হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-৩০)

না মা, মেয়েদের দেখে কিছুই বুঝতে পারি না আমি। আমার একদম বুদ্ধি নেই। আমি বড্ড বােকা না। 

বােকাই তাে। কত লেখা পড়া শিখলি, বিদেশে গেলি, এখনও কি বুদ্ধি পেকেছে তাের! যাক বাবা, আমি কিন্তু ছাড়ছি না তােকে | একেবারে বিয়ে করে যাবি। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়আ চাকরি? চাকরি ছাড়তে হয় ছাড়বি। তাের অত বিদ্যে, ঠিক ফের চাকরি পাবি। কথা দে । তােতন সামান্য গম্ভীর হয়ে বলে, পরের বার হলে হবে না? 

এবারই। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিতে একমিনিট তাবল তােতন। 

তারপর বলল, দিলাম । তবে কিছুতেই আর এক মাসের বেশী ছুটি এক্সটেন্ট করা যাবে না। কিন্তু। 

তাই হবে বাবা। এদেশে কি পাত্রের অভাব। 

এসব মার দিন দশেক আগের কথা। কিন্তু মনে হচ্ছে কত দিন কেটে গেছে। যেন পূর্ব জন্মে ঘটেছিল এসব। দুদিনের মাথায় দিল্লি থেকে এয়ার ইন্ডিয়ান ফ্লাইটে জায়গা গেল শর্মিষ্ঠা। তাকে কলকাতার এয়ারপাের্টে বিয়ি জানাতে গিয়েছিল তােতন। পরাগকে শেষ করতে যাচ্ছে শর্মিষ্ঠা কিন্তু তেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে না মােটেই। বরং আমেরিকায় কেনেভি এয়ারপাের্টে প্রথম যেদিন দেখেছিল তােতন সেরকমই করুণ আর নার্ভাস দেখাচ্ছে। 

তােতন বলল, গিয়ে কোথায় উঠছেন? 

অনন্যা বউদির কাছে । দাদা ট্রাংক কল-এ খবর দিয়েছে। ওরা এয়ারপাের্ট থেকে নিয়ে যাবে । আপনি কবে আসছেন তােতন? 

একটু দেরী হতে পারে। বাড়ি পেকে ছাড়ছে না। 

আমি খুব অপেক্ষা করব কিন্তু।

আপনাকে একটু নার্তাল দেখচ্ছে। তাই বুঝি ! কিন্তু আপনাকে অমন শুকনাে দেখাচ্ছে কেন? কিছু বুঝতে পারছি না। বােধ হয় আপনি চলে যাচ্ছেন বলে। 

আহা, সে আর কতদিনের জন্য? আপনি তাে আসছেনই। হা। আমি তাে আসবেই । কিন্তু– কিন্তু কি বলুন তাে! কিছু বুঝতে পারি না কেন আজকাল! শর্মিষ্ঠা হাসল, আপনি যা ভাবুক । সবাই তাই বলে। আমার মাথায় কেবল আজে বাজে ভাবনা। কাজের ভাবনা আসে না। 

তা জানি। কেজো লােককে সবাই পছন্দ করে বলে ভাবেন নাকি? ভাবুকদেরও ফ্যান আচে । ভাবুক পানাই কাউকে কাউকে মানায়। 

শর্মিষ্ঠা চলে গেল। কলকাতায় আর একটা ছােট্ট শূণ্যতার সৃষ্টি হল। 

দশদিনে কত কী হয়ে গেল! তােতন বিকেলে শুয়ে আছে বিছানায়, রক্তে ভেস গেছে চাদর। মাথায়, পিঠে, হাঁটুতে, উরুতে প্রবল যন্ত্রণা। বাঁ হাত নাড়াতে পারছে না সে। বিছানার পাশে মুখ চুন করে শুধু বসে আছে রতন। বাড়িতে আর কেউ নেই। নাসিং হােম-এ যায়ের অবস্থা ভাল নয়। মাথায় গুরুতর চোট । কতখানি গুরুতর তা জানার জন্য কাল স্কানিং হবে! আজও ঘন ঘন মূৰ্ছ হচ্ছে। 

সবই আনার জন্য রতন, সবই আমার জন্য । দাদা, আপনি শান্ত হােন। ওরকম ছটফট করলে আরও রক্ত যাবে । তুমি কি জানাে রতন যে, আমি আমার বন্ধুর জীবন নষ্ট করেছি। আমার মা শ্রাজা 

ভােতনের চোখের জল, মাথার রক্ত, মুখের লালা সব একাকার হয়ে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে হাঁ ধরে যাচ্ছে তার । দম বন্ধ হয়ে আসছে। শরীরের যন্ত্রনা সে অনুভব করছেই না। তার বুকের যন্ত্রণা হাজারাে গুণ। 

ডাক্তার আসছে দাদা। আপনি ওরকম করবেন না। তুমি জানাে না রতন। তুমি জানাে না এ পরিবারকে কতখানি অপমান সইতে হল আমার জন্য । সব জানি দাদা । বড় ঘরের ব্যাপার হলেও বুঝি। বালিশে মুখ চেপে তেতন শিশুর মতাে কাঁদতে লাগল। 

তােভন না, অনেক রক্ত চলে যাচ্ছে আপনার। এত ছটফট করবেন না। উন কত কি । আমরা কিভাবে বেঁচে আছি বলুন তাে লাথি-ঝাটা খেয়ে? অস্থির হয়ে  িকরা যায় দুনিয়ায় বলুন? দুর্দশায় পড়লে বিপদ হলে আমি কি করি জানেন? ভাবতে থাকি আমার চেয়েও কারাপ অবস্থায় কত লােক তাে দুনিয়ায় বেঁচে আছে। কত তিখিরি, কাঙাল, কুষ্ঠরােগী, কত ক্যানসর-হওয়া মানুষ, কত হ্যবাগােবা কানা খোঁড়া। ওইসব ভাবতে ভাবতে আবার জোর পেয়ে যাই। মনের জোরটাই আসল কথা। যা হওয়ার হােক না । 

তােতন মাথা নেড়ে বলে, আমার এক রত্তি মনের জোর নেই রতন। জোড় করলেই জোড় হয়। দাঁড়ান, কলিং বেল বাজল বােধ হয়। ভাক্তার এল কিনা দেখে আসি । 

ডাক্তার এল । পরিবারের পুরােনাে ডাক্তা, প্রতিবেশী। প্রবীণ লোক। এ কী করেছিস রে? অ্যাকসিডেন্ট নাকি? 

তোতন হাঁফধরা গলায় বলে, হা ডাক্তারকাকা। 

দেখি দেখি দাঁড়! এ তাে দেখছি বেশ সিরিয়াস চোট। মাল্টিপল ইনজুরি। মাথাটা দেখি তাে! সর্বনাশ! মাথা তাে কাটিয়ে এসেছিল! 

তােতন চোখ বুজে রইল । তার কাটা- হেঁড়া-ভাঙা শরীরের ওপর কী হতে লাগল তা নিয়ে সে মাথা ঘশল না। শরীর যে কিছুই নয় সেটা সে আজ খুব বুঝতে পারছে ! মনে এত জ্বালা যে শরীরকে ভুলেই গেছে সে। | সম্ভবত ঘুমের ইজেকশনই ঠেলে দিলেন ডাক্তারবাবু । দিতে দিতে বললেন, ইনজুরিটা ভাল 

বুঝছি না। দরকার হলে কাল এক্সরে করাতে হবে । 

তােতন টের পেল, ডাক্তারবাবু চলে গেলেন । তার শরীরে ক্লান্তি নেমে আসছে । 

রতন 

হয়ে যায় তাহলে কি হবে? 

বলুন। ডাক্তার কি আমাকে ঘুমের ওষুধ দিল? ঠিক জানি না। ইকজেকশন তাে দিল দেখলাম। শােনাে, আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি আর আমার মায়ের যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে কি হবে? কিছু হবে না। আপনি ঘুমােন। 

ওরা কেউ ফেরেনি? 

না। বাড়িতে কেউ নেই। শুধু নােটাদা যে বাচ্চাটাকে এনেছে সে রান্নাঘরের সামনে চট পেতে ঘুমােচ্ছে। 

তুমি ফোন করতে জানাে? বাঃ জানব না? অফিস থেকে কত করি। নার্সিং হােমএ ফোন করে খবর নেবে একবার? আমি তাে সেখান থেকেই এলুম একটু আগে । তবু একবার খবর নিও।। নােবাে। বাড়ির লােকেরাও এবার ফিরবে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *