হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-২)

তাে আর বেশী নয়। এবার ছাড়াছাড়ি হওয়ার পালাসময়টুক নষ্ট করতে আছে

ঠিকই তােতােতন সুতরাং বাইরে থেকে তার চোখ প্রত্যাহার করে নিবের করল সতেরাে বছরের যৌবনকে। 

রাস্তাটা সেভাবেই ফুরােলোএক পরিণতিহান শুভদৃষ্টিতে। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়কোনও কোনও জায়গা আছে যেখানে পা দিলেই পূর্বজন্মের কথা মনে আসে যেন মনে হয়, এ জন্মে নয়, আর জলে কখনও এখানে ছিলুমআশাদ মিঞার ঘাটে বাস থেকে নেমে মাথার মধ্যে চলকে উঠল স্মৃতিকখনও আসেনি এখানে তবু কেন এরকম চেনাচেনা মনে হচ্ছে তার

মলিন দুটি নাইলনের বাজার ব্যাগ আর বেতের হ্যাঞ্জেলওয়ালা চুবড়ি নিয়ে সেই কিশােরী আর তার মা নামল সামনের দরজা দিয়েমেয়েটাকে এই প্রথম মুখােমুখি দেখল তােতনপিছন থেকে আর পাশ থেকে যতটা ভাল দেখাচ্ছিল, মুখােমুখি ততটা নয়আর এই উজ্জল দুপুরের রােদে সাদাটে টপভূমিতে কেমন বেঁটে, তুচ্ছ, কালােও দেখল নাকি? মেয়েটা তৃষিতের মতাে কয়েক পলক চেয়ে রইল তােতনের দিকেতােতনওতণে এখন আর ক্রিটিকের চোখ, প্রেমিকের নয়,পূজারীরও নয়ন্যাড়া উদোম বালিয়াড়ি ধরে ঘাটের দিকে আরও মানুষের পিছু পিছু চলে গেল তারা হারিয়ে গেল, চারিদিনের মতাে, তােতনের কাছে ট্র্যাজিক এন্ড । 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

জায়গাটা কি আহামরি কিছু কে জানে! তবে নদী আছে, নদীর ধারের আবহমানকালের উদাসী হাওয়া আছে, আছে মনকেমন-করদিগন্তসব মিলিয়ে একটা সিনথেসিস বা কেই জন্মান্তরের রিজা খুলবার জন্য চাৰি যুঁজছে। 

তােতন কি এক জনই শেষ! কই না তাে! ধামাখালির এই ঘাটে বাড়া রােদে দাড়িয়ে তার হঠাৎ কেন মনে হয় জন্মজন্মান্তরে দাড়িয়ে আছে সে

দমড়ার বেড়া আর টিনের চালের যে দোকানগুলাে প্রায় সর্বত্র নদীর ঘাটে দেখা যায় তারই একটার সামনে, খােলা জায়গায় পাতা বেঞ্চ মালে ঝেড়ে দিয়ে রতন বলে, দাদা, একটু বসুনআমরা আসছি। 

বিরক্ত হন বলে, আবার কোথায় যাও

এই এলুম বলে। ততক্ষণে একটা ডবল হাফ চা — সবেগে মাথা নেড়ে তােতন বলে,কক্ষণাে নয়। 

দুই মূর্তিমানইবাদা অঞ্চলের মাটামারা লেক, বাস থেকে নেমেই পায়জামা একটু তুলে কোমরে জেছে। তােতনের মস্ত চামড়রা ব্যাগটা রতনের কাঁধে। তােতনকে এখন অবধি বইতে দেয়নি। ওই ঝা-চকচকে দেখনধারী ব্যাগখানা এখন রতনের প্রেস্টিজের জিনিস। তােতন “ব্যাগটা রেখে যাও না” বাতে সবেগে মাথা নেড়ে বলে উঠল, “না না কি যে বলেন। তারপরই দুই মূর্তিমান দুদিকে ছুট লাগল । 

শরৎ এল বলে। তবু গরম এখনও আছে। রােদে বসলে ঘাম হয়। কিন্তু তােতন গরম তেমন টের পাচ্ছে না। নদীর হুড় হাওয়া এসে হিলিবিলি কেটে যাচ্ছে চলে । এলােমেলাে করে দিচ্ছে :থা। চলকে উঠছে স্মৃতি । ক্রিটিক্যাল সে জায়গাটাকে আর দেখছে না। দেখছে ঘুমঘুম, রহস্যময় গভীর 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

এক চোখে। 

এখানে কি কোনও জন্মে ছিল তােতন? 

আধগুন্টা পরে বাঁধের মতাে উচু উদোম জায়গাটা দিয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে রতনকে আসতে দেখা গেল। কাছে এসে হাপসানাে গলায় বলে, না পাওয়া গেল না। আজ আবার পরব আছে । 

কী পাওয়া গেল না রতন? 

কাচুমাচু মুখ করে রতন বলল ভেবেছিলুম একটা রিজার্ভ করা ভটভটিতে নিয়ে যাবে। তা সুবিধে হল না। দেখা যাক আরশাদ মিঞার ঘাটে যদি বাসুটা পায়। | রজার্ভ করা! সেটা আবার কী? রিজার্ভ করার দরকার কী? 

রতন খুব বােকা-বােকা হেসে বলে, ভাবলুম আজেবাজে লােকের ভীড়ে না গিয়ে বেশ আঁকা ভটভটিতে নিজের মতাে যেতেন। 

সেইজন্য সময় নষ্ট করছ? 

তােতন রেগে যেতে পারত। কিন্তু ধামালির ঘাটে তার পূর্বজন্ম ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে ততটা রাগ হল না। এই অঞ্চলের লােকের কোনও সময়জ্ঞান নেই, তাড়া নেই। সময়মতাে কোথাও পেছােতে হবে-এই বােধটাই নেই। 

তােতন উঠে পড়ে বলল, পাগল নাকি? বাসেও তাে দিব্যি পাঁচজনের সঙ্গে এলাম, রিজার্ভ করতে হয়নি তাে! তাহলে ভটভটিই বা রিজার্ভ করতে হবে কেন? চল, চল । ঘাটের নাবাল থেকে উঠে দূর থেকে বালু চেচিয়ে হাত নেড়ে জানাল, কী যেন পাওয়া যায়নি। 

এদের কথা শুনে চললে আরও বিপাকে পড়তে হবে, তােতন তাই রতনের দিকে দৃকপাত না করে ঘাটের দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগল। 

আরশাদ মিঞার ঘাটে বন্দোবস্ত ভাল। ভাঁটিতে জল নেমে গেলেও কাদা মাড়াতে হয় না। বড় বড় কংক্রিটের চাঁই পাতা ইছে। ভােতন নিজেই পারত, তবু দুই মূর্তিমান দুদিকে কাদায় নেমে তার হাত ধরে কেবল দু’দিক থেকে। তাদের হাওয়াই চটি এক হাতে ধরা। 

ভটভটি ঘন ঘন আসে যায় । শেষ কংক্রিটের ওপর পাচ মিনিট দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই এসে গেল একটা। আধঘন্টা আগে হলে সেই মেয়েটার সঙ্গে একই ভটভটিতে যেতে পারত হয়তাে। দুই আহাম্মক তাে আর সেটা জানে না। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

কেই কোথাও ছিল না, কিন্তু ভটভটি তিড়তেই যেন হাওয়া বাতাস থেকে সাত আটটা মানুষ উড়ে এল এবং চটপট উঠে পড়ল নৌকায় । তােতনকে উঠার সুযােগই দিল না দুজনে, চ্যাংদোলা কার তুলে ফেলল। তারপরই লােকজনকে খামােখা ধমক চমক ‘সরে যান সরে যান, দদাকে বসতে দিন।”ওদের বাধা দিলে গণ্ডগোল আরও পাকিয়ে তুলবে ভয়ে তােতন কিছু বলল না। দুইয়ের নিচে বাবু হয়ে বসে একদিকে চেয়ে রইল। 

দিশ নৌকোয় পাম্পসেট গিয়ে এই যে বিচিত্র চালান তৈরি হয়েছে দেশে-বিদেশে এরকমটি নো যাবে বলে মনে হল না তােতনের। পাম্পসেট বিকট শব্দে প্রচুর ডিজেল পুড়িয়ে এবং ধোয়া উ: নৌকোয় যে গতি সঞ্চার করে তা স্টিমার যা স্পীডবােটের তুলনায় গরু গড়ি। শুধু কষ্ট করে 

বৈঠে মারতে হয় না এই যা। শব্দে মাথা ধরে গেল এবং নদীর ধারের প্রকৃতি ফের মার । তােতনের চোখে। ভাল করে দেখল না কিছু । এখন তার খিদে পেয়েছে, ঘাম হচ্ছে, সামনে নৌনে পাচায় দাড়ানাে কিছু বেকুব লােক হাওয়া চলাচলের পথ বন্ধ করেছে। তবু খুব একটা রেগে যাচে তােতন, যতটা নাগা উচিত ততটা খারাপও লাগছে না। সে কি শর্মিষ্ঠার জন্য

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *