তাই নাকি? এইবার আমরা ব্রকলি ব্রীজ পেরােবাে। সামনে ওই যে দেখা যাচ্ছে। বাঃ, বিরাট ব্রীজ, না? আপনি তাে ব্যাচেলর । শুনেছি একা একটা বিরাট বাড়ি নিয়ে থাকেন। তােতন ফের এই ছেলেমানুষী প্রশ্নে হাসল, বাড়িটা আমি কিনেছি। কোনও চয়েস ছিল না তো, কপালে একটা বড় বাড়িই জুটে গেল।
বিয়ে করেন না কেন? এত বড় বাড়িতে একা থাকে নাকি লােকে? বিয়ে! সে দেখা যাবে।
আপনি একটু কিপটে আছেন, না? কিপটেরা চট করে বিয়ে করতে চায়না। আগে টাকা জমায়, ঘর গোছায়, তারপর পাকাচুল নিয়ে বিয়ের পিড়িতে বলে। আচ্ছা আপনার আবার মেমসাহেবের দিকে ঝোঁক নেই তাে!
প্রথম আলাপেই কোনও বাঙালী মেয়ে যে এরকন্থ প্রগল্ভ হয়ে উঠতে পারে তার কোনও ধারনা ছিল না তােতনের। আর এত ফ্রি।
বিবেক আর একবার গলাখারি দিল, এ মেয়ে কিন্তু ভািগাবে হে। তফাত থেকে।
শর্মিষ্ঠাকে অভ্যর্থনা করলেন মান্তু মাসী । বিরস মুখ । কলিং বেল বাজাবার পর এমন ভাবে দরজা খুলে ধরলেন যেন ভিতরে যেতে দেওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই ।
শর্মিষ্ঠার দুখানা ঢাউস স্যুটকেস গাড়ির থেকে নামিয়ে ঘরে পৌছে দেওয়ার পরও মামাসী সেদিন ফিটুকুও অফার করলেন না । শর্মিষ্ঠা ঘরে পা দেওয়ার পরই কেমন থমথমে হয়ে উঠল
হয়। | তানই বুকে গিয়েছিল যেন মেয়েটার কপালে কষ্ট আছে : পরাগকে সে জানে । এক নম্বরের
ইন। মামী অতটা দ’র মহি, কী হবে না হবে কে জানে বাবা।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
দেশ থেকে নতুন বউ এল একটু পার্টি-টার্টি দেওয়ার প্রথা আছে বাঙালীদের মধ্যে পরাগ সে সবের ধার দিয়েও গেল না। শুধু টার থেকে ফিরে একদিন টেলিফোন করে বলল, আমার বউকে কষ্ট করে রিসিভ করেছিস বলে ধমাবাদ। ও তাের কথা খুব বলেছে।
তাই নাকি? কিন্তু বলবার আছেটা কী,পরিচই তাে হয়নি ভাল করে। তবু বলেছে। সবই বেশ প্রশংসাসূচক।
ভেবেচিন্তে দাবাড়ুর মতাে একটা চাল দিল তােতন,মাস্তুমাসীর তাে এবার সুবিধেই হল, একটু বেশ বিশ্রাম পাবেন। ঘরকন্নী করার লােক এসে গেছে ।
টেলিফোনে একটা দীর্ঘশ্বাস শােনা গেল পরাগের, মাকে তাে জানিস। শর্মিকে হেঁসেলে এখনও ঢুকতে দেয়নি। একদিন কী একটা রান্না করেছিল, সেটা ভাল হয়নি। ব্যস,মা বিগড়ে গেল ।
এনিওয়ে, চলছে ।
তােতন আর ঘাঁটায়নি। তােতন সন্তর্পণে জিঞ্জেস করল, তাের বউ কি এখন বাড়িতে নেই? থাকবে না কেন? আছে । দে টেলিফোনে কথা বলি।
নাে লাক। বাইরের ঘরে কয়েকজন এসেছে। বিজি টকিং। পরে ফোন করবেন । তুই একদিন চলে আয় না,এই উইক এন্ডেই আয়।
আমন্ত্রণটা খুব আন্তরিক ছিল না। তবু সে রাজি হল। তােতনের শহর থেকে পরাগের শহরের দূরত্ব ত্রিশ মাইলের বিশী নয়। এ দেশের মাপে দূরত্ব খুবই কম। উইক এন্ডে তােতন খুব আলসেমি করে। দুটো দিন দাড়ি কামায় না, বই পড়ে, ভিডিও দেখে, কেউ এলে অম্ল নারে এবং চিঠি পত্র লেখে। আজকাল সে আর বেশী বেড়াতে-টেড়াতে যায় না। সেই উইক এন্ডে দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে, পোশাক কারে গেল পরাগের বাড়ি।
মাত্তমাসী নিজে ভালই গাড়ি চালাতে জানেন এবং উইক এভে তিনি নিয়মিত মঠ মন্দিরে যান। কখনও রামকৃষ্ণ মিশনে কখনও ইসকনের বাজরাতাদের মন্দিরে। চেনত্যনাদের বাড়িতে গিয়েও পেকে আসেন কখনও খখনও। সেদিন গিয়ে তাজ্জব হয়ে তোতন দেখল, মাসী তার সাপ্তাহান্তিক আউটিং-এ গেছেন বটে, কিন্তু সারথি হিসেবে ছেমােকেও নিয়ে গেছেন। ওঁর নাকি প্রেশার বেড়েছে,গাড়ি চালাতে পারবেন না।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
শর্মিষ্ঠা বাইরের ঘরে বসেই কাঁদছিল । যখন জা খুলল তখন তার মুখে কান্না ছলছল করছে ।
তােতন সাংসারিক জীব নয়, মহিলাদের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা কম এবং ভয় বেশী । সে তােতলাতে তােতলাতে বলল, ক-কী ব্যাপার? যখন দেখল শর্মিষ্ঠা ছাড়া আর কেউ নেই তখন সে আরও তােতলাতে লাগল ।
পয় ধরা মুখে শর্মিষ্ঠা তাকে বাইরের ঘরে এনে বলল, বসুন । ওরা আপনাকে একা রেখে চলে গেল কেন? সেটা তাে আমারও প্রশ্ন। কিন্তু জবাবটা কে দেবে?
তােতন অত্যন্ত বিস্মিতভাবে মাথা নেড়ে বলে, অথচ আমাকে নেমন্তন্ন করেছিল পরাগ । এর কোনও মানে হয়?
আপনাকে আপ্যায়ন করার ভার আমার শক্তি আমাকেই নিয়ে গেছেন। ওঁরা রাতে ফিরবেন। অনেক প্রােগ্রাম। আপনার ভয় নেই, রান্না উনি নিজেই করে রেখে গেছেন।
তােতন ফের তােতলাতে লাগল,ননা–মানে, এভাবে একা বাড়িতে-ঠিক- এ কি হয়?
আপনি ভীষন ঘাবড়ে যাচ্ছেন। মাথা ঠান্ডা করে বসুন । আপনাকে আমার কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে । তােত কিন্তু কমেই আরাে ঘাবড়াচ্ছিল। অথচ একজন মহিলার সঙ্গে একা বাড়িতে কয়েক
স্টা কাটানাের মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। আমেরিকায় কত বন্ধু-পত্নীর সঙ্গে সে আড়: মেরেছে এদেশে শুচিবায়ুহীন নারী-পুরুষ সম্পর্কের হাওয়ায় তার কেটেছে অনেকদিন। তবে শর্মিষ্ঠতে দেখে সে ঘাবড়াচ্ছে কেন?
জবাবটা দিন তার বিবেক ওরে আহাম্মক, তাের যে বারোটা বেজেছে। এখনও লেজ তুলে পালা বলছি।
তােতন অবশ্য পালায়নি । মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করতে করতে সে বলল,কিসের প্রশ্ন? আপনারা এই জঘন্য দেশে বছরের পর বছর আছেন কি করে?
শর্মিষ্ঠার গলার ঝাঁঝ আর তিক্ততায় থতমত খেয়ে তােতন বলল,জঘন্য! আপনি ভাল করে দেখেননি এখনও, তাই–
সমান ঝাঁঝের সঙ্গে শর্মিষ্ঠা বলে, অনেক দেখেছি। কী আছে এদেশে? শুধু গােলকধাঁধার মতাে রাস্তা, বড় বড় বাড়ি আর বনজঙ্গল। দেখতে সুন্দর হলেই হল!
তেতন নরম গলায় বলে, আর কিছুদিন থাকুন, ভাল লাগবে। প্রথম প্রথম কেমন যেন লাগে বটে।
মােটেই নয়। আমার কোনওদিনই আমেরিকা তাল লাগবে না । আমার আর একটা প্রশ্ন,আপনার এত চাকরি–চাকরি করে পাগল কেন? সারাদিন চাকরি করা ছাড়া আপনাদের আর লাইফ বলে কিছু নেই?
এদেশে তাে কাকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই কিনা । তা বলে এরকম ক্রীতদাসের জীবন! চাকরির ভয়ে একজন পুরুষমানুষ এত সিটিয়ে থাকবে।