হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-১৮)

না, সে শুধু মারছেই না, মার খাচ্ছেও। তার দুর্বল শরীরের ওপর বয়ে যাচ্ছে মারের ঝড়, চারদিক থেকে। কিন্তু কিছু তেমন টের পাচ্ছে না সে। এ শরীর যেন তার নয়। দাঁত, নাক, কপাল কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরােচ্ছে। কিন্তু এ রক্ত যেন অন্য কারও। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়কে যেন প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে, হে ল ! ওঃ গড, হেল্প! দিস ইজ মার্ডার! কার গলা! সেই মেয়েটা! এখনও পালায়নি! কী বােকা। পরাগের হাত পা সব অসাড় হয়ে আসছে। মুছে যাচ্ছে চোখের আলাে। মাথা ঝিমঝিম । সে কি ঘুমােবে? খুব টানা শান্ত নিরুদ্বেগ ঘুম! শা-ভরা ঘুম নাখা-ভরা ঘুম! কতকাল ঘুমােয়নি পরাগ! সে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজল। খুব বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শিয়রের কাছে মা বসে আছে বুঝি! 

মা, আমার বড় শিশু হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। একটুখানি একটা বা+তােমার কোলে শুয়ে আছি। কেমন, মা? কেন বড় হলুম বলাে তো! বড় হয়েই তাে সব গুলিয়ে গেল মা! কী যে হল

ঘুমাে পরাগ। শান্ত হয়ে ঘুমাে। 

যাই মা! যাই। ঘুমের দেশে যাই। আলাে নেই, অন্ধকার নেই। কিছু নেই। মরবার পর কি ওরকম? কিছু নেই, কেউ নেই। মরা মানে কি না হয়ে যাওয়া! | ‘া বাবা। বেশ মা, তাই ভাল । না হয়ে যাওয়া খুব ভাল। ডলার নেই, চাকরি নেই,গাড়ি নেই, ওপরে ঠা নেই, নিচে নামা নেই, না মা? 

তাই। বেশ মা, এরকমই ভাল। না হয়ে যেতেই তাে চাই। না, একদম না। মা! কি বাবা? ও মেয়েটা বােধহয় চোর। 

কোন মেয়েটা? তোর গাড়িতে যে শুয়ে আছে? দর বােকা! কী নেবে তাের, নিক না । তাের আর কিছুই দরকার হবে না। শুধুই ঘুমিয়ে থাকবি। 

হ্যাঁ হ্যাঁ, তাও তাে বটে। 

মেয়েটা চেচাচ্ছিল। পালাতে পারত, কিন্তু চুড়ান্ত অপমান এবং সম্ভাব্য মৃত্যুর হাত থেকে যে রােগ্য বিদেশী লােকটা তাকে বাঁচিয়েছে তাকে এভাবে ফেলে সে পালাতে চাইল না চেঁচাতে লাগল, ইট ইজ মার্ডার! হে ! 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

হারলেম-চষা চারজন কৃষ্ণাঙ্গ যুবকও বড় ঘাবড়ে গেছে। এ তাদের এলাকা। এখানে কখনও কোনও বীরপুরুষ তাদের সঙ্গে টা ষ্টো করেনি। এ লােকটার হঠাৎ হল কী? কোথেকে এস জুল? এ কি মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড? কিন্তু বয়ফ্রেন্ডরাও তাে এরকম সাহস দেখায় না আজকাল! চারজনের একজনের একটা দাঁত নড়ে রক্ত পড়ছে। একজনের চোখের কোল ফুলে গেছে। বাকি দুজন দৃশ্যত অক্ষত হলেও তারা দুজনেই পরাগের লাথি বা ঘুষি খেয়েছে। মারটা বড় কথা নয়। একজন রােগ দুর্বল লোক তাদের মতাে অভ্যস্ত তাকে আর কীই বা করতে পারে। কিন্তু গাট! * একটা ছেলে মেয়েটার ফিরে বলল,ইউ শাট আপ, উই আর নষ্ট গােয়িং টু ডু এনিথিং টু ইউ. ইউ কুড হ্যাভ টোন্ড আস দ্যাট ইউ গট এ বয় ফ্রেন্ড কামিং এলং।

ইয়াঃ সিস্টার। 

বিস্মিত চার কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ভূপতিত নিথর পরাগের দিকে একবার তাকিয়ে চটপট অদৃশ্য হয়ে শে । 

মেয়েটা তার ছেড়া কামিজ গায়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল পরাগের পাশে, ওঃ ডিয়ার! টুক এ লট অফ বিটিংস । মে বি ডেড। ও গড! | একে একে লােকজন জুটল । তারপ এক পুলিশ। তারপর অ্যাম্বুলেন্স। পাঁজরের চারটে হাড় ভাঙা, নাক থ্যাবড়ানো, চোয়ালের তিসলােকেশন এবং চুর রক্ত ক্ষরণ ছাড়াও গভীর অবসাদ স্নায়ু বৈকল্য পরাগকে প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। চব্বিশ ঘন্টা তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হল । নাকে নল, শরীরে ড্রিপের হুঁ। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

সেদিনকার সান্ধ্য দৈনিকে ছােটো করে খবরট। বােররালাে বিভিন্ন কাগজে । | ইন্ডিয়ান সেডস্ এ গাল। ভায়ােলেন্স ইন সেন্ট্রাল পার্ক । নিউ ইয়র্ক টাইমস্ এবং নিউ জার্সি আর পেনসিলভানিয়ার অনেক স্থানীয় কাগজে খবটা বেরােলে অনেক বাঙালীর চোখে পড়ন। 

তারপর একে-ওকে ফোন করে করে খবরটা চাউর করে দিল। পরাগ- সেই টোটালি ফ্রাষ্ট্রেটেড লােকটা- হিরাে হয়ে যাচ্ছে নাকি? নিউ ইয়র্কের হাসপাতালে অনেকেই দেখতে গেল তাকে। পরাগ 

তখনও গভীরভাবে আচ্ছন্ন। প্রাণ সংশয় দেখা হল না। তবে পরাগ ছােটো খাটো খবর হয়ে উঠল। 

পরাগের সত্যিকারের জ্ঞান ফিরল তিন দিন বাদে । বিকেলে। শরীর অসড়ি, মাথায় পাহাড়ের ভার, এক অতলান্ত ক্লান্তি আর শক্তিহীনতায় সে জড়বস্তুর মতাে হয়ে আছে। মাখা বড় শূণ্য। সে নিজের নামটা পর্যন্ত মনে করতে পারছে না। 

পঞ্চম দিনে সে একটু হেলান দিয়ে বসতে পারল । বুকের খাঁচা পাস্টারে মােড়া। শরীরের সর্বত্র ব্যথা আর ব্যথা ( ব্যথা যেন শেষ নেই। ঘরে কিছু ফুলের বেকে সাজানাে। তার মধ্যে একগুচ্ছ ভায়ােলেট- যার দাম অনেক। এল ডাক্তার । এল পুলিশ। 

বিকেল এল একটি মেয়ে। হাই, আই অ্যাম স্টেলা । মাথা এখন কাজ করছে না। মেয়েটাকে সে চিনতে পারল না। 

মেয়েটা একটা কেক এনেছে আর এক গােছা টাটকা ফুল। কেকটা তার হাতে দিয়ে বলে, আই বেন্ড ইট ফর ইউ। ডু ইউ রিমেম্বর মি? আই ওয়াজ দা গার্ল ইউ সেভড় । 

পরাগ মাথা নাড়ল, আমি কিছু করিনি খুকি । তােমাকে বাঁচানাের জন্য নয়, আমি এ নিরন্তর একঘেয়েমির ঘেরাটোপ ছিড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমি অর্থহীন এক বেঁচে থাকার হাত থেকে পরিত্রাণ চেয়েছিলাম । আমি চেষ্টা করেছিলাম এ অভিনব আত্মহত্যা ঘটাতে। আত্মহত্যা এক পুরুষােচিত কাজ, সেটাই কি করে বীরত্ব হয়ে গেল দেখ। 

অবশ্য এসব কথা সে মুখে উচ্চারণ করল না। সে শুধু মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বলল, ইট ওয়ভ নাথিং । 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

মেয়েটি দেখতে কেমন তা বুঝতে পারেনা পরাগ। অথলীটের মতাে সুন্দর সতেজ শরীর। বেশ লম্বাও। তবে মুখখানা কিন্তু রুক্ষ । মেয়েটা লম্বা চুল রাখে । সােনালী আর সাদা স্টাইপের একখানা শার্ট আর জিনস-এ ওকে খুবই তরুণী দেখচ্ছে। বয়স হয়তাে মেরে কেটে উনিশ-কুড়ি।ব্যাগ থেকে কয়েকটা খবরের কাগজ কাটিং বের করে তাকে দেখাল স্টেলা,ইউ আর নাউ এ সেলিব্রাইটি। 

কাটিংগুলাে দেখল পরাগ দু-একটা কাগজে তার ছবিও দিয়েছে। হয়তাে লাইসেন্স থেকে ফটো কপি করে নেওয়া। মেয়েটি বলে, চ্যানেল ফোর-এ তার ফটো দেখানাে হয়েছে পরশুদিন। তারা পরাগের একটা ইন্টারভিউ-ও নেবে। 

এসব কী হচ্ছে তা বুঝতে পারে না। তার ভারী ক্লান্ত লাগে। জীবনের অর্থ কি এরকম ফুরিয়ে যায়নি তার কাছে? 

হাসপাতালে তাকে এখন প্রচুর পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানাে হচ্ছে। গাদা গাদা বলকারক ওষুধ আর ইঞ্জেকশন চলছে। তবু ভরা পেটেও মেয়েটির নিজের হাতে তৈরি করা কেকটি চমৎকার লাগে পরাগের। “ওঃ ইট নাইস, ভেরি টেস্টফুল।” বলায় মেয়েটি লজ্জায় খুশিতে ডগমগ করে ওঠে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *