সেন্টার টেবিলে ঝিঙে রেখে ষাঁড়ের মতো চেঁচাল, গিরি! এই গিরি।
গিরিবালা রান্না ঘর থেকে বেরােতেই সেনার টেবিলে দিকে আঙুল দেখিয়ে নােটন বলে, জিঙে। তুই পাতুরি করতে পারিস?
গিরিবালা বিরক্ত হয়ে বলে, এগুলাে কি ওখানে রাখার জিনিস? তােমার আঙ্কেল দেখে বলিহারি যাই।
তুই পাতুরি করতে জানিস কিনা বল । না বাপু, জানি না। কিছুই তাে জানিস না দেখছি। চাকরিটা বহাল রেখেছিস কি করে?
আর একটা গিরিবাল জুটিয়ে আনাে, তারপর ওকথা বলাে। পাতুরি–হাতুরি সব বাঙলাদেশের রান। ওসব আমি জান না।
শিকবি তাে! ঝিঙে দিয়ে কত কী হয়! তুই জানস শুধু ঝিঙে পােস্ত। ঝিঙে পােস্তুতে আবার কবে থেকে অরুচি হল তােমার? দিব্যি তাে দেখি চেটেপুটে খাও।
তা বলে ভ্যারাইটি থাকবে না? তাের কোনও ইমাজিনেশন নেই।
নেই তাে নেই। বলে গজ গজ করতে করতে গিরিবালা ঝিঙেগুলাে তুলে নিয়ে রান্নাঘরে সেধােলাে সােফায় বসে সামনে ঠ্যাং ছড়িয়ে দিয়ে নােটন কিছুক্ষণ বিড়বিড় করল, ঝিঙে পােষা ফিডে পােস্ত।
নােটনের জগৎ খেলাময়। ফুটবল, ক্রিকেট টেনিস, তাে আছেই, এমন কি সে রাগবি না বেসবলেরও খবর রাখে। খাে খাে, কাবডি, জেলাওয়রি স্পাের্টস কিছুই তার জয় জগতে বাইরে নয় । জ্যোৎস্না দেবী, অর্থাৎ তার মা, প্রাই বলেন, খেলাই তােকে খেলাে।
দোতালায় একটা চমৎকার ল্যান্ডিং মতা বানানাে হয়েছে। এটা তােতনের প্যা! র দুই আগে দোতালার দুটো ঘর ভেঙে এই ল্যান্ডিং করা হয়েঝে। ফুলের টব, সােফাসেট দিয়ে দিব্যি সজানাে । একধারে টিভি, দেয়ালের ব্র্যাকেটে বানাে স্টিরিও। নােটন সকাল এই চমৎকার জায়গাটায় বসে খবরের কাগজ পড়ে এবং টিভি-র ইংরিজি খবর শােনে ।।
আজকের খবরের কাগজে পাতাটা বডড ম্যাড়ম্যাড়ে। তেমন কিছু নেই যা নােটন ইতিমধ্যেই জানে না। টিভি খবরটাও নিতান্তই জোলাে লাগল। ধাক্কা দেওয়ার মতো খবর নেই ।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
খবরের কাগজ আবা ভাঁজ করে রেখে দিয়ে এবং টিভি বন্ধ করে নােটন কিছুক্ষণ ভীষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর হঠৎ বুঝতে পাল, দোষটা খবরের কাগজ বা টিভির নয়। তার মন যে কোথাও বসছে না তার কারণ একটা চাপা উবেগ। বিকেলে পাত্রী দেখতে যেতে হবে-এই দুশ্চিন্তাই তাকে আনমনা রেখেছে।
মেয়েদের সম্পর্কে নােটনের এই সঙ্কোচ আর মৃদু ভয় এ জন্মে যাবে না। বড় ড়ে বসে গেছে । বাবার কথায় রাজি হল বটে, কিন্তু এখন তার দুশ্চিন্তা দেখা দিচ্ছে। এর কোনও ধরা-ছোঁয়ার মতাে। কারণ নেই। কিন্তু মহিলা-ঘটিত যে- কোনও ব্যাপার থেকেই সে শত হস্ত তফাতে
ল্যান্ডিং-এর রেলিং-এ ভর দিয়ে নিচের দিকে চেয়ে নােটন একটা হাঁক মারল, ব্রেকফাস্ট কী হচ্ছে রে শিরি?
গিরি রান্নাঘরের দরজা দিয়ে মুখ বের করে বলে, ডিম হচ্ছে। আর টোস্ট । দূর দূর! তার চেয়ে একটু কচুরি-টচুরি কতে পরতিস তাে! রবিবারটা মাঠে মারা গেল । কচুরি খাবে সাে আগে বলতে হয়।
বলাল না যে, তাের ইমাজিনেশন নেই! রাবিবারের ব্রেকফাস্ট শুধু ডিম আর পাউরুটি? ছ্যাঃ ছ্যাঃ ।
তা মাকে গেয়ে বলাে না। আমি কি নিজে থেকে করেছি ।
মা? বলে হাঃ হাঃ করে অট্টহাসি হাসল নােটন, মার কথা বলিনি। আমেরিকা থেকে সাহেব ছেলে এসেছে তাে, তাই সাহেবী খান হুকুম করে বসে আছে।
আহা, তােতন কি কলকাতায় আছে নাকি? সে তাে কাল ধবাদে পিসির বাড়ি গেছে।
তাহলে সাহেবী খান কর জন্য হচ্ছে শুনি। ‘ এসব হাঁকডাক ছাদের ঠাকুরঘর অবধি ঠিক পৌছে গেল : জ্যোৎস্নাময়ী অর্থাৎ নােটনের মা এ সময়ে ঠাকুরঘরে থাকেন । গীতার একটি অধ্যায় গদ্যানুবাদ সহ ন পড়ে ঠাকুরঘর ছাড়েন না।
পড়া শেষ করে প্রণাম করার সময় ছেলের হাঁকডাক কানে গেলে সংসার জায়গাটা যে কত খারাপ, কত তুচ্ছ জিনিসে ভরা, কত পাপে আকীর্ণ তা জ্যোৎস্নার চেয়ে ভাল আর কে জানে! তিনি প্রণামটা তেমন ভক্তির সঙ্গে শেষ করতে পারলেন না। অপােগও হেলেটার আবার অপছন্দের কী হল? তিনি তাড়াতাড়ি নেমে এলেন।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
ল্যান্ডিং থেকেই অনুচ্চ স্বরে বললেন, ও গিরি ! কচুরিই কর মা। একটু খাটুনি বাড়ল তাের, তা দুপুরের মাংসটা না হয় আমিই রান্না করব। পূজোর কাপড়টা ছেড়ে আসছি দাঁড়া।। | গিরি নিচে থেকে জবাব দিল, খাটুনির ভয় করি নাকি? তাহলে কি এ বাড়িতে টিকতে পারতাম। শুধু বলি বড় আসকারা দিচ্ছে। এই তাে সকালে বাবু বললেন খওয়া কমাবেন, হুঁড়ি হচ্ছে । এখনই আবার কচুরির বায়না । ঝিঙে পাতুরি যেতে চাইছে।
গিরি একটটু গজগজ করে ঠিকই, আবার যা সেই করে দেয়। বিশেষ করে নােটনেরটা । অপােগ বলেই বােধহয় তার উপর সকলের একটু মায়া আছে ।
ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে জ্যোৎস্না ছেলের দিকে একবার তাকালেন, বড় বায়না করিস।
দ্ৰ কুঁচকে মায়ের দিকে চেয়ে নােটন বলে, বাওয়া ছাড়া আর কোন ব্যাপারে তােমাদের জ্বালাই বলাে তাে। আমার মতাে লক্ষ্মী ছেলে পাবে?
হ্যাঁ, খুব লক্ষ্মী। সেই জন্যেই তাে বলে আর কথা বুজে না পেয়ে জ্যোৎস্না ঘরে গেলেন।
নােটন অবশ্য পুরাে ব্যাপারটাই দু’ সেকেন্ডে ভুলে গেল। ফিরে এল সেই দুশ্চিন্তাটা। আজ তােতনের পাত্রী দখতে যেতে হবে। কোনও রােমন্টিক ব্যাপার নয়। পাত্রী দেখা মানে অনেকটা বেছেটেছে খাসীর মাংস কেনার মতােই ব্যাপার। আর এ হল ভাবী চ্য-ভ্যাঁ, ঝগড়া কাজিয়া, বায়নাক্কা-ন্যাকামি, রান্না-বান্না এইসব নিয়ে বেড়ে বকর মুখপাত্র মাত্র । মাঝে মাঝে নােটন ভেবে পায় না সে বিবাহিত লােকদের ঘেন্না করে কিনা। | ওই ছেলে-কোলে তার বােন মিষ্টি এল । আলুথালু চেহারা। চুল, নাইট, মুখচোখ সবই যেন অগােছালাে। গত সাত দিন তহল বাপের বাড়িতে এসে বসে আছে, আমেরিকা থেকে ভাই এসেছে
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
বলে। ছুতাে পেলেই চলে আসে। কোমরে চর্বি জমেছে, বিয়ের আগে যে কাটা – কাটা ধারাল মুখচোখ এবং বুদ্ধির দৃপ্ত ছিল তা সবই এক সুখসন্তোষজনিত মেদ-বাহুসাে ডুবে গেছে ।
ছােড়দা, একটু ধরাে না গাে বাচ্চাকে । বিয়ে-টিয়ে পছন্দ না করলেও নােটন বাচ্চাদে রখুবই পছন্দ করে।
শিশুরাই তার এই প্রিয় যে ফুটপাতের ভিখিরির বাচ্চা দেখলে অবধি সে দু’ মিনিট দাঁড়িয়ে যায়। এক আশ্চর্যের ব্যাপার,বাচ্চারাও তাকে খুবই পছন্দ করে। মিষ্টির এই এক বছর বয়সী ছেলেটা
অসম্ভব মা-ন্যাওটা। কারও কাছে যায় না। কিন্তু নােটন হাত বাড়ালেই ঝাপ খেয়ে চলে আসে।