সুনয়নীর বুকখানা ভরে উঠল মায়ায়। তার দিকে চেয়েই জ্যোৎস্না বললেন, আপনিও ভিষণ সুন্দরী, কিন্তু মেয়ে বুঝি আপনাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
এই বলে খুশিতে ফেটে-পড়া চোখে নিজের মেয়েদের দিকে তাকালেন জ্যোত্সা। | কোনও সুন্দরী আছে যাকে দেখলে বুকে জ্বলুনি হয়। কোনও সুন্দরীকে দেখলে রাগ হতে থাকে। কোনও সুন্দরীকে দেখলে আদর করতে ইচ্ছে যায়। এরকম নানারকম প্রক্রিয়া আছে মেয়েদের। যশােধারাকে দেখে মিষ্টি আর বান্টির একটু অন্যরকম হল। বান্টি ফিসফিস করে মিষ্টিকে বলল, এ যেন আমাদের বাড়িতে ঠিক মানাবে না। কোটিপতির ঘরে হলে মানাতাে।
আহা, থাকবে তাে আমেরিকায় বাবা, বেমানান হবে কেন? দারুন, না? উঃ,কতটা লম্বা দেখছিস! পাঁচ তিন হবে। রং কী! | জ্যোত্সা সবই শুনতে পেলেন। খুশিতে ডগমগ করছে তার বুক। তােতনের দিকে তাকিয়ে ফের ভাবী বেয়ানের দিকে চেয়ে বললেন, এই তাে আমার স্যালাক্ষ্যাপা ছেলে। বড় উদাসীন। তবে ছাত্র খুব ভাল ছিল। মাসে ছয় হাজার ডলার মাইনে পায়। যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে তবে বেিয়র দিন দিখতে পারেন। আমাদের খুব পছন্দ হয়ে গেছে।
বান্টি চাপা স্বরে বলে, একটু দেমাক আছে কিন্তু।
মিষ্টি বলে, থাকতেই পারে বাবা, অমন রুপ হলে হলে আমারও মাটিতে পা পড়ত না। নাকটা আর একটু টিকালো হলে
যাঃ । নাকটাই তাে সুন্দর। কী পাতলা! অনেক চুল রে!
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
ভগবান একেবারে ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু একদম সাজতে জানে না দেখেছিস! কী একখানা ম্যাড়ম্যাড়ে শাড়ি পরেছে!
ইচ্ছে করেই সাজেনি বােধহয়। পাছে আমাদের মাথা আরও ঘুরে যায়! কপালটা কিন্তু একটু উঁচু ।
কিছু বেমানান লাগছে না। রংটা একটু বেশী সাদাটে।
মেমসাহেবদের দেশে মানিয়ে যাবে।
নােটন বুঝতে পারছে না তার ভূমিকাটা কী হবে। বাবা চারিদিকে লক্ষ রাখতে বলেছেন। কিন্তু লক্ষ করেও সে কিছু ধরতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারছে, পাত্রী দারুণ রকমের সুন্দরী এবং এরা একটু গজর ও কম কথার মানুষ। | নােটনের ভূমিকাটা বড্ড গৌণ হয়ে যাচ্ছে। কেউ কোনও কথা বলছে না তার সঙ্গে। তাকাচ্ছেও
কেউ। আর নােটন নিজেও কিছু বুঝে বা আঁচ করে উঠতে পারছে না। তাই সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল, মেয়ে কি গান মানে?
জানাথ মৃদু হেসে বললেন, ওকেই জিজ্ঞেস করুন না । মােটনের ভারী লা করল। বলল, না না, ঠিক আছে। দেখে মনে হয় জানে। সবাই সামান্য হ’ল। এমন কি যশােধরাও। দেখে নাকি বােঝা যায় যে গান জানে ।।
সুনয়নী বললেন, জানে। তবে গানের পিছনে বেশী সময় দিতে পারেনি। বরাবর পড়াশুনার ষােক, বীন্দ্রসীত ভালই পাবে ।
কে অবশ্য গান শুনতে চাই না। এনাথ নােটন দিকে চেয়ে বলে আপনি তাে শুনেছি খুব পরােপকার করেন।
নােটন, লাল হল, না, না।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
জ্যোৎস্না তার পাগল ছেলেটির দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, খেলা আর পরের কাজ নিয়েই আছে। দুনিয়ার আর কিছুই চায় না ও। এই ছেলের জন্য চিন্তা করে করেই হয়তাে আমার আয়ুক্ষয় হবে। আজ সকালেই তাে বস্তির লোকের মড়া পুড়িয়ে এল। আবার তার নাতিটিকেও যারে এনে তুলেছে। আমার যে কী জ্বালাতন!
নােটনের দিকে এখন সকলের চোখ। নােটন একটু হাঁসফাস করে বলে, উপকার–টুপকার নয়। আসলে ওইসব লােকের জন্য একবার কিছু করলেই ওরা এমন পেয়ে বসে।
জোত্মা বললেন, আগে পলিটিকসও করত। মার খেয়েছে, জেলে গেছে। শেষে বকে বকে হাড়িয়েছি। আমার বড় ছেলেই যা একটু প্র্যাকটিক্যাল, এরা দুজন নয়। ছােটোটি আরও। আমেরিকায় গিয়ে তিন মাস ছিলুম ওর কাছে। কী অগােছালাে থাকে বলার নয়।
কথার মাঝখানে হঠাৎ বান্টি বলল, আচ্ছা আমরা কিন্তু এখনও যশােধরার গলার স্বরটাও শুনিনি। তুমি কিছু বলবে না আমাদের?
যশােধরা খুব নিবিষ্ট চোখে নােটনের দিকে চেয়ে ছিল। লম্বা, ফর্সা, মজবুত গড়নের এই মানুষটিকে এই প্রথম লক্ষ করেই তার ভাল লেগে গেল। যারা পরােপকার করে তাদের এমনিতেই ভীষণ পছন্দ যশােধরার। সে নিজেও কতবার মাদার টেরিজার সেবাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চেয়েছে। মা দেয়নি। সেবার কাজ বড্ড ভাল কাজ। বান্টির কথায় তটস্থ হয়ে চোখ নামাল যশোধরা, মৃদু স্বরে বলল, কী বলব?
বাঃ,সুন্দর তাের গলার স্বরটি ।
সুনয়নী মেয়েকে আর বেশীক্ষণ এখানে বসিয়ে রাখতে সাহস পাচ্ছিলেন না। যা মেয়ে কিছু একটা আলটপকা বলে ফেলবে হয়তাে। তাই তিনি খুব সংকোচের সঙ্গে বললেন, ওকে আপনাদের কি জিজ্ঞেস করার নেই তাে!
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
জ্যোৎস্না প্রায় ধরা গলায় বলেন, না না। ওকে আবার কী জিজ্ঞেস করব? যাচাই করার কিছু নেই।
তাহলে ওকে ভিতরে নিয়ে যাই? হা হা। নিশ্চয়ই । আমাদের দেখা হয়ে গেছে।
অভয়নাথ পাত্রটিকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। আর সেটা তােতনও টের পাচ্ছে । অভয়নাথ পৌরুষের পক্ষপাতী। তিনি ডাকাবুকো পােক পছন্দ করেন। মান্দামারা পুরুষ তার ঘাের অপছন্দ। এ ছােকরাকে সে হিসেবে তাঁর পছন্দ হল না বটে, কিন্তু এর একটা বাড়তি ব্যাপার আছে। হোক একটু সত্যিকারের উদাসীন ভাবুক টাইপের। সম্ভাবত লােভটো কম এবং টাকাপয়সার প্রতি তেমন টান নেই । এগুলাে তার নিজেস্ব পদ্ধতির ভিডাকশন। সত্যি নাও হতে পারে। ছয় হাজার ডলার অনেক টাকা। কিন্তু এধরনের ছেলেরা তাড়াতাড়ি উন্নতি করতে পারে না। ড্যাশিং পুশিং নয় বলে। নইলে আরও বেশী মাইনে হত।
ভিতরের ঘরে আসতেই জেঠিমা জড়িয়ে ধরলেন যশােধরাকে । সুনয়নীর দিকে চেয়ে বললেন, বলিনি, ওর আবার সাজে দরকার হয় নাকি? এই সাজেই তাে সবাইকে ট্যারা করে দিয়ে এল।