হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-২৯)

শর্মিষ্ঠা নিঃশব্দে উঠে গিয়ে একটা লম্বা খাম এনে সামনে টেবিলে ফেলে দিয়ে বলল, চিঠিটা পড়ল।হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

কাঁপা হাতে চিঠিটা নিয়ে তােত চোখ বুজল । অনেকই শর্মিষ্ঠা আর পরাগের ছাড়াছাড়ির জন্য তাকেই দায়ী করে। এখন কি পরাগের মৃত্যুর পরােক্ষকারণও সেই হয়ে দাঁড়াল? 

ভয় নেই, পরাগ মরেনি । খামের মধ্যে নিউইয়র্ক টাইমস্ আর একটা লােকাল কাগজের কাটিং আছে। পড়ে দেখুন। 

তােতন কাটিংগুলো বের করল। দেখল। তারপর ধীরে ধীরে দীর্ঘ চিঠিটা শেষ করল। 

কী মনে হচ্ছে তােতন? পরাগ তাে ঠিক এরকম নয়। টায়িং টু বি এ হিরাে । তাই না? 

তােতন মাথা নাড়ে, না। তা নয় শর্মিষ্ঠা। পরাগ বড় ফাঁকা হয়ে গেছে । বড় শূন্য, একা, নিঃসঙ্গ । খানিকটা গরিবও। আমি দেখে এসছি ওর সঙ্গে কেউ আজকাল যেতে। 

এসছি ওর সঙ্গে কেউ আজকাল মেশে না। টোটাল ফ্রাশেম। পরাগ কার জন্য হীরাে হবে

ইজ ইট এ কামব্যাক? 

ওখানে না গেলে বােঝা যাবে না। 

শর্মিষ্ঠা দু’হাতে মুখ চাপা দিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর তােতন নির্ভূল বুঝতে পারল, হাতের আড়ালে শর্মিষ্ঠা কাঁদছে। | তােতন আর একবার চিঠিটা পড়ল । পরাগ দড়ি ধছে। পরাগচ্যানেল ফোর-এ একটা দারুণ ইন্টারভিউ দিয়েছে। পরাগকে সামনের পূজোয় সংবর্ধনা দেবে বাঙালী ক্লাব। মাত্র দু’ মাসের মধ্যে 

এত কিছু ঘটে গেল কি ভাবে? 

আপনি কাঁদছেন কেন শর্মিষ্ঠা?। শর্মিষ্ঠা জবাব দিল না। হাতের চাপা সরাল না মুখ থেকে। 

ভােতন বলল, খবরটা আমার কাছে খুব খারাপ খবর নয়। সেন্ট্রাল পার্কে হারলেমের গুদের হাতে খুন হওয়াটাই স্বাভাবিক ঘটনা। পরাগ যে বেচে গেছে তা বরাতজেরে | আই অ্যাম হ্যাপী। 

অনেকক্ষণ বাদে শর্মিষ্ঠা মুখ থেকে হাত সােল। চোখ মুছল। তারপর বলল, সনি, পরাগের ওপর ভীষণ দুর্বলতা আপনার। 

 তােতন মৃদু স্বরে বলল, আমার দু-তিন বছর আগে ও আমেরিকায় যায়। 

আমার যাওয়ার ব্যাপারে পরাগ অনেক সাহায্য করেছিল । আমি প্রথম উঠেছিলাম ওর কাছেই। তধন ও ছােট্ট একটা ফ্ল্যাটে থাকত। মাও মাসী আমাকে খুব যত্ন-আত্তি করতেন । ভালও বাসতেন 

শুধু আমার জন্যই আপনাদের সম্পর্কটা বিধ হয়ে গেল। আপনার জন্য হবে কেন? টনর সব দায় তো আপনার নয় । 

শুনুন আমি আর দেরী করতে চাই না। পরাগ খুব বেশী হিরাে হয়ে ওঠার আগেই আমি ওর সামনে হাজির হতে চাই। আপনি কবে যাবেন? 

আপনি যদি বলেন তাে কাই যেতে পারি। কিন্তু ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? সেটাই তাে বােঝাতে পারছি না। আমি যে তীষণ অস্থির। কেন অস্থির শর্মিষ্ঠা? এই ঘটনায় অস্থির হওয়ার স্ত্রী আছে? পরাগ যে নষ্ট ইমেজ আবার রিকভার করছে । ওকে এখনই ভেঙে ফেলা দরকার তােতন। ছিঃ শর্মিষ্ঠা। আপনাকে এরকম দেখতে আর ভাল লাগেনা। 

শর্মিষ্ঠা হঠাৎ উঠে কাছে এল। দু চোখে দর করে জল বেয়ে পড়ছে। ভেসে যাচ্ছে মুখমন্ডল। তােতনের পাশে বসে হাঁফধরা গলায় বলল, এখনই তােতন। এখনই। ওকে শেষ করে দিতে হলে এখনই। নইলে বড় দেরী হয়ে যাবে। 

এরকম অস্থির চঞ্চল অস্বাভাবিক কখনও দেখেনি শর্মিষ্ঠাকে তােতন। এমনকি যখন পরাণের হাত মার খেয়ে পালিয়ে এসেছিল তখনও নয়। সে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কেন শর্মিষ্ঠা, এই কেন? 

আপনি বুঝবেন না, কিছুতেই বুঝবেন না কেন আপনি যে কেন এত ভাল মানুষ’ 

তার মানে কি বােকা? শর্মিষ্ঠা ফের ফুলে কাঁদছে। 

হঠাৎ তােতনের মাথায় একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে যা দেখেছে এবং দেখে যা ভেবে নিচ্ছে তা হয়তাে সম্পূর্ণ ভুল। তা হয়তাে এক মারাত্মক অপব্যাখ্যা। শর্মিষ্ঠার এইসব প্রতিক্রিয়া আসলে কিসের? কেন? এ সবই কি শুধুই ঘৃণা, আক্রোশ, প্রতিশােধস্পৃহা? আর কিছু নয়? আর কোনও গভীর অর্থ নেই? 

তােতন খুব নিবন্ত গলায় বলে, আপনি কবে যেতে চান শর্মিষ্ঠা? কালকেই যদি সীট পাওয়া যায় । আমি যদি আর কদিন পরে যাই, একা যেতে কি আপনার অসুবিধা হবে? 

সবেগে মাথা নেড়ে শর্মিষ্ঠা বলে, না না, একা যেতে কোনও অসুবিধা নেই। আমাকে যেতেই হবে। 

তােতন ম্লান হেসে বলে, গিয়েই ডিভাের্সের মামলা করবেন তাে? করব তােতন। আরও অনেক কিছু করব । আমাকে যাওয়ার ব্যাপারে একটু সাহায্য করবেন না? করব শর্মিষ্ঠা। তবে কালকেই যে প্লেনের সীট পাওয়া যাবে এমন নয় । যত তাড়াতাড়ি হয় । আমি গােছগাছ সেরে ফেলেছি। 

তােতন ওপর-নিচে মাথা নাড়ল। তারপর ক্রন্দনরতা শর্মিষ্ঠাকে একা তার কান্না কাঁদতে দিয়ে চলে এল তােতন । 

যা রােজ বিয়ের জন্য ঘ্যানঘ্যান করছে আজকাল। রােজ । পরদিন সকালে সে কে আছে মা। যা চাও তাই হবে । 

জ্যোৎস্না যেন আলাে হয়ে উঠে বললেন, করবি বিয়ে? করব। আমরা পছন্দ করে দেখে দেবাে চিন্তা করিস না। তােমরা যাকে গলায় ঝুলিয়ে দেবে তাকেই মেনে নেব মা । ওমা, তুই দেখবি না?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *