তন। আর সি করে ভটভটি ঠেকল ঘাটের চরায় ।। যাত্রীরা জুতাে চটি ব্যাগ পোটলা নিয়ে টপাটপ কেমন কাদায় নেমে পড়তে লাগল। যেন মােজাইক করা বাঁধানাে জায়গা।
এক গাদা লােকের সামনে দুটো চ্যাংড়া ছেলে তাকে দুগামূর্তির মতাে কাঁধে করে নামাবে এটা যে হতে দেওয়া যায় না তা মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিল তােতন। এবং বেকুবের মতে কাদায় গেথে গেল একেবারে । ভারী এটেল কাদা। বেকাদার জিনিস।
বাসু হাঁ করে দেখল দৃশ্যটা, মুখের বাক্য হয়ে গেছে। তন্ হাঁ হাঁ করে ওঠে, এঃ হেঃ, কী করলেন দেখুন তাে। আমরা ছিলুম কি করতে? কাদাটুকু পার করে দিতে পারতুম না? দাদা যেন কী! সাহেব মানুষের কি এসব পােষায়?
নিজের প্রকৃত অবস্থাটা বুঝে তােতন পা তুলতে গিয়ে দেখল উঠছে বটে, কিন্তু চটি নয় । চটি খুলে সবাই হাতে নিয়েছে, সে নেয়নি। ফলে চটির এখন ডাহা বিসর্জন। এই দেড় হাত কাদার অতল থেকে চটি তুলবে কে?
বাসু রতন দুজনেই দুধারে লাফ দিয়ে নামল। বাসু জিজ্ঞেস করে, পায়ে চটি ছিল? ছিল । পা তুলে ফেলুন, আমি চটি খুঁজে বের করি। দরকার নেই। এখানে হাওয়াই চটি কিনে নিলেই হবে। কিন্তু আমাদের বদনাম হয়ে যাবে। আপনি রতনদার সঙ্গে এগােন, আমি ঠিক চটি নিয়ে আসছি।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
কাদা ভেঙে, এটেল মাটির পিছল অনেকটা আঘাটা পেরিয়ে ওপরে উঠে একখানা চায়ের দোকানের বেঞ্চে তাকে বসাল রতন । দৌড়ে এক মগ জল নিয়ে এল।
করাে কি করে কি? বলে বাধা দেওয়ার আগেই রতন পায়ের কাছে বসে চটপট হাতের কানায় পায়ের কাদা চেঁছে জল ছিটকে পা ধুতে লেগে গেল। কে শােনে কার কথা?
তােতন সিটিয়ে বসে রইল। জ্ঞানবয়সে কেউ তার পা ধুয়ে দেয়নি আজ অবধি। এটা কি হল রতন? পূণ্য হল । আপনি যা কাওসব করে বসেন।
কাদা-মা তােতনের চটিজোড়া হাতে খুলিয়ে বিজয়গর্বে হাসিমুখে হাজির হয়ে গেল বাবুও। মাথা নেড়ে বলল, ভাটি বলে কথা। কাদায় একেবারে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। ধুয়ে এনেছি মদনের দোকান থেকেএই যে।
তােতন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । মায়া জন্মে যাচ্ছে। একটু আগেও এই ছেলে দুটোৰ সতে তর সম্পর্ক ছিল নিতান্তই আলগা। এখন মায়া ঘনীভূত হচ্ছে। কালো রােগা, অকিঞ্চল সরল এ দুটি পেঁয়া ছে েক্রমশ ঢুকে পড়ছে নাকি তার জীবনে?
সম্পর্ক ব্যাপারটাই অদ্ভুত । তুমি চাও বা না চাও কিছু মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রচিত হয়েই যায়, বাসের সেই সতেরাে বছরের হুঁড়িটাও কি শুধু চোখে চোখে সেতুবন্ধন রচনা করে গেল না! বাস রাস্তা আরও হলে কি হত বলা যায় না।
বতনের ভানগাড়ি আর পাকা রাস্তা দেখে একটু কি দমে গেল তােতন? যেমন এখানকার ভটভটি তেমনই ভানগাড়ি । দুটোই ইমপ্রােভাইজেশন । রিকশার মতােই জিনিস, তবে পিছনে সে একখানা কাঠের তক্তা পাতা। আর পাকা রাস্তা হল গেয়ে হাঁটাপথটাই দু’নম্বরী ইট দিয়ে বাঁধানেনা। যার যেমন দরকার ইট তুলে নিয়ে গেছে রাস্তা থেকে সরকার যখন জনগণের বাপ, তখন এ রাস্তাকে বাপের রাস্তা বলা যায়। ফলে জনগণের বাপের রাস্তায় এখন বড় বড় গর্ত । ভ্যানগাড়ি যা লাফাবে তা আগেভাগে আন্দাজ করে শিউরে উঠল তােতন। রতন, হেঁটে গেলেই তাে হয় ।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
হাটবেন: বলে এমনভাবে তাকাল রতন যে তােতন বুঝল, হাঁটার প্রশ্নই ওঠে না। এরা তার খিদে তেষ্টা নিয়ে ভাবছে, পপুশ্রম নিয়ে ভাবছে। ওদেরই ভাবতে দেওয়া ভাল । শুধু একটু কালাে কফি খেতে ইচ্ছে করছে তােতনের। নেশা বলতে ওই একটাই। কিন্তু কালাে কফি না জুটলেও অসুবিধা নেই তােতনের। সে কালাে ককির কথা ভাবতে থাকবে বসে বসে। আর তাতেই অনেকটা কফির স্বাদ গন্ধ পেয়ে যাবে। আজ অবধি তােতন যা যা পেতে চেয়ে পায়নি তার সবই সে ভাবতে ভাবতে
ঘানিকট পেয়ে যায় !
ভ্যান চলেছে। প্রকৃতির ফাঁকে ফাঁকে দীনদরিদ্র জনবসতি। এখানে ডাক্তার বদ্যি নেই, বিদ্যুৎ নেই. বাজারহাট তেমন নেই, বাবু জিনিস কিছুই পাওয়া যায় না। হেলথ সেন্টারের ঘরে এরা সযত্নে গােবরের গাদি করে, গরু-ছাগল রাখে। শােনা যায়, একটা হেলথ সেন্টারের ঝাড়ুদারই ওষুধ-টষ দেয়! ঘরে দোরে সাপ আর বিছের অবাধ আনাগােনা। এইখানে যারা থাকে তাদের ঈশ্বরবিশ্বাস প্রায় বাধ্যতামূল, কারণ ঈশ্বর ছাড়া আর ভরসা করার কিছুই নেই যে।
কাং ঝক ঝকাং ঝক করে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কেরে এবং তেলহীন চাকার কর্কশ শব্দ তুলে ভ্যানগাড়ি চলেছে । সামনে প্যাডেল মরছে একজন, পিছন থেকে ঠেলা দিচ্ছে একজন । এটাই রীতি। ডুবল ম্যান পাওয়ার ছাড়া পৃশ অ্যাণ্ড পুল ছাড়া এ রাস্তায় নােনা বাতাসে মরচে ধরা ভ্যানগাড়ি চলতে চায় না ।
পেটে খিদে চারদিকে নেশাফ ঝিমঝিমে দুপুরম ভ্যানগাড়ির উৎকট শব্দ সব মিলিয়ে মাথাটা কেমন বোদা হয়ে গেল তােতনের। বনে বসেই সে ঢুলতে লাগল। তার মধ্যেই স্বপ্ন দেখতে লাগল । ত্যর মধ্যেই মাঝে মাঝে চোখ খুলে চারদিককার প্রকৃতিরও দেখতে পেল। এবং কিছুক্ষণ পরে সব কিছু একাকার হয়ে যেতে লাগল।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
এই কি তােমার সুন্দরবন রতর? সন্দেশখালি
রতন কাঁচমাচু মুখ করে বলে, জঙ্গল ছিল বাঘ ছিল। এখন সব বসত হয়ে গেছে। বাঘের জঙ্গল মেলা দূরে। এখানে শেয়াল অবধি দেখা যায় না এখন। নামেই সুন্দরবন। কিছু নেই। | শুনতে শুনতে আবার একঝলক স্বর মধ্যে চলে গেল তােতন। আবার বাস্তবে ফিরল যখন রতন তাকে ডেকে একটা হেলথ সেন্টার দেখিয়ে বলল, ডাক্তারবাবু থাকেন বসিরহাট কস্মিনকালেও আসেন না। ওষুধপত্র দূরের কথা, জানালা দরজা অবধি খুলে নিয়ে গেছে।
তােতন দেখল। এরকমই শুনেছে সে। এরকমই হওয়ার কথা। চোখ বন্ধ করতেই ফের আধখানা ঘুমের রাজ্যে চলে গেল তােতন। অস্ফুট স্বরে বলল, এই তাে ভাল। সভ্যতা লােপট করে ফের দুনিয়া জঙ্গলে ভরে দাও। আহাম্মক মানুষের কান মালে দাও কষে। কল-কারখানায় দুনিয়াটাকে কিরকঃ হিজৰিজহি করে ফেলেছে দেখছাে না।
কথাগুলো বতনে কানে গেল না অবশ্য । নে আন একটা দিকে আঙুল তো দেখাচ্ছিল, ওই যে দেখছেন ও সব বাঙালদের বাড়ি ঘর ) ওদের হাতে গাছ খুব হয়।