হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-১৪)

শাখা খুব অচেনা মেয়ে নয়। রি স্কুলেই পড়ত, কয়েক হাত নিচে। বিয়ের সময় দেখেছেন জ্যোৎস্নাময়ী । সেই মেয়ে যে এমন সাংঘাতিক শত্রু হয়ে দাড়াবে কে জানত? এসব কথা পঁচকান কৰ যায় না, কিন্তু সমব্যথী তাে চাই। বন্টি আর মিষ্টির সঙ্গেই শুধু যা পরামর্শ করা যায়। কর্তাকে বলতে গিয়ে আহম্মক হতে হল। অবনী বললেন, শুধু মেয়েটিকে দুষছো কেন? পরের মেয়ে বলে? তােমার ছেলের দিকটা খতিয়ে দেখেছাে? ফলে কর্তার সঙ্গে কথা চলেনি।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়নােটনকে বলতে গেলেন, নােটন হাঃ হাঃ করে হেসে বলল, তা করুক না শর্মিষ্ঠাকে বিয়ে। ডির্ভোস হয়ে যাক, তারপর রেজিস্ট্রি করে নিলেই হবে। আর যদি লিভিং টুগেদার করতে চায় তাে তাতেই বা আপত্তি কি? এই নারী প্রগতির যুগে তােমাদের এত কুসংস্কার কেন মা? জ্যোৎস্নাময়ী রেগে গিয়ে বলেছেন, ওরে , তাের চেয়ে তাে আমি একটু বেশী মেয়েমান, নাকি? নারী প্রগতি কাকে বলে তা আমি হাড়ে হাড়ে জানি। কিন্তু ও পাগলের সয়ে কথা কয়েও জ্যোস্নামীয় কোনও লাভ হয়নি । তােতন দেশে ফেরায় যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনি দুশ্চিন্তাও বড় কম নয়। সেই মেয়েটা এখন তাে এ দেশেই বনে আছে। এই তাে তােতন তাকে ধরতে সোঁদরবন অবধি ঘুরে এল। রতনের কাছে শুনেছেন জ্যোৎস্নাময়ী তাতে বল 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

ভরসা পানে না । দুটিতে নাকি খুব ভা। | ভাবে আশার আলাে একটাই । তােতন অনেক রাগ করেও বিয়েতে নিমরাজি হয়েছে। ঠাকুর, ঠাকু বলে যদি বিয়েট; ঘটাতে পারেন তাহলে জ্যোস্নামীর বুকটা জুড়ােবে। 

কিন্তু একটা মুশকিল হলে, ছেলের বিয়ে দেওয়ার ব্যগ্রতায় এখন তিনি যে মেয়ে দেখছেন তাতেই পাশ করে ফেলেছেন। গত সপ্তাহে একটি শ্যামলা দাঁত উঁচু মেয়ে, একটি বেঁটে এবং 

সামান্য ট্যারা মেয়েকে তিনি মােটামুটি পছন্দ করে মেয়েদের কাছে ধমক খেয়েছেন। বাটি তাে বলেছে, তুমি আর মেয়ে দেখাে না তাে মা। একেবারে ডােবাবে। 

আজ বরানগরেরটা যদি পছন্দই হয় তাহলে বাঁচেন জ্যোৎস্না। রাস্তায় কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ যাদের দেখতে যাচ্ছেন তাদের কেউ তেমনটা চোখ লাগছে না। চেহারাটা আছে তাে লেখাপড়া নেই, লেখাপড়া আছে তাে স্মার্টনেস নেই, গান জানে তাে চেহারা নেই। বড্ড জালাতন হচ্ছেন জ্যোৎস্নাময়ী | পাগল ছেলেটা ফিরল বেলা আড়াইটেয়। আগে ছেলে না খেলে যেতেন না জ্যোৎস্ৰাময়ী, ভাত আগলে বসে থাকতেন কিছুকাল হল গ্যাসের ব্যথা ওঠায় এবং ছেলে ধমকটক করায় বটে, কিন্তু সে ঠিক খাওয়া নয়। ভাত বসা মাত্র। আজ আরও অরুচি, বুকের ভিতর এক উদ্বেগ থাবা বসিয়ে রেখেছে বরানগরে মেয়েটা কেমন হবে? ভাল যেন হয় ঠাকুর। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

খেয়ে উঠে দোতালার জানালায় পর্দার আড়ালে বসে উকি মেরে ছিলেন জ্যোত্সায়ী ! কলেই খেয়ে দেয়ে ছুটির দুপুরে বিশ্রাম নিচ্ছে। তিটোতে পারেন না শুধু জ্যোৎস্যময়ী। পাগলটার জন্য তাে কেউ বলে নেই, ওর জন্য চিন্তাও নেই কারও। 

ফটক খুলে উসকো-খুসকো চুল আর শুকনাে মুখে ওই ঢুকল এলে। সঙ্গে একট বাচ্চা ছেলে। কে জানে কে। জ্যোৎস্নাময়ী। নেমে এলেন নিচে। ওটা কে তাের সঙ্গে? | একগাল হেসে নােটন বলে, এটা মহা বিচ্ছু একটা ছেলে । কানাই । এরই ঠাকুলা আজ মারা গেল। কদিন থাকুক, তারপর ওর মা এসে নিয়ে যাবে। 

ওর যা কোথায়? বজবজ না কোথায় যেন থাকে। 

জোৎস্নানী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এ কাও নতুন নয়। গরব-দুঃখীর জন্যে ছোড়ার প্রাণ কলে সেটা খারাপ নয়। কিন্তু এরকম একটা বিশিষ্ট অভিজাত বাড়ির অন্দরমহলে ও পাগলা যাদের মাঝে মধ্যে এনে হাজির করে, তাদের দেখলে শিউরে উঠতে হয় এমন হাচ নােংরা সব মানুষ। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

য, বাকে রাগ অভিমান করে কোনও লাভ হয়নি। | এ কি খাবে? 

নােটন অবহেলায় বলল, খাবে বলে কি আর ভাত চড়াতে হবে নাকি? আমারটা আছে তাই থেকে ভাগ করে দেবাে। অবহেলায় আমার ভরপেট খাওয়াও ঠিক হবে না। 

মড়া ছুঁয়েছিস? 

ইচ্ছে ছিল না। তবে বুড়ােটা বড় গুণী ছিল। দারুণ আড়বাঁশি বাজাত । কেসময়ে একটু শিখিয়েছিল আমাকে। তাই দেননামােননা করে কাঁধটা দিয়েই ফেল। তাহলে হলঘরেই দাঁড়া। আগুন আর লােহা ছুঁতে হবে। আর ও ঘেঁড়ার তাে শেী । ও তাে মাছ-মাংসের ছোঁয়া পাবে না। তারে, মুড়ি-মুড়ি খেয়ে থাকতে পারবি? 

খুব পারবে না। এক ধামা মুড়ি-বাভাসাই দাও। জলে ভিজিয়ে মেরে দেবেন। | এইসব ব্যবস্থা করতে দুপুর গড়িয়ে গেল। নােটন থেয়ে উঠতে উঠতে সােয়া তিনটে। হলঘরের দেয়ালঘড়ির দিকে চেয়ে জ্যোৎস্নামী বললেন, তুইও নাকি বরানগরে যাবি আমদের সঙ্গে? হা মা। পিতৃআদেশে রাম বনবাসে গিয়েছিলেন । আমারও একরকম তাই যেতে হবে। 

তাহলে আর ওয়েটুয়ে কাজ নেই। আমরা চারটের মধ্যে বেড়েবে। কড়েয়া থেকে বান্টিকে তুলে নিতে হবে। তৈরী হয়ে নে। 

তিনি যে আর বেশী দিন বাঁচবেন না এটা জ্যোৎস্নাময়ী আজকাল টের পাচ্ছেন ; এত উদ্বেগ এত শান্তি নিয়ে বেশী দিন কেউ বাঁচে না। আজকাল বুকের ভিতরটা সব সময়ে ধড়ফড় করে সবসময়ে ল; বুক শুকিয়ে থাকে এক অদ্ভুত তেষ্টায় । ঘুম কমে যাচ্ছে। খাওয়ায় অরুচি এভাবে কত দিন বাঁচে লেকে? 

অপচ সৃণ উপণের অভাব ছিল ন জ্যোৎস্নামীর। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

তিন  আজকাল আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না পরাণের । নিউ জার্সির ছােটো যে শহরে সে বাড়িখানা কিনেছে সেটা আমেরিকার আর পাঁচটা শহরের মতােই ছিমছাম, ছবির মতাে সুন্দর। সুপায় স্টোর আছে, টেনিস ক্লাব আছে, সুইমিং পুল আছে, বনভূমি আছে,বনভূমিতে হর্স রাইডিং, জগিং, ফরেন্ট ওয়াক সব আছে। তার বাড়িটা ছােট এবং যথারীতি চমৎকার। এখনও পরাগের দুটো গাড়ি । তার মায়ের ওমােবাইল এবং নিজের ভােলডাে। তার পূরােনাে চাকরিটা নেই। মাথার চুল নেই। সেই স্বাস্থ্য ভেসে গেছে অনেকদিন। আজকাল সে একা বাড়িতে ভয় পায় । ঘুম হয় না ভাল । নতুন যে চাকরিটা সে পেয়েছে সেটা ভাল নয়। অর্থাৎ তত ভাল নয়। এবং সে সেরকম মন প্রাণ দিয়ে কাজ করতে পারে না। মনােযোেগ জিনিসটাই সে হারিয়ে ফেলেছে ক্ৰমে। এসব কাটিয়ে ওঠার জন্য সে মাঝখানে মদ খাওয়া ধরেছিল। জীবনে পায়নি। তাই জোর করে খেতে গিয়ে সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ত। আজকাল খায় না। কিন্তু একটা কালাে লােক তার কাছে প্রায়ই আসে এবং ধীরেধীরে ড্রাগ ধরতে বলে। সেই লােকটা হয়তাে দয়ালু। সে বলে, ড্রাগ সম্পর্কে যে সব অপপ্রচার হচ্ছে তাতে ঘাবড়াতে নেই। মানুষকে তাে কথা ভুলে থাকতে হবে। জীবন কদিনের বলাে? 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *