হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২২

যথাসময়ে গাড়ির ছাদে নৌকা বেঁধে রওয়ানা হয়ে গেলাম। গায়ে ক্যাম্পিং-এর পোশাক-হাফ প্যান্ট এবং বস্তার মত মোটা কাপড়ের ফাপ দেয়া শার্ট, মাথায় ক্রিকেট আম্পায়ারদের টুপির মত ধবধবে সাদা টুপি। গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে। বনে যাবার এই হচ্ছে নিয়ম। স্পীডিং এর জন্য পুলিশ অবশ্যই গাড়ি থামাবে, তবে যখন বুঝবে এই দল ক্যাম্পিং-এ যাচ্ছে তখন কিছু বলবে না। ক্যাম্পিং-এর প্রতি সবারই কিছুটা দুর্বলতা আছে।

হোটেল গ্রেভার ইন

| ফার্গো শহর থেকে দশ দশ কিলােমিটার দূরে একটা ক্যাম্পিং গ্রাউণ্ডে গাড়ি থামালাম। সমস্ত আমেরিকা জুড়ে অসংখ্য ক্যাম্পিং গ্রাউণ্ড আছে। ব্যক্তি। মালিকানায় এইসব পরিচালিত হয়। টাকার বিনিময়ে ক্যাম্পিং গ্রাউণ্ডে ঢোকা যায়। সেখানে ছােটখাটো একটা অফিস থাকে। বিজন জংলি জায়গা হালেও অফিসটা খুব আধুনিক হয়। টেলিফোনের ব্যবস্থা থাকে, ছোটখাটো বার থাকে, গ্রোসারী শপ এবং বেশ কিছু ভেণ্ডিং মেশিন থাকে। সাধারণত স্বামী-স্ত্রী মিলে অফিস এবং দোকানপাট দেখাশােনা করেন।

আমার গাড়ি টোকা মাত্রই ক্যাম্পিং গ্রাউণ্ডের ওয়ার্ডেন বিশালদেহী এক আমেরিকান বের হয়ে এল এবং অনকেটা মুখস্থ বক্তৃতার মত বলল, তুমি চমৎকার একটি জায়গায় এসেছ। এর চেয়ে ভাল ক্যাম্পিং গাউণ্ড নর্থ আমেরিকায় আর নেই। আমরা তুলনামূলকভাবে টাকা বেশি নিই, তবে এক রাত কাটালেই বুঝতে পারবে কেন নিই। এমন অপূর্ব দৃশ্য তুমি কোথায়ও পাবে না। তােমার সামনে সল্ট হ্রদের নীল জলরাশি, পেছনে গভীর বন। এ ছাড়াও তুমি পাচ্ছ আধুনিক জীবনযাত্রার প্রয়ােজনীয় সমস্ত উপকরণ, যেমন খবরের কাগজ এবং ফ্ল্যাস টয়লেট, , ,

ভদ্রলােকের বক্তৃতার মাঝখানেই আমি বললাম, কত দিতে হবে?

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২২

দেখা গেল টাকার পরিমাণ আসলেই অনেক বেশি। হ্রদে নৌকা ভাসানাের জন্য ফী দিতে হল, মাছ কেনার জন্য পারমিট কিনতে হল … নানান ফ্যাকড়া।।

ঝামেলা মিটিয়ে রওয়ানা হলাম জায়গা বাছতে। কোথায় তাঁবু ফেলব সেই জায়গা। ওয়ার্ডেনের স্ত্রী (উনার সাইজও কিংকং-এর মত} আমাকে সাহায্য

করতে নিজেই এগিয়ে এলেন। হ্রদের পাশে এসে চোখ জুড়িয়ে গেল। কাঁচের মত স্বচ্ছ জল। দশ ফুট নিচের পাথরের খণ্ডটিও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হ্রদ যত না সুন্দর পেছনের অরণ্য তার চেয়েও সুন্দর। যে কোন সুন্দর জিনিসের সঙ্গে খানিকটা বিষন্নতা মেশানাে থাকে। আমার মন বিষন্ন হয়ে গেল। গুলতেকিন বলছে— এত সুন্দর! এত সুন্দর।

হ্রদের কাছাকাছি তঁাবু খাটাবার জায়গা ঠিক করে কিংকং ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানালাম। ভদ্রমহিলা যাবার আগে বলে গেলেন, ক্যাম্পিং-এর যাবতীয় জিনিসপত্র নামমাত্র মূল্যে তাঁদের কাছে ভাড়া পাওয়া যাবে। তবে তারা চেক গ্রহণ করেন না। পেমেন্ট হবে ক্যাশে।

সকাল এগারটার মত বাজে। ঝকঝকে রােদ উঠেছে, বাতাসে ঘাসের বিচিত্র গন্ধ, চারদিকে নিঝঝুম। ফ্লাক্স ভর্তি করে চা এনেছিলাম। চা শেষ করে প্রবল উৎসাহে তাঁবু খাটাতে লেগে গেলাম। তাবুর সঙ্গে একটা ইনস্ট্রাকশন ম্যানুয়েল আছে—কোন খুঁটি কিভাবে পুঁততে হয়, তাঁবুর কোন আংটা কোন খুঁটিতে যাবে সব পরিষ্কার করে লেখা। কাজটা খুবই সহজ মনে হল। ঘণ্টা খানেক পার হবার পর বুঝলাম কাগজপত্রের কাজটা যত সহজ মনে হচ্ছিল আসলে তত সহজ নয়। তঁাবুর একটা দিক যখন কোন মতে দাড়ায় তখন অন্য দিক ঝুলে পড়ে।

সেইটা ঠিক করতে যখন যাই তখন গােটা তঁর মাটিতে শুয়ে পড়ে। আমার স্ত্রী এই দু ঘণ্টায় পৃঞ্চাশবারের মত ঘােষণা করল যে, আমার মত অকর্মণ্য মানুষ সে আর দেখেনি। সে হলে দশ মিনিটের মাথায় নাকি তাঁবু ঠিক করে ফেলত। আমি তাকে তার প্রতিভা প্রমাণ করার সুযােগ দিলাম। এবং আরাে এক ঘণ্টা নষ্ট হল। দেখা গেল তাঁবু খাটানায় তার প্রতিভা আমার মতই। | আমাদের ভঁৰু কেমন খাটানাে হয়েছে দেখার জন্য ওয়ার্ডেনের স্ত্রী বিকেলের দিকে এলেন এবং বললেন, সামান্য ফিসের বিনিময়ে তাঁবু খাটানাের কাজটা তারা করে দেন।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২২

ফী দেওয়া হল এবং চমৎকার তাবু তারা খাটিয়ে দিল। দুপুরে আমাদের কিছু খাওয়া হয়নি। খিদেয় প্রাণ বের হয়ে যাচ্ছে। বন থেকে কুড়াল দিয়ে কাঠ কেটে এনে আগুনে মাংস ঝলসে খাওয়াই হচ্ছে নিয়ম।

কাঠ যােগাড় হল, কিন্তু কিছুতেই আগুন ধরানাে গেল না। কেরােসিন ঢেলে দিলে আগুন জ্বলে ওঠে, খানিকক্ষণ জ্বলে তারপর আর নেই। আমি ওয়ার্ডেনের

স্ত্রীকে (মিসেস সিমসন গিয়ে বললাম, আপনি কি সামান্য ফীসের বিনিময়ে আমাদের চুলাটা ধরিয়ে দিবেন?

ভদ্রমহিলা আমার রসিকতায় খুবই বিরক্ত হলেন এবং গম্ভীর গলায় বললেন, কেরােসিন কুকার পাওয়া যায়। তার একটি নিতে পার।

দশ ডলার দিয়ে কেরোসিন কুকার ভাড়া করলাম। দুপুরে লাঞ্চ শেষ হল সন্ধ্যার আগে আগে। আমাদের ১তি প্রচুর ক্যম্পযাত্রী এখানে এসেছে, তবে তার সবাই চলে গেছে বনের দিকে। জলের দেশের মানুষ বলেই আমরাই একমাত্র জলের কাছাকাছি আছি। বনের চেয়ে জল আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। | সন্ধ্যায় নৌকায় খানিকক্ষণ বেড়ালাম। আমেরিকান নিয়ম অনুযায়ী সবার জন্য লাইফ জ্যাকেট ভাড়া করতে হল আরো কিছু টাকা পেলেন মিসেস সিমসন।

নৌকায় থাকতে থাকতে চঁাদ উঠে গেল। বিশাল ঈদ। পঞ্জিকা দেখে রওয়ানা হই নি। পাকে চক্রে পূর্ণিমার মধ্যে পড়ে গেছি। হ্রদের নিস্তরঙ্গ জলে চঁাদের ছায়া, দূরে বনরাজি, পাখপাখলির ডাক, অদ্ভুত পরিবেশ। আমি চিরকাল শহরবাসী, কাজেই পুরােপুরি হকচকিয়ে গেলাম। বারবার মনে হচ্ছে স্বর্গের যে সব বর্ণনা ধর্মগ্রন্থগুলিতে আছে সেই স্বৰ্গ কি এর চেয়েও সুন্দর? | তাবুতে ফিরলাম সন্ধ্যা মিলাকার অনেক পরে। গুলতেকিন রাতের খাবার বঁধতে বসল। আমি বড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বের হলাম। সে বলল, এই বনে কি বাঘ আছে?

আমি বললাম, আছে!

সে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, বাঘ আমাদের কখন খেয়ে ফেলবে বাবা?

জগতের সত্যগুলি শিশুরা খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে। কখনই তেমন বিচলিত হয় না। শিশুদের কাছে আমাদের অনেক কিছু শিখবার আছে।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২২

দুর্বাঘাসের চাদরে আদিগন্ত ঢাকা। বড় গাছগুলির অধিকাংশের নাম আমি জানি না। উইলী, ওক এবং ইউক্লিপটাল চিনতে পারছি। চাদের আলােয় চেনা গাছগুলিকেও অচেনা লাগছে।

এক সময় আমাকে থমকে দাড়াতে হল। যে দৃশ্যটা চোখে পড়ল তার জন্য আমার প্রাচ্যদেশীয় চোখ প্রস্তুত ছিল না। এক দল তরুণ-তরুণী বনের ভেতর ছােটাছুটি করছে। তাদের গায়ে কাপড়ের কোন বালাই নেই।

আমি শুনেছি আমেরিকানরা গভীর বনে প্রবেশ করার পর সভ্যতার শিকল– কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে। ফিরে যায় আদম এবং হাওয়ার যুগে। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা যার নাম। এই দৃশ্য নিজের চোখে কখনও দেখব তা ভাবিনি।

দৃশ্যটি আমার কাছে মােটেই অস্বাভাবিক বা অশ্লীল মনে হল না। বরং মনে হল এটাই স্বাভাবিক, এটাই হওয়া উচিত?

আমার মেয়ে বলল, বাবা! ওদের কি খুব গরম লাগছে? আমি বললাম, হঁা, চল আমরা ফিরে যাই।

আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলাম। কত রাত তা জানা হল না, ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করল না। মেয়ে দুটি তাঁবুতে ঘুমাচ্ছে। আমি এবং গুলতেকিন তাবুর বাইরে বসে আছি। স্বামী-স্ত্রীর প্রেমিক-প্রেমিকার মত ভালবাসাবাসির কথা কখনাে বলে না। সেই রাতে আমরা বিশ্বের আগের সময়ে কেমন করে যেন ফিরে গেলাম। পাশে বসা তরুণীটিকে অচেনা মনে হতে লাগল। বারবার মনে হচ্ছিল – এত আনন্দ আছে পৃথিবীতে।

ভােরবেলায় সূর্যোদয় দেখা আমার কখনো হয়ে ওঠে না। অথচ আশ্চর্যের জাপার অনেক রাতে ঘুমুতে যাবার পরেও জেগে উঠলাম সূর্য ওঠার আগে।

সূর্যোদয়ের দৃশ্যটি এত সুন্দর কখনাে ভাবিনি। আগে জানতাম না, সূর্যটাকে ডিমের কুসুমের মত দেখায়, জানতাম না ভোরবেলায় সূর্য এত বড় থাকে। এই সূর্য আকাশে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে, তাও ভ্রান্ত ছিল না।

সকালে নাশতা হল দুধ এবং শিরিয়েলের।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২৩

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *