এই কারণেই শুভ ‘ বাদল লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল । হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, আঁখির সঙ্গে স্ত্রী নিয়ে কথা বলব সেটাই বুঝতে পারছি না। বােকার মতাে হয়তো কিছু বলব। পরে সে এটা নিয়ে হাসাহাসি করবে।
“করুক–না হাসাহাসি। তাের যা মনে আসে তুই বলবি। দুই একটা কবিতা টলিতা মুখস্ত করে না।‘
কা কবিতা প্রেমের কবিতা । “প্রেমের তাে অনেক কবিতা আছে কোনটা মুখস্থ করব সেটা বলাে।
কোনটা বলব, আমার তাে দুই–তিন লাইনের বেশি কোনো কবিতা মনে েি না ।”
এভাবে নয়, এভাবে ঠিক হয় না। কীভাবে হয়? কেমন করে হন? কেমন করে ফুলের কাছে রা । গন্ধ আর বাতাস দুই জনে....
এভাবে হয়, এমন ভালাে হয়। বাদল বলল, এটা কার কবিতা, তােমার?
‘পাগল হয়েছিস? আমি কবিতা লিখি নাকি? এই কবিতা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের।
“কতদিন পর তােমাকে দেখছি কি যে অদ্ভুত লাগছে।” “অদ্ভুত লাগাচ্ছে। ‘ই লাগছে । আঁখির সঙ্গে বেশী গল্প হবে তােমাকে নিয়ে। “ওকে নিয়ে আবার খালিপায়ে হাঁটতে বের হবিনাতাে।”
“অবশ্যই বের হব। আমি পরব হলুদ পাঞ্জাবী, ওকে পাৰ হলুদ শাড়ি। তারপর .....
সেটা বলতে পারব না। লজ্জা লাগছে। হিমুল শােন তােমার জন্যে আমি খুব সুন্দর একটা গিফট এনেছি। আন্দাজ করতাে কি?”
“আন্দাজ করতে পারছি না।’‘
“একটা খুব দামী লীপিং ব্যাগ নিয়ে এসেছি। তুমিতাে যেখানে সেখানে রাত | কাটা ও ব্যাগটা থাকলে সুবিধা ব্যাগের ভেতর ঢুকে পলালে । শিপিং লাশের কালার তােমার পছন্দ হবে না । মেরন কালার । অনেক খুঁজেছি– হলুদ পাইনি।’
বাদল শ্রীপিং ব্যাগ নিয়ে এল । বােঝাই যাচ্ছে। অনেক টাকা দিয়ে কিনেছে। “হিমুদা পছন্দ হয়েছেঃ “খুব পছন্দ হয়েছে।‘
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৮
ব্যাগটা থাকায় তােমার খুব সুবিধা হবে। ধর তুমি জঙ্গলে জোছনা দেখতে গিয়েছ। অনেক রাত পর্যন্ত জোছনা দেখলে ঘুম পেয়ে গেলে–– কোন একটা। গাছের নিচে ব্যাগ রেখে তার ভেতর ঢুকে গেলে।
‘আমারতাে এখনই ব্যাগ নিয়ে জঙ্গলে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।‘
“আমারাে ইচ্ছে করছে– হিমুদা চল কাছে পিছের কোন একটা ভাঙ্গালে চলে । যাই — জয়দেবপুরের শালবনে গেলে কেমন হয়।।
‘ বিয়ের আগে তাের কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। বিয়ে হয়ে যাক তারপর | তুই আর আঁখি, হিমু ও হিমি ...... | আমি বাক্যটা শেষ করার আগেই রণরঙ্গিনী মূর্তিতে ফুপু ঢুকলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে খরখরে গলায় বললেন, তুই কাদের নিয়ে বাসায়।
“দুই–তিন লাইনই বলাে। এক সেকেণ্ড দাড়াও–আমি কাগজ কলম নিয়ে। আসি—লিখে ফেলি।
বলল গঙার ভঙ্গিতে বলপয়েন্ট আর কাগজ নিয়ে বসেছে। আমি কবিতা বলল, সে লিখে মুখস্থ করবে, বাসররাতে তার স্ত্রীকে শােনাবে। হাস্যকর একটা বাপার কিন্তু আমার কেন জানি হাস্যকর লাগছে না। বাদল বলল, কই, চুপ। করে আজ কেন, বলাে।
আমি বললাম, লিখে ফেল—
এভাবে নয়, এভাবে ঠিক হয় না। ‘নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে পাহাড় তাকে সয় না।।
এসেছিস? বাদল দুটাকে জোগাড় মরেছিস কোথায়।
আমি হচকিয়ে গিয়ে বললাম, কেন, ওরা কী করেছে। ‘দটাই তাে নেংটো হয়ে ছাদে নাচানাচি করছে। তার ফুপাও নাচছে..
বল কী। ‘তই এক্ষুণি এই মুহূর্তে এদের নিয়ে বিদেয় হবি।‘
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালাম। আমার বগলে বাদলের তা মেরুন ব্লৱে স্লিপিং ব্যাগ ।নাম কি রকম ভাইজান?
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৮
আমি ঘুম ঘুম গলায় বললাম, জানি না । বলেই জাপার লাগিয়ে দিলাম। স্লিপিং ব্যাগটা আমি আসলে এনেছি এই দু‘জনকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেবার জন্যে। হিমুরা স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে পথে হাঁটে না। আমি ঠিক করেছি বাকি রাতটা শ্রীপিং ব্যাগে ঘুমুব। সকালে ব্যাগ থেকে বের হয়ে এক কাপ চা খাব। তারপর পিতা এবং পুত্রকে ব্যাগটা উপহার দিয়ে চলে যাব। আহা এই দুজন আল্লাম করে ঘুমাক ।
ছেলেটার চেহারা খুব মায়াকাড়া। কি নাম ছেলেটার? আচ্ছা নামটা সকালে জানলেও হবে। এখন ভাল ঘুম পাচ্ছে। সামান্য দুঃশ্চিন্তাও হচ্ছে বাদলাদের বাড়ি থেকে মােফাজ্জল এবং জহিরুলকে নিয়ে আসা হয় নি। এরা এতক্ষণে কি কান্ড করছে কে জানে? মনের আনন্দে ছাদ থেকে লাফিয়ে না পড়লেই হয়।
শ্রীপিং ব্যাগটা আসলেই আরামদায়ক। ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে। ভাইজান, ও ভাইজান।
ফুটপাতে যারা ঘুমায় দেখা যাচ্ছে তাদের কিছু নীতিমালা আছে । জায়গা বদল করে না। ঘুমুবার জায়গা সবারই নির্দিষ্ট। যে নিউমার্কেটের Eমায় সে যুলি সন্ধ্যাবেলায় বাসাবােতে থাকে সেও হেটে হেটে নিউকে পাশে এসে নিজের জায়গায় ঘুমুবে।।
কাজেই বস্তা ভাইকে খুজে বের করতে আমার অসুবিধা হল না। দেখা গেল। সাত দিন আগে তারা যেখানে দুমুচ্ছিল এখনাে সেখানেই ঘুমুচ্ছে। পিতা এল। পত্র চটের ভেতরে ঢুকে আরামে নিদ্রা দিচ্ছে। আমি তাদের ঘুম ভাঙ্গালাম। বক্স ভাইয়ের পুত্রের বয়স খুবই কম। চার পাঁচ বছর হবে। কাচা ঘুম ভাঙ্গায় সে। খুবই ভয় পেয়েছে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি । বললাম— এই পারল তার নাম কি?
‘ গাবল জবাব দিল না। বাবার কাছে সরে এল । বাবা বিরক্ত মুখে বলল, আলাের ন্নি বিষয়া চান কি?
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৮
‘ আমি হাসিমুখে বললাম, আমাকে চিনতে পারছেন না। আমি হচ্ছি। আপনাদের সহনিদ্রক। একসঙ্গে ঘুমালাম মনে নেই। শেষ রাতে জ্বর উঠে। গেল । আপনি রিকশা ডেকে আমাকে ধরাধরি করে তুলে দিলেন।
মনে আছে। আপনে চান কি? “কিছু চাই না। আপনাদের সঙ্গে ঘুমাব অনুমতি চাচ্ছি।” “অনুমতির কি আছে গভমেন্টের জায়গা। ঘুমাইতে ইচ্ছা হইলে ঘুমাইবেন।
আমি তাদের পাশে আমার প্লিপিং ব্যাগ বিছালাম। পিতা এবং পুত্র দুজনেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ব্যাগের জীপার খুলে আমি ভেতরে ঢুকে পড়লাম। তাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না।।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম এই জিনিশটার নাম শ্রীপিং ব্যাগ। এর — সুবিধা ভেতরে ঢুকে তাপার লাগিয়ে দিলে – শীত লাগবে না, মশা। কামড়ালে না । বছর সময় ভিজতে হবে না। চোর এসে তুলে নিয়ে চলে যেতে পারবে না। চোর যদি নিতে চায় আমাকে শুদ্ধ নিতে হবে।
‘তা ভাই তার বিস্ময় সামলাতে পারল না। মাণ স্বরে বলল, এই জিনিসটা |
‘আমার ছােলে আফনের এই জিনিসটা একটু হাত দিয়া দুইল্লা দেখতে চায়। “উই ময়লা হবে। হাত যেন না দেয়।’
‘আচ্ছা। ছেলের নাম কি ‘সুলায়মান।
হেলের মা কোথায়?” সেইটা ভাইজান এক বিরাট হিস্টরি। “থাক বাদ দিন, বিরাট হিরি শােনার ইচ্ছা নেই ঘুম পাচ্ছে। “ভাইজান?”
‘জিনিসটার ভিতরে কি দুইজন শােয়া যায়? “তা যায়। বড় করে বানানাে।‘ ।
বালিশা আছে?” “না বালিশ নেই। বালিশের দরকার হয় না।
“যদি কিছু মনে না নেন ভাইজান, সুলেমান জিনিশটার ভিতরে কি একট। দেখতে চায়। তার খুব শখ হইছে।‘ | আমি ভেতর থেকে বের হয়ে এলাম । পিতা এবং পুত্রের কাছে ব্যাগ বুলিয়ে দিলাম। তারা হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের হতভম্ব দৃষ্টি দেখে আমার চোখে পানি আসার উপক্রম হল।
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৮
হিমুদের চোখে পানি আসতে। নেই—আমি ওদের পেছনে ফেলে দ্রুত হাঁটছি। রাস্তার শেষ মাথায় এলে । একবার পেছনে ফিরলাম। পিতা পুত্র নদনই ব্যাগের ভেতর ঢুকেছে । দুজনই । মাথা বের করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে । কে জানে তারা কি ভাগছে ।
বাবার উপদেশ আমি অনেক দিন থেকেই মেনে চলছি। খােলা প্রান্তরে শােয়া সম্ভব হচ্ছে না– দরজা–জানালা খােলা দরে ঘুমুচ্ছি। তস্কলের হাতে পড়েছি তিনবার। প্রথমবার সে একটা দামি জিনিসই নিয়ে গেছে— ওয়াকম্যান। সনি কোম্পানীর ওয়াকম্যান আমাকে উপহার দিয়েছিল রূপা । কপার উপহার দেয়ার পদ্ধতি খুব সুন্দর। গিফট র্যাপে মুড়ে লাল রিবনের মুল লাগিয়ে বিরাট শিল্পকর্ম । রূপা গিফট আমার হাতে দিয়ে বলল, নাও, তোমার জন্মদিনের
ঘুম ভেঙেই দেখি আমার বিছানার পাশের চেয়ারে বাদল বসে আছে।
–ল আছে। আমি চট করে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সাতসকালে বাদলের আমার কা থাকার কথা না। আজ ২৩ ডিসেম্বর। কাল রাতে তার বিয়ে হয়েছে। ৯ ভােরবেলাতেই সে আমার কাছে চলে আসবে কেন? চোখ বন্ধ করে ব্যাপক একটু চিন্তা করা যাক।
আমি থাকি আগামসি লেনের একটা মেসে। মেসের ঠিকানা বাদল জানে । শুধু বাদল কেন, আমার পরিচিত কেউই জানে না। বাদলকে সেই তান খুজে বের করতে হয়েছে। সেটা তেমন জটিল কিছু না—আগে যে–মেসে ছিলাম। সেই মেসের ম্যানেজার নিতাই কুণ্ডু বর্তমান মেসের ঠিকানা জানেন। তাতে যদিও বলা হয়েছে আমার ঠিকানা কাউকে দেবেন না—তার পরেও ভদ্রলোক দিয়েছেন। বাদল নিশ্চয়ই এমন কিছু বলেছে বা করেছে যে ঠিকানা না দিয়ে পারে।
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৮
‘ একবার মেসে ঢুকে পরার পর আমার ঘরে ঢােকা অবিশ্যি খুবই সহজ। আমি দরজা এবং জানালা সব খােলা রেখে ঘুমাই । হিমুকে তা–ই করতে হয় । আমার বাবা আমার জন্যে যে উপদেশনামা লিখে রেখে গেছেন তার সপ্তম । উপদেশ হচ্ছে
আমি বললাম, আজ তাে আমার জন্মদিন না।
সে নিজের মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, তােমার কবে জন্মদিন। সেটা তাে আমি জানি না। তুমি আমাকে বলবেও না। কাজেই আমি ধরে নিলাম। আজই জন্মদিন।
“ও আচ্ছা।
ও আচ্ছা না, বলাে থ্যাংক অ্যাও। উপহার পেলে ধন্যবাদ দেয়া সাধারণ ভদ্রতা। মহাপুরুষরা ভদ্রতা করেন না, তা তাে না।
ধন্যবাদ। কী আছে এর মধ্যে
একটা ওয়াকম্যান। তুমি তাে পথে পথেই ঘুরে বেড়াও। মাঝে মাঝে এটা কানে দিয়ে ঘুরবে। আমার পছন্দের তেরাে টা গান আমি রেকর্ড করে দিয়েছি।‘
আবারো ধন্যবাদ।’
আমি খুব যত্ন করে টেবিলের মাঝামাঝি জায়গায় রূপার উপহার সাজিয়ে রাখলাম। সাজিয়ে রাখা পর্যন্তই। ব্যাটারির অভাবে গান শােনা গেল না। রূপা মূল যন্ত্র দিয়েছে, ব্যাটারি দেয় নি। আমারও কেনা হয় নি। মাঝে মাঝে যন্ত্রটা। শুধুশুধু কানে দিয়ে বসে থাকতাম । কানের ফুটো বন্ধ থাকার জন্যেই বােধহয় শেশো শব্দ হত। সেই শব্দও কম ইন্টারেস্টিং ছিল না। যাই হােক এক ব্রাতে চোর (বাবার ভাষায়—তস্কর) এসে আমাকে ব্যাটারি কেনার যন্ত্রণা থেকে বাচাল।
দ্বিতীয় দফায় তস্কর এসে আমার স্যান্ডেলজোড়া নিয়ে গেল। হিমুর স্যান্ডেল | থাকার কথা না–খালি পায়ে হাটাহাটি করার কথা। তারপরও একজোড়া। চামড়ার স্যান্ডেল কিনেছিলাম। দাম নিয়েছিল দুশাে তেত্রিশ টাকা। সাতদিনের মাথায় স্যান্ডেল চলে গেল।
তৃতীয় দফায় চোরের হাতে আমার বিছানার চাদর এবং বালিশ চলে গেল। আমার ঘুমন্ত অবস্থায় চোর কী করে বিছানার চাদর এবং বালিশ নিয়ে গেল সেই রহস্যের সমাধান এখনও হয় নি।
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৮
চোর–বিষয়ক সমস্যা নিয়ে এখন মাথা ঘামাবার কিছু নেই—আমার সামনে। জটিল সমস্যা বসে আছে — বাদল। আমি চট করে দ্বিতীয়বার তাকে দেখে নিলাম। তার চোখেমুখে হতভম্ব ভাব। রাতে একফোটাও ঘুমায় নি তাও বােঝা |
নিদ্রা ও জাগরণের যে বাধাধরা নিয়ম আছে, যেমন দিবসে জাগরণ নিশাকালে নিদ্রা–এইসব নিয়ম মানিয়া চলার কোনাে আবশ্যকতা নাই। কোন রকম নম্বনে নিজেকে বাঁধিও না। খােলা মাঠ বা প্রান্তরে নিদ্রা দিতে চেষ্টা করিবে। কোনাে প্রকোষ্ঠে শয়ন করিলে সেই প্রকোষ্ঠের দরজা–জানালা সবই খুলিয়া রাখিলে যেন নিদ্রাক্কালে খােলা প্রান্তরের সহিত তােমার নিদ্রাকক্ষের যােগ। সাধিত হয় ।
‘ত্রিকালে তক্ষর বা ডাকাত আসিয়া তােমার মালামাল নিয়া পলায়ন করিবে। এই চিন্তা মাথায় রানি না, কারণ তার আকর্ষণ করিবার মতো কিছু তােমার *নাে থাকবে না। যদি থাকে তবে তাহা হতঙ্কর কর্তনক নিয়া যা ওয়াজ নন্দময় নিশি জাগরণ তার কাছে ছিল দুঃস্বপ্নের যাচ্ছে। চোখের নিচে কাতল নিচে এক রাতেই কালি পড়ে গেছে । আনন্দময় নিছি। চোখের নিচে কালি পড়ে না।
Read More