হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-৩২)

দ্বিধাগ্রস্ত একখানা হাত বাড়াল পরাগ। সন্তর্পণে স্থাপন করল শর্মিষ্ঠার কাধে, খুব চমকে দিয়েছে আমাকে। 

কেন চমকাবাে না? কেন তু শেষ হতে হতে ফের বেঁচে উঠলে? কেন উঠলে? আমি যে অন্য প্লন করে রেখেছি, কেন ভেস্তে দিলে? 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়কিসের প্লান শর্মিষ্ঠা? শেষ করে দেবাে তারপর এসে ঠিক বাঁচিয়ে নেবাে কেন তা হতে দিলে না? ভাষাকে শেষ করারাও কিছু নেই । বঁছানােরও কিছু নেই। আমি সব কিছুর জন্যই প্রস্তুত। কেন প্রস্তুত? তুমি খারাপ, তুমি ভীষণ খারাপ। 

পরাগ সঙ্গে মাথা নেড়ে সমর্থন করে বরে, শ্রামি তা জানি। আমি সত্যই খারাপ। কেন যে ধাপ তা বুঝতে পারি না । 

কেন ভাল লােক হলে ন কপাল শর্মিষ্ঠা। আমার ভাইটা যদি অ্যাক্সিডেন্টে মারা না যেত তাহলে-তাহলে হয়তাে তােমার রুনাল দাও । শুনছাে! তােমার রুমাল! দিই। এই যে কেন বাড়ি যাবাে বলে না? 

জানি না। কেন বাড়ি যায় লােক? কি আছে বাড়িতে? আমার তাে মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছেও রে । 

, ওটা কথা নয় । আমি কেন বাড়ি যাবাে বলাে। তােমার ইচ্ছে হয় না? ওটা জবাব হল না। আমি কেন তােমার বাড়ি যাবাে? বাড়ি কি আমার? তবে কার? বলাে। পরাগ এবার একটু হাসে। তারপর ঘড়ি দেখে। ঘড়ি দেখলে কেন? এমনিই। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

বলাে, কেন ঘড়ি দেখলে? সূর্যোদয়ের সময়টা মিলিয়ে নিলাম। কার বাড়ি? তােমায় । তাহলে কার বাড়ি কে যাবে? তােমার বাড়িতে তুমি। 

আর তুমি নও? যদি বলাে, তাহলে নিও। চোখ মুহুল শর্মিষ্ঠা মুখ মুছল। সার? এখন আমরা কী করব? 

কী সুন্দর বল দেখছে না! দেখছি । নিউ ইয়কে এসব ছিল না। কী ডাল জায়গাটা। তােমার পছন্দ? ভীষণ। তাহলে চলাে, একটু বেড়াই। 

দীর্ঘ দীর্ঘ গাছ, ঝােপজাড় আর, ভােরের আলাে ছায়ায় দুজন মন্থর পায়ে হাঁটতে লাগল আনেকক্ষণ তারা আর কথা বলল না। চুপচাপ। শুধু পরস্পরকে অনুভব করা। কথা দিয়ে কি সব দূরত্ব অতিক্রম করা যায়? নীরবতাও লাগে। 

কুঠিঘাটের বাড়িতে অলকের টেলিফোন এল অধিক রাতে। বড়মামা নাকি! হা, কী খবরে তাের? ওঃ বড় মা, সামথিং ইজ রং। আবার কী হল? আই ওয়াজ ফেড এ কংককটে স্টোরি । উঃ অত ইংরেজি বলিস না তাে! হয়েছাে কী? ওই যে পরাগ আর শর্মিষ্ঠার ব্যাপারটা কে পরাগ আর শর্মিষ্ঠা? | 

আরে ওই যে তােতনের সঙ্গে যাকে নিয়ে স্ক্যান্ডাল, সেই বই তাে কিরে এসে দিব্যি স্বামীর ঘর করছে। 

আঁ । তাহলে কী খবর দিয়েছিলি তুই? বললাম না, একদম গুজব। যাঃ কিন্তু সে বিয়ে তাে নাকচ হয়ে গেছে । 

তাতে কিছু নয়। যশাের আরও ভাল পাত্র জুটবে । কিন্তু আমি সত্যিই সরি মামা । একটা ভুল বুবর দিয়ে ।। 

ভাল করে খোঁজ নিতে হয়। এতে খুবই ক্ষতি হয়ে গেছে । 

কী ক্ষতি হল? 

আমাদের নয়। ওদের । ভদ্রমহিলা ভীষণ শকড়। আর তােতন-যাকগে এত সব লং ডিসট্যান্স বল যায় না। চিঠি লিখে বরং জানাবাে। ইটস্ এ লং স্টোরি । 

এখন ইংরেজি কে বলছে বড়মামা? 

আমেরিকায় আছে বলে কানটা মলতে পারছি না, তাই না? কিন্তু জমা রইল। দামড়া কোথাকার। তাের জন্য একটা পরিবার একেবারে-কী কাণ্ড বল তাে! ছিঃ ছিঃ। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

আমি কী করব বল । থাকি হিউস্টনে । দূরের পাল্লা। তা বলে-। যশাের বােধহয় এখানে একটু ইচ্ছেও ছিল। তিন মিনিট হয়ে এল মামা। ছাড়ছি ।। ফোন রাখার পর জয়নাথ শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী বলল দাদা? 

অভয়ানাথ সখেদে মাথা নেড়ে বললেন, সে আর জানতে চেও না। তার আগে বলাে, আর ৈ ব্যাড পীপল? 

জয়নাথ মৃদু হেসে বললেন, সেটা আমাদের শত্রুদের জিজ্ঞেস করা ভাল। তুমিই বলাে না। জানি না দাদা। ভাল-মন্দের বিচার তাে সরল নয়। আমরা ওদের রিফিউজ করলেও ফোনে খোঁজ খবর নিয়েছি। উই ওয়্যার সিমপ্যাথেটিক । নিশ্চয়ই। 

আমরা দুঃখিতও হয়েছি। তা তাে বটেই। এখনও যদি কিছু কমপেনসেট করা যায় তাে করবে নাকি? জয়নাথ মৃদু হেসে বললেন, কী করতে চাও না? সেটা ভেবে দেখতে হবে। ডােরে কিছু পাওয়া যাবে কি? 

সেটা ভাবার পর ঠিক হবে । কী বলল অলক? সবই নাকি গুজৰ । জয়নাথ একটা দীর্ঘশ্বর ফেললেন। ছেলেটিকে তার পছন্দই ছিল। 

সেই দিন থেকে আজ অবধি যশােধরা সুস্থির হয়নি। তার বুকের অবাধ্য কাঁপন ভূমিকম্পের মতাে অবিরল কী যেন ভেঙে ফেলছে তার তিতরে। চোখ বুজলেই সে দেখতে পায় উদ্ভ্রান্ত একটি যুবক কলেজ স্ট্রিটের মতো সাতিক বিপজ্জনক এক রাস্তায় কোন অন্ধের মতাে নেমে গেল।যে 

জায়গায় পড়ে গিয়েছিল তােতন সেখানে কালাে রাস্তায় অনেকটা রক্ত ছড়িয়ে ছিল । পরে দেখেছে যশোধরা। 

কী বলার ছিল ওর? 

আজও ঘাের এক আচ্ছন্নতার মধ্যে পড়ে আছে সে রােজ জ্যাঠামণি খবর নিচ্ছেন, অবশ্য নিজের পরিচয় গােপন রেখে। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

যশােধরা আজও বাড়তে তথ্য গােপন করতে শেখেনি । সে বাইরে যা যা ঘটেছে সবই বলে দেয় মা আর জেঠিমাকে । তােতানর খবরও সেই এসে প্রথম দেয় । নিজেও উদভ্রান্তি ছিল যশােধরা । নিজেকে যে বারবার প্রশ্ন করেছে, আমার জন্যই হল না তাে! আমি কি খুব নিষ্ঠুর মেয়ে? 

নিষ্ঠুরই বােধহয়। নইলে তােতরে কথা দুচার মিনিট শুনতে পারত সে। আসলে পরস্ত্রীর সঙ্গে ওর অবৈধ সম্পর্ক আছে জেনে ক্ষোভে দুঃখে এমন গরম হয়ে ছিল যশােধরা যে লােকটাকে দেখেই তার ভিতরে একটা কপাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । একটি পরিবারকে ভেঙে দিয়েছে লােকটা, দুটি মানুষের জীবন নষ্ট করেছে। এ লােকের সঙ্গে বিয়ে হলে যশোধরারই বা ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা কী? 

ওই ঘটনা ঘটবার পর থেকে যশোধরার রাতের ঘুম গেছে, খাওয়ার রুচি গেছে, পড়ার মানােযােগ গেছে। মরেই যেত। কী করে বেঁচে গেল কে জানে। ওইভাবে সাংঘাতিক ভূখম হওয়ার পরও লােকটা উঠে দাঁড়াল রক্তমাখা শরীরে কি এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে নিজেকে টেনে হিচড়ে আবার সমান বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পেরােলাে! কিভাবে সম্ভব? কোন জ্বালায় জ্বলেপুড়ে খাক হচ্ছে তােতন? 

এই তো অলকার খবর এল, তােতনের নামে যা রটন হয়েছে তা রটনাই ঘটনা তেমন কিছু রুতর নয়।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *