর্থ তাদের কাছে আছে?
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৬
আরেকটা ঘটনা বলি।
আমার স্ত্রী জেনিলী নামের একটি মেয়ের বেবী সিটিং করতাে। মেয়েটির বয়স সাত-আট বছর। মেয়েটির মা একজন ডিভাের্সি মহিলা, আমাদের ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিদ্যার ছাত্রী। সে ইউনিভার্সিটিতে যাবার পথে মেয়েটিকে রেখে যায়। ফেরার পথে নিয়ে যায়। একদিন ব্যতিক্রম হল, সে মেয়েকে নিতে এল না। রাত পার হয়ে গেল। পরদিন ভােরে তার বাসায় গিয়ে দেখি বিরাট তালা স্কুলছে। খুব সমস্যায় পড়লাম। মহিলা গেলেন কোথায়? তিন দিন কেটে গেল কোন খোজ নেই।
আমরা পুলিশে খবর দিলাম। মহিলার মার ঠিকানা বের করে তাকে লং ডিসটেন্স টিলিফোন করলাম । ভদ্রমহিলা কঠিন গলায় বললেন, এই সব ব্যাপার নিয়ে আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হব। আমার মেয়ের সঙ্গে গত সাত বছর ধরে কোন যােগাযােগ নেই। নতুন করে যােগাযােগ হােক তা আমার কাম্য নয়। জীবনের শেষ সময়টা আমি সমস্যা ছাড়া বাচতে চাই। . আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তবে জেনি লী নির্বিকার। সে বেশ সহ ভঙ্গিতে বলল, আমার মা আমাকে তােমাদের ঘাড়ে ডাম্প করে পালিয়ে গেছে। সে আর আসবে না।
আমি তাকে সান্তনা দেবার জন্যে বললাম, অবশ্যই আসবে।
ও না আসবে না। আমি না থাকলেই তার সুবিধা। বয় ফ্রেণ্ডের সঙ্গে যেখানে ইচ্ছ। সেখানে যেতে পারবে। আমি তােমাদের সঙ্গেই থাকব।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৬
কথাগুলি বলবার সময় মেয়েটির গলা একবারও ধরে এল না। চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করল না। একমাত্র শিশুরাই পারে নির্মোহ হয়ে সত্যকে গ্রহণ করতে।
জেনি লীর মা চারদিন পর ফিরে আসে। সে তার বয় ফ্রেণ্ডের সঙ্গে লং ডিসটেন্স ড্রাইভে দশ হাজার মাইল দূর মন্টানার এক পাহাড়ে চলে গিয়েছিল।
হােটেল গ্রেভার ইন -৪
আমেরিকা কী ভাবে বিদেশী ছাত্রদের জীবনে প্রভাব ফেলতে থাকে তার একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েই এই গল্প শেষ করব।
শীতের ময়কার ঘটনা।
এখানকার ‘শীত মানে ভয়াবহ ব্যাপার। ঘর থেকে বেরুনাে বন্ধ। আমি ইউনিভার্সিটিতে যাই। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আসি। জীবন এর মধ্যেই
সীমাবদ্ধ হয়ে গেল।
আমেরিকানদের মতে এই সময়টা স্বামী-স্ত্রীদের জন্যে খুব খারাপ। সবার মধ্যেই তখন থাকে—কেবিন ফিবার। দিনের পর দিন ঘরে বন্দী থেকে মেজাজ হয় রুক্ষ ঝগড়াঝাটি হয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ডির্ভোসের শতকরা ৭৬ ভাগ হয় শীতের সময়টায়। | আমেরিকানদের কেবিন ফিবারের ব্যাপারটা যে কত সত্যি তার প্রমাণ হাতে হাতে পেলাম। অতি সামান্য ব্যাপার নিয়ে কুৎসিত একটা ঝগড়া করলাম গুলতেকিনের সঙ্গে। সে বিস্মিত গলায় বারবার বলতে লাগল, তুমি এ রকম করে কথা বলছ কেন? এসব কী? কেন এরকম করছ?
আমি চেঁচিয়ে বললাম, ভাল করছি। ঃ তুমি খুবই বাজে ব্যবহার করছ? কেউ এরকম ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলে
না।
কেউ না বলুক, আমি বলি।
আমি কিন্তু তােমাকে ছেড়ে চলে যাব। ও চলে যেতে চাইলে যাও। মাই ডাের ইজ ওপেন দক্ষিণ দোয়ার খেলা।
Read More