আমার প্রফেসর মুখ গম্ভীর করে আমাকে বুঝালেন,এরা ভয়াবহ ধরনের প্রস্টিটিউট। তােমার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত গায়ে হাত পর্যন্ত দিতে দেবে না। পত্রপত্রিকায় এদের সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে। | প্রফেসরের ভাব এরকম যে গায়ে হাত দিতে দিলে তিনি রাজি হয়ে যেতেন।
রাতের খাবার খেতে আমরা যে রেস্টুরেন্টে গেলাম তা হচ্ছে টপলেস রেস্টুরেন্ট। অর্থাৎ ওয়েট্রেসদের বুকে কোন কাপড় থাকবে না। বইপত্রে এইসব | রেস্টুরেন্টের কথা পড়েছি। রাস্তার এই প্রথম দেখলাম। আমার লজ্জায় প্রায় মাথা
কাটা যাবার মত অবস্থা। মেয়েগুলিকে মুনে হল আড়ষ্ট ও প্রাণহীন। এদের মুখের দিকে কেউ তাকাচ্ছে না, সবই তাকাচ্ছে বুকের দিকে। কাজেই তারা খানিকটা প্রাণহীন হবেই। চোখের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। চোখের উপর চোখ রেখে আমরা সেই ভাষায় কথা বলি। এই সব মেয়ে চোখের ভাষা কখনাে ব্যবহার করতে পারে না। এরা বড় দুঃখী
প্রফেসর বিরক্ত মুখে আমাকে বললেন, আমাদের এই টেবিলে বসাটাই ভুল হয়েছে। এই টেবিলের ওয়েট্রেসদের বুকের দিকে তাকিয়ে দেখ। ছেলেদের বুক এরচে অনেক ডেভেলপড় হয়। এর বুক দেখে মনে হচ্ছে প্রেইরীর সমতল ভূমি।
রাতের খাবারের পর আমরা একটা শো দেখলাম। প্রায় নগ্ন কিছু নারীপুরুষ মিলে গান বাজনা নাচ করল। একটি জাপানি মেয়ে সারা শরীর পালকে ডেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দর্শকদের কাছে আসছে দর্শকরা একটা করে পালক তুলে নিচ্ছে। তার গা ক্রমশ খালি হয়ে আসছে। সর্বশেষ পালকটি তার গা থেকে খুলে নেবার পর সে স্টেজে চলে গেল এবং চমৎকার একটি নাচ দেখাল। যে মেয়ে এত সুন্দর নাচ জানে তার খালি গা হবার প্রয়ােজন পড়ে না।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৯
রাত বারটায় শো শেষ হবার পর আমার প্রফেসর বললেন, লাস ভেগাসে রাত শুরু হয় বারােটার পর। এখন হােটেলে গিয়ে ঘুমুবার কোন মানে হয় না।
আমি বললাম, তুমি কি করতে চাও? জুয়া খেলবে নাকি? ৪জুয়া কী করে খেলতে হয়, আমি জানি না।
আমিও জানি না। তবে সুট মেশিন জিনিসটা বেশ মজার। নিকেল, ডাইম কিংবা কোয়ার্টার (বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা মেশিনের ফোকরে ফেলে একটা হাতল ধরে টানতে হয়। ভাগ্য ভালাে হলে কম্বিনেশন মিলে যায়, ঝুনঝুন শব্দে প্রচুর মুন্না বেরিয়ে আসে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের দুজনের নেশা ধরে গেল। মুদ্রা ফেলি আর স্লট মেশিনের হাতল ধরে টানি। দেখা গেল প্রফেসরের ভাগ্য আজ সুপ্রসন্ন । জ্যাক পৃষ্ট পেয়ে গেলেন! এক কোয়ার্টারে প্রায় একশ ডলার। তার সামনে মুদ্রার পাহাড়। | ক্যাসিনো থেকে কিছুক্ষণ পরপর বিনামূল্যে শ্যাম্পেন খাওয়ানাে হচ্ছে। ক্যাসিনাে যেন বিরাট এক উৎসবের ক্ষেত্র। আমি মুগ্ধ চোখে ঘুরে ঘুরে দেখলাম ক্যাসিনাের এক একটা টেবিলে কত লক্ষ টাকারই না লেনদেন হচ্ছে।
কত টাকাই না মানুষের আছে। | রাত তিনটার দিকে আমরা হোটেলে ফিরলাম। এর মধ্যে আমার প্রফেসর দৃশ ডলার হেরেছেন। আমার কাছে ছিল সত্তর ডলার, তার সবটাই চলে গেছে। আমাকে প্রফেসরের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হবে এবং তা করতে হবে আজ রাতের মধ্যেই। কারণ আমার ধারণা এই লোক আবার ক্যাসিনােতে যাবে এবং তার শেষ কপর্দকও সুট মেশিনে চলে যাবে।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৯
রাতে এক ফোটা ঘুম হল না। সমস্ত দিনের উত্তেজনার সঙ্গে যােগ হয়েছে আগামী দিনের সেশনের দুশ্চিন্তা।হােটেলের যে ঘরে আমি আছি তা আহামরি কিছু নয়। দুটি বিছানা। একটিতেআমি অন্যটিতে থাকবে আমাদের ইউনিভার্সিটিরই এক ছাত্র, জিম। সে এখনাে ফেরেনি। সম্ভবত কোন ক্যাসিনােতে আটকা পড়ে গেছে। রাতে আর ফিরবে না।
আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ফিরল । চোখের সামনে পুরাে দিগম্বর হয়ে সূটান পাশের বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমেরিকানদের এই ব্যাপারটা আমাকে সব সময় পীড়া দেয়। একজন পুরুষের সামনে অন্য একজন পুরুষ কাপড় খুলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। | ভরমিটরী গােসলখানায় এক সঙ্গে অনেকে নগ্ন হয়ে স্নান পর্ব সারে। ব্যবস্থাই এরকম? হয়ত এটাকেই এরা অগ্রসর সভ্যতার একটা ধাপ বলে ভাবছে। এই প্রসঙ্গে ওদের সঙ্গে আমি কোন কথা বলিনি। বলতে ইচ্ছা করেনি।
কেমিক্যাল সােসাইটির মিটিং এ গিয়ে হকচকিয়ে গেলাম। যা ভেবেছিলাম ব্যাপারটা মােটেই সেরকম নয়। উৎসব ভাল। পেপারের চেয়ে পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলােচনাই প্রধান। আলাপের বিষয় একটাই — কেমিস্ট্রি।।
এই বিষয়ের বড় বড় সব ব্যক্তিত্বকেই দেখলাম। রসায়নে দুই বছর আগে নােবেল পুরস্কার পাওয়া এক বিজ্ঞানীকে দেখলাম লালরঙের একটা গেঞ্জি পরে এসেছেন—সেখানে লেখা ‘আমি রসায়নকে ঘৃণা করি।”
অধিবেশনটি ছােট ছােট ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক সঙ্গে অনেক অধিবেশন চলছে। যার যেটি পছন্দ সে সেখানে যাচ্ছে।
আমাদের অধিবেশনে পঞ্চাশজনের মতাে বিজ্ঞানীকে দেখা গেল। আমার আগে বেলজিয়ামের লিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞানী পেপার পড়লেন। তাকে এমনভাবে চেপে ধরা হলো যে ভদ্রলােক শুধু কেঁদে ফেলতে বাকি রাখলেন। আমি ঘামতে ঘামতে এই জীবনে যতগুলি সুরা শিখেছিলাম সব মনে মনে পড়ে ফেললাম। আমার মনে হচ্ছিল বক্তৃতার মাঝখানেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। এখুলে করে আমাকে হাসপাতালে নিতে হবে।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৯
আমার বক্তৃতার ঠিক আগে আগে প্রফেসর উঠে বাইরে চলে গেলেন। এই প্রথম বুঝলাম চোখে সর্ষে ফুল দেখার উপমাটি কত খাটি। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার কোনরকম বাধা ছাড়াই আমি আমার বক্তব্য শেষ করলাম। প্রশ্ন-উত্তর পর্ব শুরু হল। প্রথম প্রশ্ন শুনে আমার পিলে চমকে গেল। আমি যখন বলতে যাচ্ছি–এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, ঠিক তখনই আমার প্রফেসর উদয় হলেন এবং প্রশ্নের জবাব দিলেন। ঝড়ের মত প্রশ্ন এল, ঝড়ের মতই উত্তর দিলেন প্রফেসর গ্লাস। আমি মনে মনে বললাম, ব্যাটা বাঘের বাচ্চা, পুরােপুরি তৈরি হয়ে এসেছে।
সেশন শেষে প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আমার বক্তৃতা কেমন হয়েছে ?
তিনি গভীর গলায় বললেন, এত চমৎকার একটি বিষয় নিয়ে এত বাজে বক্তৃতা আমি এই জীবনে শুনিনি।
বলেই হেসে ফেললেন এবং হাসতে হাসতে যােগ করলেন, তাতে কিছুই যায় আসে না, কারণ কাজটাই প্রধান, বক্তৃতা নয়।
ঃ কিভাবে সেলিব্রেট করবাে? ও শ্যাম্পেন দিয়ে। ও আর কিভাবে?
এক বোতল শ্যাম্পেন কেনা ইল। ব্যাটা পুরােটা গলায় বলে দিয়ে গুনগুন করে গান ধরল
“Pretty girls are everywhere If you call me I will be there…”
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৯
শীলার জন্ম
আমার দ্বিতীয় মেয়ে শীলার জন্ম আমেরিকায়। জন্ম এবং মৃত্যুর সব গল্পই নটিকীয়, তবে শীলার জন্ম মুহুর্তে যে নাটক হয়, তাতে আমার বড় ভূমিকা আছে বলে গল্পটি বলতে ইচ্ছা করছে।
তারিখটা হচ্ছে ১৫ই জানুয়ারি।
প্রচণ্ড শীত পড়েছে। বরফে বরফে সমস্ত ফার্গো শহর ঢাকা পড়ে গেছে। শেষরাত থেকে নতুন করে তুষারপাত শুরু হল। আবহাওয়া দপ্তর জানাল
‘নিতান্ত প্রয়ােজন না হলে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হবে না। আমার ঘরের হিটিং ঠিকমত কাজ করছিল না। ঘর অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। দুতিনটি কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছি। এ রকম দুর্যোগের দিনে ইউনিভার্সিটিতে কী করে যাব তাই ভাবছি। দেশে যেমন প্রচণ্ড বৃষ্টি-বাদলার দিনে রেইনি ডে’-র ছুটি হয়ে যেত, এখানে স্নো ডে বলে তেমন কিছু নেই। চার ফুট বরফে শহর ঢাকা পড়ে গেছে, অথচ তারপরও ইউনিভার্সিটির কাজকর্ম ঠিকমত চলছে।
সকালবেলার ঘুমের মৃত আব্রামের ব্যাপার এই জগতে খুব বেশি নেই। সেই আরাম ভােগ করছি, ঠিক তখন গুলতেকিন আমাকে ডেকে তুলে ফ্যাকাশে মুখে বলল, আমার যেন কেমন লাগছে।
আমি বললাম, ঠিক হয়ে যাবে।
বলেই আবার ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি বুঝতে পারছ না, এটা মনে হচ্ছে ঐ ব্যাপার ।
Read More