হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২১

আমার কন্যা পাখি দেখে মােটেই উল্লসিত হলো না। ভয় পেয়ে চেঁচাতে লাগলাে। মুগ্ধ হল মেয়ের মা। সে বারবার বলতে লাগল–ও মা কী সুন্দর পাখি! ঠোট গুলাে দেখ, মনে হচ্ছে চব্বিশ ক্যারেট গােল্ডের তৈরি। সে পাখিকে পানি খেতে দিল, ময়দা গুলে দিল। পাখি কিছুই স্পর্শ করল না। একটু পরপর বলতে লাগল ‘চিকু চিকু’। ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছিল, আমি ক্লাসে চলে গেলাম। পাখির কথা আর মনে রইল না।

হোটেল গ্রেভার ইন

বিকেল তিনটার দিকে আমার কাছে একটা টেলিফোন এল। এক আমেরিকান তরুণী খুবই পলিশড গলায় বলল, মিঃ আমেদ, তুমি কি কোন পাখি কুড়িয়ে পেয়েছ?

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, হ্যা, কিন্তু তুমি এই খবর জানলে কোখেকে ?

আমার বস আমাকে বললেন, আমি ফারগাে পশু-পাখি ক্লেশ নিবারণ সমিতির অফিস থেকে বলছি।

আমি আতংকিত গলায় বললাম, পাখিকে বাসায় নিয়ে যাওয়া কি বেআইনি ?

ও না, বেআইনি নয়। আমরা তােমার পাখিকে পরীক্ষা করতে চাই। মনে হচ্ছে ওর ডানা ভেঙে গেছে।

ঃ আমি কি পাখিকে নিয়ে আসবে?

ও তােমাকে আসতে হবে না, আমাদের লােক গিয়ে নিয়ে আসবে। তােমার অ্যাপার্টমেন্টের নাম্বার বল।

আমি নাম্বার বললাম। এবং মনে মনে ভাবলাম, একী যন্ত্রণায় পড়া গেল।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২১

বাসায় এসে দেখি পাখিটির জন্য আমার স্ত্রী কার্ডবাের্ডের একটা বাসা বানিয়েছে। নানান খাদ্যদ্রব্য তাকে দেওয়া হচ্ছে। সে কিছু কিছু খাচ্ছেও। তবে আমার কন্যার ভয় ভাঙেনি। সে মার কোল থেকে নামছে না। পাখির কাছে নিয়ে গেলেই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছে। আমার স্ত্রীর কাছে শুনলাম পাশের অ্যাপার্টমেন্টের এক মহিলা এসেছিলেন বেড়াতে, পাখি দেখে তিনিই টেলিফোন করেন।

পশু-পাখি ক্লেশ নিবারণ সমিতির লােক এসে সন্ধ্যার আগে পাখি নিয়ে গেল। রাত আটটায় টেলিফোন করে জানাল যে পাখিটার ডানা ভাঙা। এক্সরেতে ধরা পড়েছে। তাকে পশু হাসপাতালে পাঠানাে হয়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে ডানা জোড়া লাগানাে যায়। যদিও এসব ক্ষেত্রে চেষ্টা সাধারণত ফলপ্রসূ হয় না।

আমি মনে মনে ভাবলাম, এ তাে দেখি ভালো যন্ত্রণা হল। মুখে বললাম, আমি খুবই আনন্দিত যে পাখিটার একটা গতি হচ্ছে। পাখি নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। | সাতদিন কেটে গেল। পাখির কথা প্রায় ভুলতে বসেছি, তখন টেলিফোন এল হাসপাতাল থেকে। ডাক্তার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, ডানা জোড়া লেগেছে।

আমি বললাম, ধন্যবাদ। আমি অত্যন্ত আনন্দিত। ও পাখিটি তােমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ও তার কোন প্রয়ােজন দেখছি না। আমার মেয়ে এই পাখি ঠিক পছন্দ করছে না। সে উলের কাটা দিয়ে খুঁচিয়ে পাখিটাকে মেরে ফেলতে পারে বলে আমার ধারণা।

তাহলে তাে বিরাট সমস্যা হল। ও কী সমস্যা?

দেখ, এটা হচ্ছে মাইগ্রেটর বার্ড। শীতের সময়ে গরমের দেশে উড়ে . যায়। সমস্যাটা হল ফারগােতে শীত পড়ে গেছে। এই গােত্রের পাখি সব উড়ে চলে গেছে। একমাত্র তােমার পাখিটিই যেতে পারেনি।

|এখন করণীয় কী?

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২১

ও ছ’মাস পাখিটাকে পালতে হবে। গােটা শীতকালটা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

আমি তােমাকে আগেই বলেছি আমার পক্ষে সম্ভব না।

আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম, কোন কুক্ষণে না জানি এই পাখি ঘরে এনেছিলাম।

একদিন পর আবার পশুপাখি ক্লেশ নিবারণ সমিতির বড়কর্তার টেলিফোন, আমেদ, তুমি নাকি তােমার পাখি নিতে রাজি হচ্ছ না?

এটা আমার পাখি না। বনের পাখি। খানিকক্ষণের জন্যে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম।

ও পাখিটির এই দুঃসময়ে তুমি তার পাশে বঁড়াবে না? এই মাইগ্রেটরী পাখি যাবে কোথায় ?

ও আমি খাটি বাংলা ভাষায় বললাম, জাহান্নামে যাক। ঃ তুমি কী বললে ? | ও বললাম যে তােমরা একটা ব্যবস্থা কর। আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আমার মেয়ে পাখি পছন্দ করে না। আমি বরং এই দু’মাস পাখিটিকে বাচিয়ে রাখতে যা খরচ হয় তা দিতে রাজি আছি।

ভদ্রলােক বললেন, দেখি কী করা যায়। বাকি দিনগুলি আংকের মধ্যে কাটতে লাগলাে। টেলিফোন বাজলেই চমকে উঠি, ভাবি এই বুঝি পশুপাখিওয়ালারা নতুন ঝামেলা করছে ।

দিন দশেক পার হল। আমি হাঁফ ছেড়ে ভাবলাম, যাক আপদ চুকেছে। তখন আবার টেলিফোন। সেই পশুপাখি ক্লেশ নিবারণ সমিতি। তবে এবার তাদের গলায় আনন্দ ঝরে পড়ছে।

ও আমেদ, সুসংবাদ আছে। ও কী সুসংবাদ।। ও তােমার পাখির একটা গতি করা গেছে। ও তাই নাকি? বাহকী চমৎকার !

ও আমরা খােজ নিয়ে জেনেছি, সিয়াটল ওয়াশিংটনে এই পাখি এখনাে আছে। সিয়াটলে শীত এখনো তেমন পড়েনি। কাজেই পাখিরা মাইগ্রেট করেনি।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২১

ও বল কী?

ও আমরা তােমার পাখিটি সিয়াটল পাঠিয়ে দিচ্ছি। সিয়াটলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে, সে অন্য পাখিদের সঙ্গে মিশে মাইগ্রেট করবে।ও অসাধারণ।

আগামী মঙ্গলবার পাখিটি সিয়াটল যাচ্ছে। তুমি কেলা তিনটায় গুহাউণ্ড বাস স্টেশনে চলে আসবে। শেষবারের মত তােমার পাখিটাকে হ্যালাে বলবে।

ও অবশ্যই বলব।

সিয়াটল ফাগো থেকে তিন হাজার মাইল দূরে। পাখিটাকে খাচায় করে গ্রে হাউণ্ড বাসের ড্রাইভারের হাতে তুলে দেয়া হল। আমি হাত নেড়ে পাখিটাকে বাই

জানালাম।

মনে মনে বললাম, এই আমেরিকানরাই মাই লাই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। বােমা ফেলে হিরােশিমা নাগাশিকিতে। কী করে তা সম্ভব হয় কে জানে!

ক্যাম্পে আমার বরাবরই সন্দেহ ছিল আমেরিকানরা জাতি হিসাবে আধাপাগল। এদের রক্তে পাগলামি মিশে আছে। এমন সব কাণ্ডকারখানা করে যা বিদেশী হিসেবে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার থাকে না। যেমন ওদের ক্যাম্পিং-এর ব্যাপারটা ধরা যাক। আগে ক্যাম্পিং বিষয়ে কিছুই জানতাম না। কেউ আমাকে কিছু বলেও নি। নিজেই লক্ষ্য করলাম, সামারের ছুটিতে দলবল নিয়ে এরা কোথায় যায়। ফিরে আসে কাকতাড়ুয়া হয়ে, গায়ের

চামড়া খসখসে, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি, চুল উস্কখুকু। ওজনও অনেক কমে গেছে। সেই কারণেই হয়ত সবাইকে খানিকটা লম্বা দেখায়। কোথায় গিয়েছিলে জিজ্ঞেস করলে বলে,-ক্যাম্পে।

ও সেটা কি ?  ক্যাম্পিং কি তুমি জান না?  না।

আমার ‘না’ শুনে তারা এমন একটি ভঙ্গি করে—যেন আমার মত জংলি এ দেশে কেন এল তা তারা বুঝতে পারছে না।

খোজ নিয়ে জানলাম প্রতিটি আমেরিকান পরিবার বছরে খানিকটা জংলে কাটায়। তঁাবুটাবু নিয়ে কোন এক বিজন বনে চলে যায়। একে তারা বলে প্রকৃতির কাছাকাছি চলে যাওয়া। . ল্যাবরেটরীতে আমার সঙ্গে কাজ করে কোয়াণ্ডাল। সে তার ছেলে বন্ধুকে নিয়ে ক্যাম্পিং-এ গেল। ফিরে এল হাতে এবং পায়ে গভীর ক্ষতচিহ্ন নিয়ে। গিজলি বিয়ার (প্রকাণ্ড ভালুক) নাকি তাদের তঁাবু আক্রমণ করেছিল। ভয়াবহ ব্যাপার! অথচ রুথ কোয়াণ্ডাল এমন ভাব করছে যেন জীবনে এরকম ফলন হয়নি। আমি মনে মনে বললাম, বদ্ধ উন্মাদ।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২১

উন্মাদ রােগ সম্ভবত ছোঁয়াচে, কারণ পরের বছর আমি নিজেও ক্যাম্পিং-এ যাব বলে ঠিক করে ফেললাম। দেখাই যাক ব্যাপারটা কি? আমার দ্বিতীয় মেয়েটির বয়স তখন তিন মাস। ফার্গো শহরে যে কটি বাঙালী পরিবার সে সময় ছিল সবাই আমাকে আটকাবার চেষ্টা করল। তাদের যুক্তি-এত বাচ্চা একটা

পাগলামির কোন মানে হয় না। মানুষের উপদেশ আমি খুব মন দিয়ে শুনি,

তবে উপদেশ মত কখনো কিছু করি না। কাজেই চল্লিশ ডলার দিয়ে ইউনিভারসিটি থেকে একটা তবু ভাড়া করলাম, একটা এলুমিনিয়ামের নৌকা ভাড়া করলাম, আর ভাড়া করলাম ক্যাম্পিং-এর জিনিসপত্র। সেই সব জিনিসপত্রের মধ্যে আছে কুড়াল, ফার্স্ট এড বক্স, সাপে কাটার অষুধ এবং কী আশ্চর্য একটা হ্যারিকেন। খােদ আমেরিকাতেও যে কেরােসিনের হ্যারিকেন পাওয়া যায় কে জানত।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২২

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *