হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২৩

নাশতার পর দলবদল নিয়ে মাছ ধরতে বের হলাম। আমেরিকায় বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে চাইলে স্টেট গভর্নমেন্টের কাছ থেকে লাইসেন্স করতে হয়। লাইসেন্দের ফী পনের ডলার। লাইসেন্স করা ছিল, তারপরও বুড়ি সিমসনকে পাঁচ ডলার দিতে হল। এটা নাকি লেক রক্ষণাবেক্ষণের ফী। বড়শি ফেলে মূর্তির মত বসে থাকার কাজটি খুব আনন্দদায়ক হবে মনে করার কোন কারণ নেই—তবু যেহেতু লাইসেন্স করেছি কাজেই বসে রইলাম।

শুনেছিলাম আমেরিকান লেকভর্তি মাছ, টোপ ফেলতে হয় না, সুতা ফেললেই হয়, সুতা কামড়ে মাছ উঠে আসে। বাস্তবে সে রকম কিছু ঘটলো না। আমি পুরো পরিবার নিয়ে মাছ ধরার আশায় ঝুঁ-আঁ রােদে তিন ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম। মাছের দেখা নেই। এক সময় বুড়ি সিমসন এসে উদয় হলেন এবং গম্ভীর গলায় বললেন, লেকের কোন জায়গায় মাছ টোপ খায় এবং কখন কিভাবে বড়শি

 হোটেল গ্রেভার ইন

ফেলতে হয় সেই বিষয়ে তাদের একটি বুকলেট আছে, সামান্য অর্থের বিনিময়ে তাসংগ্রহ করা যেতে পারে।

সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কি ভয়? কিনলাম বুকলেট এবং সঙ্গে সঙ্গে ফল লাভ। বিশাল এক নরদারর্ণ পাইক ধরে ফেললাম। এই আমার জীবনে প্রথম এবং শেষ মৎস্য শিকার। আমার বড় মেয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, বাবা এটা কি তিমি মাছ? বাবা, আমরা কি একটা তিমি মাছ ধরে ফেলেছি?

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২৩

দুপুরে লাঞ্চ হল সেই মাছ। ওয়েস্টার্ন ছবির কায়দায় আগুনে ঝলসিয়ে লবণ ছিটিয়ে খাওয়া। অন্য সময় এই মাছ আমি মুখেও দিতে পারতাম না। কিন্তু পরিবেশের কারণে সেই আগুনে ঝলসানো অখাদ্যকেও মনে হল স্বর্গের কোন খাবার।

লাঞ্চ শেষ হবার আগেই একটা দুঃসংবাদ পাওয়া গেল। জানা গেল ন’বছর বয়সী একটা ছেলে দলছুট হয়ে বনে হারিয়ে গেছে। ছেলেটির বাবা-মা ভাইবােন হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। বনে হারিয়ে যাবার ঘটনা নতুন কিছু না।

টিভি এবং খবরের কাগজে প্রায়ই এরকম খবর আসে। গত বছর উনিশ বছর বয়সী একটা মেয়ে মন্টানার এক বনে হারিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করা হয় তের দিন পূরে। সে এই তের দিন ব্যাঙ, সাপ-খােপ লতাপাতা খেয়ে বেঁচে ছিল। কেউ কেউ ইচ্ছে করেই বনে থেকে যায়। তেত্রিশ দিন পর হারিয়ে যাওয়া এক দম্পতিকে খুঁজে বের করার পর তারা বলেন-~-নাগরিক সভ্যতায় অতিষ্ঠ হয়ে তারা বনে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা ভালই আছেন। শহরে ফিরতে চান না।

ন বছর বয়সী শিশুটির নিশ্চয়ই এরকম কোন সমস্যা নেই। সে নিশ্চয়ই আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছে। ক্যাম্পে সাজসাজ রব পড়ে গেল। স্টেট পুলিশকে খবর দেওয়া হল। ঘন্টা খানিকের মধ্যে দুটি হেলিকপ্টার বনের উপর দিয়ে চক্রাকারে উড়তে লাগল। হেলিকপ্টার থেকে জানানাে হল বাচ্চাটিকে দেখা যাচ্ছে। একটা ফাকা জায়গায় আছে, নিজের মনে খেলছে। ভয়ের কিছু নেই।

|বাচ্চাটিকে যখন উদ্ধার করা হল, সে গম্ভীর গলায় বলল, আমি হারাব কেন? আমার পকেটে তাে কম্পাস আছে।

দুদিন থাকবার পরিকল্পনা নিয়ে গিয়েছিলাম, এক সপ্তাহ থেকে গেলাম। মিসেস সিমসন একদিন এসে বললেন, তােমরা আর থেকো না। বেশিদিন থাকলে

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২৩

নেশা ধরে যাবে। আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে না। এই আমাদেরকে দেখ, বছরের পর বছর এই জায়গায় পড়ে আছি। ঘণ্টা খানিকের জন্যও শহরে গেলে দম বন্ধু হয়ে আসে।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মিসেস সিমসন বললেন, সতেরাে বছর আগে আমিও আমার স্বামীর সঙ্গে ক্যাম্পিং-এ এই জায়গায় এসেছিলাম। এতই ভাল লাগল যে, লীজ নিয়ে ক্যাম্পিং স্পট বানালাম। তারপর থেকে এখানেই আছি। বছরে তিনটা মাস লােকজনের দেখা পাই, তারপর দুজনে একা একা কাটাই।

কষ্ট হয় না?

ও না। বনের অনেক রহস্যময় ব্যাপার আছে। তােমরা যারা দু’একদিনের জন্য আস, তারা তা ধরতে পার না। আমরা পারি! পারি বলেই ….

মিসেস সিমসন তার কথা শেষ করলেন না। আমি বললাম, রহস্যময় ব্যাপারগুলি কি ?

ও ঐ সব তােমরা বিশ্বাস করবে না। ঐ প্রসঙ্গ বাদ থাক।

তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বনের দিকে তাকালেন। রহস্যময় বন হয়ত কানে কানে তাকে কিছু বলল। দেখলাম তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

মিসেস সিমসন বললেন, একটা মজার ব্যাপার কি জান? সমুদ্র মানুষকে আকর্ষণ করে। এত যে সুন্দর সমুদ্র তার পাশেও তিন চার দিনের বেশি মানুষ থাকতে পারে না। আর বন মানুষকে আকর্ষণ করে। মানুষকে সে চলে যেতে দেয়। পুরােপুরি গ্রাস করতে চেষ্টা করে। কাজেই তােমরা চলে যাও।

আমরা চলে গেলাম।

সব মিলিয়ে সাত দিন ছিলাম। মিসেস সিমসন তিন দিনের ভাড়া রাখলেন। শান্ত গলায় বললেন, তােমরা তিন দিন থাকতে এসেছিলে সেই তিন দিনের রেন্ট-ই আমি রেখেছি। বাকি দিনগুলি কাটিয়েছ অতিথি হিসাবে। বনের অতিথি। বন তােমাদের আটকে রেখেছে। কাজেই সেই চার দিনের ভাড়া রাখার কোন প্রশ্ন ওঠেনা ।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২৩

নামে কিবা আসে যায় | ‘সামার হলিডে’ শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত সবার মনই এই সময় খানিকটা তরল অবস্থায় থাকে। অত্যন্ত কঠিন অধ্যাপককেও এই সময় নরম। এবং আদুরে গলায় কথা বলতে দেখা যায়।

আমার অধ্যাপকের নাম জোসেফ এডওয়ার্ড গ্লাস। গ্লাস নামের সার্থকতা বুঝানাের জন্যই হয়তাে ভদ্রলােক কঁচের মত কঠিন এবং ধারালাে। সামার হলিডের তারল্য তাকে স্পর্শ করেনি। ভাের ন’টায় ল্যাবে এসে দেখি সে একটা বিকারের কপার সালফেটের সল্যুসন বানিয়ে খুব ফঁকাচ্ছে। নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে, ভােরবেলা গ্লাসের সঙ্গে দেখা হলে সারাটা দিন খারাপ যাবে।

গ্লাসকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রবাদের কারণে নয়। মন খারাপ হলাে কারণ ব্যাটার আজ থেকে ছুটিতে যাবার কথা। যায়নি যখন তখন বুঝতে হবে সে এই সামারে দুটিতে যাবে না। ছুটির তিন মাস আমাকে জ্বালাবে। কারণ জ্বালানাের জন্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি ল্যাবে নেই। সবাই ছুটি নিয়ে কেটে পড়েছে।

আমি প্রফেসরের দিকে অকিয়ে নিষ্প্রাণ গলায় বললাম,-হাই।

গ্রাস আনন্দে সব ক’টা দাঁত বের করে বলল, তুমি আছে তাহলে। থ্যাংকস। এসাে দুজনে মিলে এই সল্যশনটার ডিফারেনসিয়েল রিফ্লেকটিভ ইনডেক্স বের করে ফেলি।

আমি বললাম, এটা সম্ভব । আমি আমার নিজের কাজ করবাে। এর মধ্যে তুমি আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হবাে।

বাংলাদেশের পাঠক-পাঠিকারা আমার জবাব শুনে হয়তাে আঁতকে উঠেছেন। আমার পি-এইচ-ডি গাইড এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রায় ঈশ্বরের মতাে ক্ষমতাবান একজন অধ্যাপকের সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলা যায় কিনা তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে না, তবে আমেরিকান চরিত্র সম্পর্কে যাদের কিছুটা ধারণা আছে, তারাই বুঝবেন আমার জবাব হচ্ছে যথাযথ জবাব।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২৩

প্রফেসর গ্লাস খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বলল, হামাদ, এটা সামান্য কাজ। এক ঘণ্টাও লাগবে না।

আমি বললাম, আমাকে হামাদ ডাকছ কেন? আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ। হামাদটা তুমি পেলে কোথায় ?

‘নাম নিয়ে তুমি এত যন্ত্রণা করাে কেন হামাদ ? নামে কিবা মায় আসে? আমি একজন ওল্ডম্যান। তােমাকে রিকোয়েস্ট করছি কাজটা করে দিতে। আর তুমি নাম নিয়ে যন্ত্রণা শুরু করে দিলে। | আমি ডিফারেনসিয়েল রিফুেকটিভ ইনডেক্স বের করে দিলাম। ঝাড়া পাচ ঘণ্টা লাগলো। কোনাে কিছুই হাতের কাছে নেই। সবাই ছুটিতে। নিজেকে ছুটাছুটি করে প্রত্যেকটি জিনিস জোগাড় করতে হয়েছে।

প্রফেসর গ্লাস আমার পাশেই চুরুট হাতে বসে খুব সম্ভব আমাকে খুশি রাখবার জন্যই একের পর এক রসিকতা করছে। রসিকতাগুলাের সাধারণ নাম হচ্ছে ডার্টি জোকস। ভয়াবহ ধরনের অশ্লীল।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন শেষ খন্ড

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *