হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-২৬)

যশােধরা মিটমিট করে একটু হেসে বলে, পাত্রটিকে দেখেছাে? দেখিনি আবার! বেশ ছেলে। শান্ত সুস্থির একটু কবি-কৰি ভাৰ আছে । যশােধরা নিতাজ গলায় বলে,যাই বলাে বাপু আমার কিন্তু বেশী পছন্দ ওর দাদাটিকে। সুনয়নী আর সুচেতা প্রায় একসঙ্গে আর্তনাদ করলেন অাঁ।হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় 

যশােধরা খিলখিল করে হেসে ওঠে। ইতি মিতি দুজনেই হাঁ করে চেয়ে ছিল যশােধরার দিকে । ইতি , সাঃ, ও তাে বয় বেশী । 

অহা, পৰ মানে কি আর বিয়ে করতে যাবাে নাকি? লােকটা বেশ মজার আর পরেকারী সে মার খুব শব্দ । এত সকালেই মড়া পুড়িয়ে এসেছে শুনে আমি খুব ইমপ্রেস। 

সুনয়নী একটা দুশ্চিন্তার শ্বাস ছেড়ে বললেন, পারিসও তুই লােককে চমকে দিতে। লােকটা কি খারপ মা? খারাপ ভালই আমি কী জানি । ওর দিকে ভাল করে তাকাইনি তাে? শুধু পাত্রটিকে দেখেছিলে? দেখব না? বেশ ছেলে। আমার তাে ভালই লাগল। 

সুচেতা বললেন, মুখখানা মায়ায় ভরা। আর কিছু না হােক, মনে দয়ামায়া আছে বলেই মনে হয় বাপু। আর পাত্রের মা তাে দেখলুম যশাের জন্য কোল পেতে আছেন। 

সুনয়নী বললেন, হ্যাঁ দিদি, মহিলা বেশ ভাল মানুষ। দজ্জাল ধরনের নয় মােটেই। যশােধরা মুচকি হেসে বলে, তাহলে তােমাদের পছন্দ বলাে! 

সুচেতা বললেন, পছন্দ হলেই তাে হল না। লাখ কথার আগে বিয়ে হয়না। এখনও কত কী। দেখার আছে! জানার আছে।

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

পাত্রপক্ষ বিদায় নেওয়ার আগে সুনয়নীকে আর একবার যেতে হল হলঘরে । জ্যোৎস্নার চোখে টলটল করছে জল। হাত দুটি ধরে বললেন, আমরা লােক খারাপ নই বেয়ান আমাদের কোনও দাবীদাওয়াও নেই। শ্বশুরবাড়ির বংশেই কেই কখনও পণ নেয়নি। যদি মেয়েটাকে ভিক্ষে দেন তবে বড় শান্তি পাবাে। একটু দেখেই এমন মায়া পড়ে গেল। 

ওরকমভাবে বলবেন না। ঠাকুরের যা ইচ্ছে তাই হবে। আপনাদের যে মেয়ে পছন্দ হয়েছে এতেই আমরা খুশি। 

পাত্রকে আর একবার লক্ষ করলেন সুনয়নী। সুচেতা ঠিকই বলেছেন, এ নরম মনের মানুষ। চোখ দুটো টানা টানা আর লাজুক-লাজুক । 

পাত্রপক্ষ বিদায় নেওয়ার পর জয়নাথ আর অভয়নাথ আলােচনায় বসলেন । কেমন দেখলে দাদা? 

অভয়নাথ গল্পীর হয়ে বললেন, এক বক্ষ মত দিই কি করে ? কতটুক আর দেখলাম? তবে পাত্র খারাপ নয় বলেই মনে হয়। আরও খােজ খবর-খবর নেওয়ার পর গােটা পিকসার পাওয়া যাবে । 

সে তাে ঠিকই। নাথিং ইজ সেটেল ইয়েট। অবনীবাবুর পরিবারও ভাল। এখনও দেখা যাক। 

মারাত্মক ফোনটা এল অনক রাতে। প্রায় সাড়ে দশটা নাগাত হিউস্টন থেকে অলকের গলা পাওয়া গেল, কে বলছো, বড় মামা? 

হ্যাঁ হ্যাঁ, তারপর খবর বল। খবর ভাল নয়। কল ইট অফ। তার মানে? এখানে বিয়ে দেওয়া চলবে না। কেন যে, কিসের পপােস? 

বেশী ডিটেলসে যাচ্ছি না। ওর সব বন্ধুর বউয়ের সঙ্গে একটা ফ্যাভাল আছে । বেশ স্ট্রং ম্যাডাল। 

বলিস কি? সর্বনাশ। 

নিউ জার্সির বাঙালী মহলে সবাই জানে। ইন ফ্যাক্ট ওই ক্যাভালের জন্য বন্ধুর বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। শােনা যাকের বউকেই তােতন বিয়ে করবে। অল গেট সেট অ্যান্ড গাে। 

তা হলে মেয়ে দের নে? | কি করে বলব? তাছাড়া বন্ধুপত্নীটি এখন কলকাতাতেই আছেন। ডিভাের্স এখনও হয়নি তবে যে কোনও সময় হয়ে যাবে। কল ইট অফ বড়মামা। 

আরে সে আর বলতে। তুই দুদিন আগে জানালে আমি বাড়িতে আসতেই ওদের বারণ করতাম। আমি হিউস্টনে থাকি বড় মামা। দূরের পারা। 

বুঝেছি। আমি এক্ষুণি ফোন করে পাত্রণকে মানিয়ে দিচ্ছি যে, আমরা আর এগােতে রাজি নই। 

ঠিক আছে বড়মামা। তােমরা ভাল আছাে তো! ছাডছি । 

অভয়নাথকে ঘিরে বাড়ির লােকেরা অপেক্ষা করছিল। জয়নাথ, সুনয়নী, সুচেতা। প্রত্যকের মুখই থমথমে। খবর যে খারপ তা সবাই বুঝতে পারছে। 

উত্তেজিত অভয়নাথ ফোন রেখেই ভাইয়ের দিকে ফিরে বললেন, বলেছি না অলকের খবর আসার আগে মেয়ে দেখানােটা ঠিক হয়নি! আমি এখনই অববাবুকে ফোন করছি 

জয়নাথ দাদার হাত চেপে ধরে বললেন, দাঁড়াও দাদা। রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। এই আনালি আওয়ারে এসব না করাই ভাল। কাল সকালে টাইফুলি জানিয়ে দিলেই হবে। 

কী বলবি?। সেটা ভেবে ঠিক করা যাবে। এবার অলক কী বলল বলাে। অভয়নাথ বললেন । থমথমে মুখ করে সবাই বসে রইল। 

আড়াল থেকে যশােধরাও শুনল। ধীর পায়ে হেঁটে সে বারান্দায় এসে অন্ধকার গঙ্গার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নিজের ঘরে এসে বাতি নিবিয়ে বিছানায় শুয়ে রইল উপুড় হয়ে। 

তার সঙ্গে পাত্রপক্ষের কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ভাল করে চেনা জানা কথাবার্তাও হয়নি। মাত্র মিনিট দশেক সে ওদের সামনে গিয়ে বসেছিল । তবু এক অনির্দেশ অস্পষ্ট কারণে হঠাৎ এখন তার চোখে জল এল। সহজে কান্নার মেয়ে সে নয়। তবু এখন ভারী ছেলেমানুষের মতাে সে ফুলে তুলে কাঁদল ছক্ষণ। 

তারপর চোখের জল না মুছেই ঘুমিয়ে পড়ল কথন ।। 

সকালবেলাতেই জয়নাথ অবনীবাবুকে টেলিভেনে জানিয়ে দিলেন, এ বিয়ে হচ্ছে না। অসুবিধে আছে।

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় 

ঠিক দুদিন বাদে ইউনিভার্সিটির ফটকের কাছাকাছি যশােধরার পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে একজন লােক বলল, আমাকে কি চিনতে পারছেন? 

যশােধরা বিরক্তির সঙ্গে ঘাড় বেঁকিয়ে ভ্ৰ কুঁচকে লােকটার দিকে তাকিয়ে বলল, না- ওঃ হ্যা কী ব্যাপার বলুন তাে! 

আমি তােতন । আপনাকে দু-একটা কথা বলতে চাই। কথা ! আর কথা কিসের বলুন তাে! আর আমিও শুনতে চাইছি না। | মখটা খুবই ম্লান হয়ে গেল তােতনের । একট ইতস্তত করে বলল, আপনার কেন প্রস্তাবটা প্রত্যাখান করলেন তা আমি জানি। কিন্তু, বিয়ে না হােক, একটা ব্যাপার যদি একটু স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে পারতাম। 

বুব সতেজ গলার যশােধরা বলে তার কোনাে দরকারই নেই। 

এনে ঠেটি জিব দিয়ে ভেজানাের একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে তােতন হঠাৎ ওপর নিচে মাথা নেড়ে বলে, সত্যিই তাে। সত্যিই আপনার শােনার কোনও প্রয়ােজনই নেই। আসলে আমার মাথাটারও ঠিক নেই কি না। কোথায় যাবাে, কার কাছে কী বলবাে এসই এখন গােলমাল হয়ে গেচ্ছে। 

যশােধরা বলল, সেটাও আপনার ব্যাপার। আমি কনসার্নড় নই। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *