অসুখ হলে তােমরা কি করাে নাতন । গায়ে হাতড়ে আছে তবে আমরা যাই হােমিওপ্যাথের কাছে। আর জ্ঞসা হলেন ভগবান !
তােতন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার চারদিকটা গুলিয়ে গিয়ে স্বপ্ন আর বাস্তব মেশামেশি হয়ে যেতে লাগল।
ভ্যানগাড়িটা একটা বীভৎস ঠক্কর সামলে ডানদিকে কাত হয়ে ফের সােজা হল। বুকটা দুটো কারণেই ধক করে উঠল তেতিনের। ভ্যানের ঝাঁকুনি আর শর্মিষ্ঠা।
ঘুমের চটকা উবে গেল। টান টান হয়ে বলে সে মায়াভরে দেখল, সামনে কিশাের ছেলেটি ভ্যানগাড়ি চালাতে চালাতে ঘামে হাপুস হয়ে ভিজে গেছে। নােনায় মরচেপড়া “”ড়ি চালাতে গিয়ে দড়ির মতাে ফুলে পাকিয়ে উঠছে ওর পিঠের পেশী । পিছনে আর একজন জানকবুল হয়ে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে ঘামে আর ধূলােয় হয়রান ।
তােতন মনে মনে প্রস্তুত হওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। কোনও প্রস্তুতিই কাজে লাগবে না।
নিউ ইয়র্ক থেকে রওন হওয়ার তিন দিন আগে পরাগের কইনসের বাড়িতে তার : হয়েছিল তােতনের। একসময়ে পরাগ তার খুব বন্ধু ছিল। এখন নেই। এখন পরাগের মধ্যে অনেক ভাঙচুর, অনেক জটিলতা, চেহারায় যেন বুড়িয়ে যাওয়ার ছাপ। শর্মিষ্ঠার চৌদ্দ ভরি সােনার গয়না আর কনকতার বাংকে তার আকাউট আড়াই লাখ টাকার একটা চেক তাকে দিয়ে পরাগ বলেছিল, শর্মিষ্ঠাকে বলিস আর যেন অ্যালিমনিটনি দাবি না করে। কলকাতার ফ্ল্যাটটাও ওরই দখতে চলে গেল। আর কী চায় ও? একজন পাক্তি স্বামীর কাছ থেকে যেথেষ্ট আদায় হয়েছে কিনা সেটা শর্মিষ্ঠা বিচার করবে। কিন্তু তােতনের বিচারে, আমেরিকার স্ট্যাণ্ডার্ডে না হলেও-ভারতীয় অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে শর্মিষ্ঠা ঠকাছে না। তবে মার্কিন আদালতে ডিভাের্নের মামলা করলে শর্মিষ্ঠা আরও অনেক বেশী আদায় করতে পারত।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
হয়তাে পরাগকে আরও দকে মারার জন্যই ডিভাের্স দেয়নি শর্মিষ্ঠা। গয়নাগুলাের জন্য সাঙ্ঘাতিক টেনশন ছিল শর্মিষ্ঠার। প্রতি চিঠিতে গয়নার বন্ধ থাকত কিছু নিয়ে আসতে পেরেছিল, বাকি চৌদ্দ ভরির আটকে রেখেছিল ওরা, অর্থাৎ পরাগ এবং তার মা ! পরাগের মা-অর্থাৎ মাত্মাসী মাত্র দুই আগে মারা যান। যতদিন মামারী বেঁচে ছিলেন ততদিন শ্রার ও বাড়িতে যাওয়ার পথ ছিল না তােতনের। আর ততদিন কিছু আদায় করা যায়নি। মান্তুমাসী ছিলেন যাকে ওদেশে বলে টাফ উওম্যান | রিয়েল টা। পরাগের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে যেদিন শর্মিষ্ঠা ও বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এল নিউ জার্সিতে তােতনের বাড়িতে সেদিন থেকে তােতকে বয়কট করেছিলেন মাত্মাণী । যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন মুখদর্শন করেননি।
কিন্তু ভেতনের কীই বা করার ছিল? কতগুলাে ঘটনা আছে যার লাগা মানুষের নিজের হাতে থাকে না । শর্মিষ্ঠার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়াটার কথাই ধরা যাক। যেদিন তার নিউ ইয়র্কে পৌঁছােনাের কথা সেদিনও পরাগের সাংঘাতিক জুরুরী কাজে সান ফ্রানসিসকে চলে যেতে হযেছিল। তার বউ প্রথম বিদেশে আসছে, রিসিভ তারই করা উচিত। পরাগ তিন দিন আগে এসে তোতনকে ধরল, আমার বউকে রিসিভ করতে তােকে যেতে হবে।
তােতন খুব রেগে গেল, কেন যেতে পারবি না? যদি অফিস তােকে টুর থেকে না ছাড়ে তবে তুই চাকরি ছাড় । এদেশে তাে চাকরির অভাব নেই।
পরাগ অনেক ধানাই পানাই গাইল। কাজটা জরুরী ঠিকই। কিন্তু বউয়ের ব্যপারে কিছু থাকলে মার্কিন সাহেবেরা নরমও হয়। পরাগ তেমনভাবে অফিসে দরবার করলে ছুটিও হয়তাে পেয়ে যেত। কিন্তু চাকরিতে উন্নতি করার অদমা নেশা পরাগের । চাকরি করে প্রাণ দিয়ে। অল্প সময়ে যথেষ্ট উচুতে উঠে গেছে। আরও উঁচুতে উঠতে চায় । চাকরির ব্যাপারে কোনও আপসরফাই সে কখনও করে না ।। | তােতন জুলাইয়ের এক গরম অপরাহ্নে তার দুখানা গভির শ্রেটি অর্থাৎ বি এম বদিউ নি যথারীতি হাজির ছিল এয়ারপোের্ট । শর্মিষ্ঠার চেহারা তাকে ফাটায় দেখিয়ে চিনিয়ে রেখেছি
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
পরাণ । তাছাড়া একগাদা বাঙালী মেয়ে তাে আর নামবে না প্লেন থেকে। বিরক্তি আর ধৈর্যহীনতা নিয়ে ইমিগ্রেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল সে। একটু নার্ভাস মুখে, হতান্ত যুবুতীটিকে যখন দেখা গেল, ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসছে এবং চোখে আতঙ্ক মেশানো দৃষ্টি, তখনই একটা কিছু ঘটে গিয়েছিল তােতনের ভিতরে। এ হচ্ছে সেই সব ঘটনার অন্যতম যার লাগাম মানুষের হাত থাকে না। ঐলিটা ওয় হাত থেকে নীরবে কেড়ে নেওয়ার পর তােতন জিজ্ঞেস করল, আপনিই শর্মিষ্ঠা তাে!’
আর আপনি তােতন ! কী অদ্ভুত নাম । আপনার কোনও ভাল নাম নেই ? শর্মিষ্ঠার হাসি দেখে, চোখ দেখে, গলা শুনে তােতনের অভ্যন্তর তার বিবেক গলা খাকারি দিয়েছিল। বাপু হে, সাবধান ?
কিন্তু বিবেকের কথায় কেই বা কবে কান দিয়েছে ? বিবেক তার মনে বলে যায়, আর মানুষ তার মতলবমতাে চলে । তােতন বলল, না। আমার এই একটাই নাম : অপছন্দ হলেও কিছু করার নেই।
অপছন্দ মােটেই নয়। একটু অদ্ভুত, এই যা, আচ্ছা, নিউ ইয়র্কের ভিতর দিয়েই তাে আমরা যাব। দেখা যাবে না শহরটা ?
একটু বাদেই দেখতে পাবেন বা ধারে । তবে আমারা শহরটাকে বাইপাস করে বেরিয়ে যাবাে। ইস, একটু ভিতর দিয়ে গেলে হত না! নিউ ইয়র্ক দেখব বলে কতদিন ধরে অপেক্ষা করছি।’ তােতন একটু হেসে বলে, নিউ ইয়র্ক লেখবেন তাতে আর অসুবিধে কি ? দেখতে দেখতে চোখ পচে যাবে। তবু প্রথম দেখা বলে একটা কথা আছে না!
হাঁ, তা আছে। তবে কি জানেন, নিউইয়র্ক একটু দূরে থেকে দেখতেও খুব ভাল। এবার আপনি বাঁ দিকে তাকান, ওই নিউ ইয়র্ক । আজ আপনার কপাল খারাপ, একটু মিষ্ট আছে। আবছা দেখাচ্ছে।
কিছুক্ষণ বাঁ দিকে চেয়ে শর্মিষ্ঠা নিউ ইয়ার্ক দেখল। রােদ থাকা সত্বেও আটলান্টিকের রহস্যময় কুয়াশা মাঝে মাঝে এরকম ভাবে ঝুলে থাকে শহরের ওপর।তবু নিউ ইয়র্কের অসাধারণ আকাশরেখা পেনসিলে আঁকা ছবির মতাে দেখা যাচ্ছিল ঠিকই।
শর্মিষ্ঠা কিছুক্ষণ পর হঠাৎ নীরবতা ভাঙ্গল, আচ্ছা আপনি বােধহয় পরাগের খুব ইন্টিমেট বন্ধু। আপনার কথা খুব লেখে টেলিফোনেও বলেছে।