হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-৭)

তোতন এবার খুব মৃদু স্বরে বলল, পরাগের ব্যাপারটা একটু আলাদা। ও বড় চাকরি করে, টেনশন বেশীওসব কথা একটু থাক নাবরং এক কাপ কালো কফি খাওয়ান চিনি ছাড়া | শর্মিষ্ঠা কেন যেন একথায় এক ঝলক হাসল কী যে সাঙঘাতিক এবং বিপজ্জনক হালি তা টের পেয়ে, মাঝদরিয়ায় তুফানেপড়া নৌকোর মাঝির মতাে বিবেক চেচিয়ে উঠল, সামাল ! সালচোখ বুজে ফেল বাস্তবিকই চোখ বুজে ফেলেছিল তােতন

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়মােলায়েম গলায় শনিষ্ঠা বলে, আপনি কি যুব টায়ার্ড? চোখ বুজে আছেন যে! আপনি কেমন আছেন মিষ্টা? 

আমি ! ও মা, কেন? আমি তাে খুব ভাল আছি, রভেদ্রানীর মতাে আছি দেখছেন না রাজ্যপাট আমার হাতে দিয়ে ওর মায়ে পেয়ে মেন চলে গেছেন

 তােতন মাথা নেড়ে বলে বুঝতে পারছি আগে কফিটা খাওয়ান, তারপর চলুন আপনাকে একটু ঘুরিয়ে আনি। 

কোথায়? নিউ ইয়র্ক শর্মিষ্ঠার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল । 

তােতনের তােতলামি সবটাই সেরে গেল তার বি এম ডবলুতে চড়ে নিউ ইয়র্ক শহর শর্মিষ্ঠাকে দেখতে দেখতে| শর্মিষ্ঠা মু, আবিষ্ট ডেলিকাটেসেনের সুস্বাদু খাবার, রাস্তার আইসকিক্রিম, সূবই সম্মােহিত করে দিল মেয়েটাকে। 

 কী, এখন আমেরিকা কেমন লাগছে? ততটা জঘন্য কি

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের খােলা ছাদে দাঁড়িয়ে শর্মিষ্ঠা সামান্য ধরা গলায় বলল, আপনার সঙ্গে তে ভীষণ ভাল লাগছেকিন্তু গত দুটো উইক এড. আমাকে নিয়ে বেরিয়েছিল কী যে বিশ্রী লেগেছে

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

বিবেক বলে উঠল, লক্ষণ ভাল নয়, ভাল নয়, ভাল নয়.

এ ঘটনার দু’সাপ্তাই বনে এক শনিবার সকালে তােতন একটা নেমন্তন্নে বেরােচ্ছিল, সেইসময়ে র্মিষ্ঠার ফোন এল, এই আপনার হাতে আজ সময় আছে? 

কেন লুন তাে! উক্ত একটু বেড়াতে যাবেন কোথাও? যে আমার একটা নেমন্তন্ন আছে ব্রিজ খেলারসেখানেই খাওয়াদাওয়া, নাইট স্টে

আহা, ব্রিজ বেলা আবার একটা ব্যাপার নাকি? ঘরে বসে বসে সময় কাটানোর চেয়ে ঘুরে বেড়ানাের আনন্দ কত বেশী বলুন! 

কেন, পরাগটা আপনাকে নিয়ে বেরােয়নি বুঝি আজ? পরগ! সে পাখি তাে পর দিন উড়ে গেছে। কোথায়? সান ফ্রানসিসকো। মিড উইকে ফিরবার কথা। আর মাস্তুমাসী? তাঁর রাডপ্রেশার কমে গেছে। সকালে ব্রেকফাস্টের পরই বেরিয়ে গেছেন। রাতে ফিরবেন। আচ্ছা, আপনি গাড়ি চালানাে শিখছেন না কেন? 

কে শেখাবে বলুন। 

শেখানাের লােক আছে । ওটা না শিখালে এখানে ঘরবন্দী হয়েই থাকতে হবে আপনাকে। শহরটাও চিনে নেওয়া দরকার। এ দেশে সব জায়গার রােড ম্যাপ পাওয়া যায়। সেগুলাে দেখে 

দেখে…. 

আচ্ছা, এত উপদেশ দিতে হবে না। পরবেন কিনা বলুন। তােতন বিপন্ন গলায় বলে, কি হয়েছে জানেন ওরা সবাই অপেক্ষায় করবে তাে 

ব্রিজ খেলা মােটেই ভাল নয়। আমি কিন্তু আপনার আশায় প্রায় সেজেগুজে বসে আছি না এলে সারাটা দিন একা কি করে কাটাবাে বলুন তাে! এক বেরােতে ভীষণ ভয় করে, যদি রাস্তা চিনে ফিরে আসতে না পারি! 

এ যেন এক বিপন্ন নারী সমর্থ পুরুষের সাহায্য চাইছে করুণ আর্ত কণ্ঠে । আয় তােতনের অভ্যন্তরের আদিম পুরুষটি যেন সব বাধা ছিন্ন করে ছুটে যেতে চাইছে সেই বিপন্নার কাহ। বাধা দেওয়ার একটা অক্ষম চেষ্টা করেছিল বটে বিবেক। একটা গতি টেনে দিয়ে যেন বলে উঠেছিল, খবরদার, এর বাইরে যাসনে ।

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

তােতন বলল, ঠিক আছে। আসছি ।

গিয়ে দেখল, দুরন্ত সালােয়ার কামিজ পরা শর্মিষ্ঠা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। দেখে যে হাসিটা হাসল তাতে তােতনের হার্টবিট একটা দুটো মিস হয়ে গেল। তারপর লহরা বুজতে লাগল বুকের মধ্যে। 

অশান্তিটা হতে রু করল প্রায় বছর খানেকের মাথায়। ততদিনে শর্মিষ্ঠা গাড়ি চালানাে শিখে নিয়েছে। রাস্তা চিনেছে। পরিচিতি বেড়েছে। 

শর্মিষ্ঠার এইসব কৃতিত্বে পরাগ খুশিই হয়েছিল, মান্তুমাসী হননি, শাশুড়ি-বউয়ে যে তুমুল টাশটি হচ্ছে এটা শর্মিষ্ঠা মাঝে মাঝে ফোনে তাকে জানাত। 

সেবার দুর্গাপুজোর উইক এন্ডে সবাই জড়ো হয়েছে কালুদার বাড়িতে। দু’ দিতন খাওয়া-দাওয়া আমােদ-ফুর্তির বন্যা। রাতটুকু শুধু হােটেলে বা মােটেলের ঘরে কাটিয়ে সকাল থেকেই পূজোর আসরে সবাই হাজির। সেই সময়ে আচমকাই মামামী তােতনকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন বেশ স্পষ্ট বেধাহীন ভাষায়, তােতন, বউমাকে তুমিই কিন্তু নষ্ট করছে। 

কি করলাম মাসীমা? 

বউমা যখন প্রথম এসেছিল তখন একরকম ছিল, কিন্তু তােমার আসকারা পেয়ে এখন পাখা মেলেছে, তুমি কি আমাদের ঘরের শান্তি নষ্ট করে দিতে চাও? 

অবাক তোতন ও বলতে পারল, না মার্সীমা কিন্তু আমি তাে 

এমনিতেই সে কথার ওস্তাদ নয়, বিপদে পড়লে বা ঝগড়ার আভাস পেলে তার বা আরও হারিয়ে যায় । মামাসী আরও দৃঢ় গলায় বললেন, মেয়েমানুষের সবচেয়ে বড় গুণ তার পবিত্রতা, সাে 

তো মানাে? ওকে নষ্ট করছে কেন? 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় 

তােতন পবিত্রতামানে, কিন্তু অত্যাচার এবং নিষ্ঠুরতা মানে না। শমিষ্টার ওপর যে একধরনের ‘মানসিক অত্যাচার চলছে তা সে ভালই জানেকিন্তু সেকথা সে বলতে পারল নাশুধু চেয়ে রইল। 

তুমি ওর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখাে এটা আমরা চাই না, পরাগ তাের বন্ধু, তােমার উচিত ওর মনের দিকে চেয়ে কাজ করা, ওর যাতে ভাল হয় সেদিকে লক্ষ রাখাযদি ওদের ভালই চাও তাে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে রেখে । 

সেবার পূজোর আনন্দটা এমন মাটি হয়ে গেল তােতনের কাছে যে, সে পুরাে সময়টা থাকল পর্যন্তসেদিনই কাউকে কিছু না বলে ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়ে ফিরে এল নিজের একা বাড়িতে। 

বেশ অনেকদিন আর শর্মিষ্ঠার সঙ্গে কোনও যােগাযােগ ছিল না। টেলিফোনও আসত না হয়তাে শাসন শুধু তােতনকেই নয়, শর্মিষ্ঠাকেও করা হয়েছিল । 

নিউ ইয়র্কের ব্রংকসে একদিন সুব্রতর সঙ্গে দেখাসস্ত্রীক বেড়াতে বেরিয়েছেকথায় কথায় সুব্রত বলল, শুনেছাে, আমাদের পরাগের সঙ্গে নাকি তার বউয়ের খুব খিটিমিটি চলছে। 

* সুব্রতর বউ প্রণতি নারী স্বাধীনতার একজন উচ্চকণ্ঠ সমর্থক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *