ইয়াসমিন।
“উনি কী সরাসরি আপনার সঙ্গে কথা বলেন না প্ল্যানচেটের মাধ্যমে তাঁকে
আনতে হয়।‘
মানিব্যাগ নিয়ে রাতে আপনি যখন এসেছিলেন তখন আপনার একরকম ছিল—এখন অন্য রকম।
আমি বললাম, তাজমহল দিনের একেক আলোয় একে নহত যায়— মানুষ তাে তাজমহলের চেয়েও অনেক উন্নত শিল্পকর্ম মানুষের। বদলানাের কথা।
“আমার ধারণা ছিল আপনি মানুষ না।‘ ‘এখন কী ধারণা আমি মানুষ?
আশরাফুজ্জামান সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখেমা. লমান তাসলি। মনে হচ্ছে তিন অ| মার ব্যাপারে এখন সংমি না । লিট তামিম লললাম, একদিন দিনের বেলী এসে আপনাকে দেখাব লাদেন ভাল আমার ছায়া পড়ে।
আশরাফুজ্জামান সাহেব নীচু গলায় বললেন, মানুষ না, কিন্তু মানুষের মতাে জীবনের ওঁ দুনিয়া পড়ে।
“তাই নাকি? *জি। এরা মানুষদের মধ্যেই বাস করে।‘ “ও আচ্ছা।‘
“আমি অনেক কিছু জানি, কিন্তু কাউকে মন খুলে বলতে পারি না। কেউ। আমার কথা বিশ্বাস করবে না। পাগল ভাববে। মীরাকেও আমি তেমন কিছু বলিল
তিনি নীচু গলায় বললেন, ‘শুরুতে প্ল্যানচেট করে আনতাম। এখন নিজেই আসে । যা বলার সরাসরি বলে ।
তাকে চোখে দেখতে পান?” “সব সময় পাই না—হঠাৎ হঠাৎ দেখা পাই। আপনি বােধহয় আমার নেনা কণা বিশ্বাস করছেন না। অবিশ্বাসের একটা হাসি আপনার ঠোটে।’ – “আমি আপনার সব কথাই বিশ্বাস করছি। আমি তো মিসির আলি না যে। সব কথা অবিশ্বাস করব। আমি হচ্ছি হিমু। হিমুর মূলমন্ত্র হচ্ছে বিশ্বাসে মিলায়। বস্তু, তর্কে বহুদূর।”
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৩
“মিসির আলি কে?”
“আছেন একজন। তাঁর মূলমন্ত্র হচ্ছে তর্কে মিলায় বস্তু, বিশ্বাসে বহুদূর । তার ধারণা জীবনাটা অঙ্কের মাতা। একের সঙ্গে এক যােগ করলে সব সময় দুই হবে। কখনাে তিন হবে না।’
তিন কী হয়?
“অবশ্যই হয়—আপনার বেলায় তাে হয়ে গেল। আপনি এবং মীরা—এক এক দুই হবার কথা। আপনার বেলায় হচ্ছে তিন । মান্নার মা কোথেকে যেন উপস্থিত হচ্ছেন।‘
“আপনি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলেন। চা খাবেন?‘ “চা কে বানাবে, মীরা তাে বাসায় নেই।”
‘চা আমিই বানাব। ঘর সংসারের কাজ সব আমিই করি। চা বানানাে, রান্না—সব করতে পারি। মােগলাই ডিশও পারি ।
“আপনার কোনাে কাজের লােক নেই?
‘আমাকে বলতে চাচ্ছেন? “জ্বি না।”
বলতে চাইলে বলতে পাােেন।। “আচ্ছা, আমাকে দেখে কী আপনার মনে হয় আমি অসুস্থ?” না, তা মনে হচ্ছে না।‘
মীরার ধারণা আমি অসুস্থ। যতই দিন যাচ্ছে ততই তার ধারণা প্রবল হচ্ছে। অথচ আমি জানি আমি খুবই সুস্থ–স্বাভাবিক মানুষ। আমার অস্বাভাবিক। বলতে এইটুকু যে মীরার মা‘র সঙ্গে আমার দেখা হয়, কথাবার্তা হয়।
“তাই বুঝি?
“জ্বি। মানিব্যাগ হারিয়ে গেল। আমি খুবই আপসেট হয়ে বাসায় এসেছি। আমি মােটামুটি ভাবে দরিদ্র মানুষ এতগুলি টাকা। মীরাকে খবরটা দিয়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছি তখন মীরার মা‘র সঙ্গে আমার কথা হল। সে বলল, তুমি মন–খারাপ কোরাে না টাকা আজ রাতেই ফেরত পাবে। আমি মাকে বললাম, সে হেসেই উড়িয়ে দিল।
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৩
নেই কেন? মীরার মা পছন্দ করেন না?” “জ্বি না। আপনি ঠিক ধরেছেন।
“কোলাে কাজের মানুষের সাহায্য ছাড়া মেয়েকে বড় করতে আপনার। কোনো সমস্যা হয় নি।‘
“সমস্যা তাে হয়েছেই। তবে ইয়াসমিন আমাকে সাহায্য করেছে। যেমন ধন মেয়ে রাতে কাঁথা ভিজিয়ে ফেলেছে । আমি কিছু বুঝতে পারছি অচেতন। ইয়াসমিন আমাকে ডেকে তুলে বলবে— মেয়ে ভেজা কাল ত পারছি না, বুনে জা কথায় শুয়ে
পা দেন না। তাঁরা জানেন অ্যান্টিলজিক হচ্ছে লজিকেরই উলটো লিস।
“হিমু সাহেব!” থায় বমি করে “আপনারা চা নিন। চায়ে আপনি ক‘চামুচ চিনি খান।
“যে মত চামুচ দেয় তত চামুচই খাই। আমার কোনােকিছুতেই লোনাে লাবাধা নিয়ম নেই।”
‘আমি এক চামচ চিনি দিয়েছি।‘ ‘খুব ভাল করেছেন। এবং চা অসাধারণ হয়েছে—গরম মসল্লা দিয়েছেন
নাকি?”
সামান্য দিয়েছি— এক দানা এলাচ, এক চিমটি জাফরান । এবারের জন্যে
বাহ ভাল তো।‘
মীরার একবার খুব অসুখ হল। কিছু খেতে পারে না, যা আয় করি ফেলে দেয়—শরীরে প্রবল জ্বর। ডাক্তাররা কড় কড়া অ্যান্টিবায়ােটিক জ্বর সারছে না। তখন ইয়াসমিন এসে বলল, তুমি মেয়েকে অষুধ খাওয়ানো
*যা এলাে দি করাে। কাগজিলেবুর সরবত ছাড়া কিছু খাওয়াবে না।” |
‘আপনি তা–ই করলেন? | প্রথম দিকে করতে চাই নি। ভরসা পাচ্ছিলাম না কারণ মেয়ের তল এর আলাপ । তাকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। এরকম একজন রোগীর অধলল ।
করে দেয়াটা কঠিন কাজ।‘
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৩
‘অর্থাৎ আপনি আপনার স্ত্রীর কথা পুরােপুরি বিশ্বাস করেন নি। | ‘জি করেছি, কিন্তু সাহস হচ্ছিল না। মেয়ের অবস্থা আরও যখন খারাপ হল। তখন প্রায় মরিয়া হয়েই অষুধপত্র বন্ধ করে লেবুর সরবত খাওয়াতে । করলাম । দুদিনের মাথায় মেয়ে পুরােপুরি সুস্থ হয়ে গেল ।”
এরকম ভুত–ডাক্তার ‘ঘরে থাকাটাতাে খুব ভাল। “দয়া করে আমার স্ত্রীকে নিয়ে কোনাে রসিকতা করবেন না। আমি এমিতেই। রসিকতা পছন্দ করি না। স্ত্রীকে নিয়ে রসিকতা একেবারেই পছন্দ করি না। চা খাবেন কি–না তা তাে বলেন নি।’
‘চা খাব।‘
আশরাফুজ্জামান সাহেব চা আনতে গেলেন। সন্ধ্যা সাতটার মতাে বাজে ।পুরাে রাত আমার সামনে পড়ে আছে। আশিরাফুজ্জামান সাহেব চা বানাতে থাকুন। আর আমি বসে বসে গুছিয়ে ফেলি রাতে কি কি করব। অনেকগুলি কাজ জমে অাছে।
“খুব ভাল করেছেন।
“আমার স্ত্রী চা নিয়ে অনেক পরীক্ষা–নীরিক্ষা করত। কমলালেবুর খোসা শুকিয়ে রেখে দিত । মাঝে মাঝে চায়ে সামান্য কমলালেবুর খােসা দিয়ে দিত। অসাধারণ টেস্ট। কমলালেবুর শুকানাে খােসা আমার কাছে আছে, একদিন আপনাকে খাওয়ান্ত।‘
‘জি আচ্ছা। একটা কথা আপনার স্ত্রী কী এই বাড়িতেই থাকেন, মানে ভুত হবার পর আপনার সঙ্গেই আছেন?”
‘ইয়াসমিন প্রসঙ্গে ভূত প্রেত এই জাতীয় শন্দ দয়া করে ব্যবহার করবেন
‘জি আচ্ছা, করব না। উনি কী এখন আশেপাশেই আছেন?”
‘তার উপস্থিতি আপনি বুঝতে পারেন?
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৩
ক) আঁখি নামের মেয়েটার সঙ্গে যােগাযােগ হয় নি। যােগাযােগ করতে হবে। টেলিফোন করলেই ও পাশ থেকে পোঁ পোঁ শব্দ হয়। বাদল কি টেলিফোন নাম্বার ভুল এনেছে?
খ) মেজো ফুপু জরুরি খবর পাঠিয়েছেন। আমার মনে হয় আঁখি–সংক্রান্ত বিষয়েই আলাপ করতে চান।
গ) এক পীরের সন্ধান পাওয়া গেছে—নাম ময়লা বাবা। সারা গায়ে ময়লী মেখে বসে থাকেন। তার সঙ্গে একটু দেখা করা দরকার ।
ঘ) মিসির আলি সাহেবের ঠিকানা পাওয়া গেছে। ভদ্রলােকের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা। উনি কথা বলবেন কি না কে জানে! যুক্তিসংগত কারণ উপস্থিত না। করলে উনি কথা বলবেন বলে মনে হয় না। এই ধরনের মানুষরা যুক্তির বাহারে “আমি কি তার সঙ্গে কথা বলতে পারি?‘
“আপনি কথা বললে সে শুনবে। সে আপনার সঙ্গে কথা বলবে কি–না, তাতাে জানি না। সে মীরার সঙ্গেই কথা বলে না। মীরা তার নিজের মেয়ে।
‘আমি আপনার স্ত্রীকে কিছু কথা বলতে চাচ্ছিলাম । কি ভাবে বললঃ বাতি নিভিয়ে বলতে হবে?
‘বাতি নিভাতে হবে না। যা বলার বলুন, সে শুনবে।‘
সম্বােধন করব কি বলে? ভাবী ডাক?‘ “হিমু সাহেব! আপনি পুরাে ব্যাপারটা খুব হালকা ভাবে নেবার চেষ্টা | করছেন। এটা ঠিক না। আমার স্ত্রীকে আপনার যদি কিছু জিজ্ঞেস করার থাকে জিজ্ঞেস করুন। আমি তার কাছ থেকে জবাব এনে দিচ্ছে।‘ ‘চা শেষ করে নি। চা খেতে খেতে যদি উনার সঙ্গে কথা বলি – উনি হয়ত এটাকে বেয়াদবী হিসেবে নেবেন।‘
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৩
আবারাে রসিকতা করছেন?‘
গণ্ডীর গলায় ই এখন আমাকে এই উপস্থিত আছেন। মি জানি না তাদের
কমলালেবুর খোসা দিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে লি খেয়ে দেখলা
অন্য সময় এসে খেয়ে যাব। আমার খুব কিছু জরুরি কাজ আছে । আমি রাস্তায় নামলাম।
প্রথমে যাব মেজো ফুপুর কাছে। ছেলের বিয়েভাঙার শোক তিনি সামলে উঠেছেন কি না কে জানে, মেয়ের বিয়েভাঙ্গার শােক সামলানাে যায় না। ছেলের বিয়েভাঙ্গার শােক ক্ষণস্থায়ী হয়। এইসব ক্ষেত্রে ছেলের মা একটু বােধ হয় খুশিও হন—ছেলে আর কিছু দিন রইল তাঁর ভ্রানার নিচে। ছেলের বিয়ে নিয়ে এত ভাবারও কিছু নেই। মেয়েদের বিয়ের বয়স পার হয়ে যায়। ছেলেদের বিয়ের বয়স পার হয় না। হয়েছিলাম । কি দেখে ভয়।
আমি চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে গভীর বললাম আমার ভাল নাম হিমালয়। ডাকনাম হিমু। সবাই এখন আর নামে চেনে। আমাকে বলা হয়েছে মীরার মৃতা মা এই বাড়িতে উপস্থিত আমি এর আগে কোন মৃত মানুষের সঙ্গে কথা বলিনি। আমি জানি না সঙ্গে কি ভাবে কথা বলতে হয়। আমার কথা বার্তায় যদি কোন না প্রকাশ পায়– দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন। আমি আপনার কাছ থেকে ব্যাপার জানতে চাচ্ছি। আমি এক রাতে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম । কি তে পেয়েছিলাম সেটা কি আপনি বলতে পারবেন?
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৩
কথা শেষ করে মিনিট পাঁচেক চুপচাপ বসে রইলাম । আশরাহ সাহেবও চুপচাপ বসে আছেন। তার চোখ বন্ধ । মনে হয় তিনি মা পড়েছেন। ঘুমন্ত মানুষের মত তিনি ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছেন। তার হা ভাঙ্গাবার জন্য আমি শব্দ করে কাশলাম। তিনি চোখ মেললেন না, তবে চড়ে বসলেন। আমি বললাম,
“উনি কি আমার কথা শুনতে পেয়েছেন?’
পেয়েছে।‘ উত্তরে কি বললেন? “সে এই প্রসঙ্গে কিছু বলতে চায় না।‘
আমি আজ বিদায় নিচ্ছি। মীরাকে বলবেন আমি এসেছিলাম । “আরেকটু বসুন, মীরা চলে আসবে। তার বান্ধবীর জন্মদিনে গিয়েছে। বলে।
Read More