কিছু ভালমন্দের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। অথচ তোতন গেলে রতনের কোনও বৈষয়িক লাভ নেই, কোনও অভীষ্ট সিদ্ধ হবে না এমন কি শ্রেণীগত পার্থক্য থাকায় তোতনের সঙ্গে সমানে সমানে বসে যে আড্ডা দেবে সে সাহসও নেই। আমেরিকা থেকে নানারকমের উপহার এনেছিল তােতন। রতনকে এক প্যাকেট রেড আর একটা আফটার শেভ লােশন দিয়েছিল।
সেই সামান্য উপহার পেয়েই এমন বিগলিত হয়ে গিয়েছিল যে, বিকেলবেলাতেই দু সেৱী হাঁড়িতে ভাল দৈ এবং অন্তত একশ টাকার রাবড়ি নিয়েই এসে পাল্টা উপহার দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাল। সুতরাং বলতেই হয়, তােতনের কাছে ওর কোনও বৈষয়িক প্রত্যাশা নেই। তবু যে কেন নিজেদের গাঁয়ে নিয়ে যাওয়ার এত গভীর ইচ্ছে কে জানে!
শর্মিষ্ঠা আসবার আগেই অবশ্য ডাব এসে গেল । একজন মধ্যবয়সী ফর্সা লােক দুখানা ভাব দুজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, কাঠি তাে নেই, অসুবিধে হবে।
কাঠি কী জিনিস তা না বুঝে তােতন মুখকাটা ডাবের জল মরুভূমির মতো শুষে নিল। আর একটা দিই? দিন। বাইরে দুটো ছেলে আছে, ভ্যানগাড়ি টেনে এনেছে যারা দিয়েছি। ওরা সব ঘরের ছেলে। আমি শর্মিষ্ঠার কাকা । সম্মান দেখাতে একটু মাথা ঝাকাল তােতন । লােকটা শশব্যস্ত ডাব আনতে গেল।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
দ্বিতীয় ডাব শেষ হওয়ার পর শর্মিষ্ঠা এল ।হ্যাঁ, একটু সেজেই ! ‘চুল আঁচড়ানাে, মুখে সামান্য একটু মেক আপ শাড়িটা নতুন করে জড়ানাে। সে–ই শর্মিষ্ঠাই, শুধু পটভূমিটা এক নয় বলে তােতনের বুঝি মনে হচ্ছে অন্যরকম। নাকি অন্যরকমই?
ধাঁধাটা থেকে গেল এই মলিন ঘরদোর, অনুজ্জ্বল আলাে, ঘেমাে পরম, রতনের চঞ্চল চোখ সব কিছুই শর্মিষ্ঠাকে বুঝে নিতে বাধা দিচ্ছে।
কিন্তু এ সময়টা রুত্বপূর্ণ। সে ঠিক করে রেখেছিল, শর্মিষ্ঠার জিনিসগুলি হস্তান্তর করার সময় সে শর্মিষ্ঠাকে লক্ষ করবে। খুব ক্রিটিক্যাল লক্ষ করবে। জিনিসগুলির জন্য শর্মিষ্ঠা কি হামলে পড়বে বা খুব বেশী আগ্রহ দেখাবে, নাকি খুব নির্বিকার নিহভাবে গ্রহণ করবে?
শর্মিষ্ঠা মুখােমুখি উচু চৌকির বিছানায় বসে সামান্য ঠ্যাং দোলাচ্ছিল। মুখে একটু হাসি।
ছােটো করে চুল হেঁটেছেন, মুখটা কেমন তাে হয়ে আছে, কী হয়েছে আপনার বলুন তো! দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ ঠেলে একটা ভালুকের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়েছে আপনাকে।
না, মানে, ভাবছিলাম এ৩ দিন পর দেখা হল, অথচ একটুও খুশি হননি তাে আমাকে দেখে!
তােতন জানে, এর একটা জুৎসই জবাব আছে। কিন্তু এমনিই মন্দভাগ্য তার যে কিছুতেই সময়মতাে জুসই জবাবগুলাে তার মাথায় আসে না। পরে আসে, যখন দরকার নেই। এখন মুখে যা | এল তা কথা নয়, বিললিত করে একটা হাসি। অর্থহীন বােক-হাসি। তবে এই অপ্রতিভ অবস্থার
মধেও সে লক্ষ করল, গয়নার কথা বা টাকার প্রসও তুলছে না শর্মিষ্ঠা।
রতন গলা খাকারি দিল । অর্থপূর্ণ পলা খাকারি যুবই মিনমিনে গলায় বলল, বেলা হয়ে যাচ্ছে।
শর্মিষ্ঠা তার বিশাল বিস্ফারিত চােখ ফিরিয়ে একবার রতনকে দেখল, তারপর তােতনের দিকে চেয়ে বলল, স্নাম খাওয়া সেরে নিন। তারপর আপনার সঙ্গে আজ আমি কলকাতায় ফিরব।
ফিরবেন! তােতন একটু অবাক হল যেন।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
হ্যা। আজই । যেন এই নিয়ে আর কারও কোনও প্রশ্নই থাকতে পারে না এমনতরাে মুখের ভাব করে শর্মিষ্ঠা উঠে পড়ল, এখানে কিন্তু সেরকম স্নানঘর নেই। আর ডাইনিং টেবিলও নেই। কিন্তু ইমপ্রােভাইজেশন আছে। অসুবিধে হবে কিন্তু।
তােতন মাথা নেড়ে বলল, অসুবিধে নেই। কিন্তু আমার যে আর একটা প্রােগ্রাম ছিল। এই ছেলেটি রতন। এর খুবইচ্ছে ছিল এর গ্রাম আতাপুর থেকে একটু ঘুরে আসি।
শর্মিষ্ঠা নাক কুঁচকে রতনের দিকে চেয়ে রইল একটু। ঝাঝ দিয়ে বলল, কেন নিয়ে যাচ্ছেন বন তাে! কী দেখাতে? আতাপুর একটা জায়গা।
একথায় একদম নিবে গেল রতন। মাথা নিচু করল।
শর্মিষ্ঠা তােতনের দিকে ফিরে বলে, আপনারও বলিহারি যাই। সুন্দরবন দেখতে এসেছেন বুঝি এখানে? এই গোটা তলুট জুড়ে জঙ্গলের নামগন্ধ নেই । সুন্দরবন দেখতে হলে স্পীডবােটে করে নদী থেকে দেখবেন। এখন উবুন তাে। বেলা হয়ে যাচ্ছে।
এরপর যেন আর কথা চলে না। রতনের সন্তে রচিত প্ল্যান নস্যাৎ হয়ে গেল। শর্মিষ্ঠার সামনে পড়ে আর দ্বিরুক্তি করছে না রতন, ভাল মানুষের মতাে মেনে নিচ্ছে একথার পর নতমুখে উঠে পড়ল
শর্মিষ্ঠা একটা ধমক দিল রতনকে, উঠে পড়লেন যে বড়! না খেয়ে কারও যাওয়া চলবে না।
রতন বসে পড়ল
তােতন যেন এতক্ষণে স্বস্তি বােধ করল । এবং বুঝতে পারল, তার আতাপুর অবধি যাওয়ার কোনও ইচ্ছেই ছিল না। শর্মিষ্ঠার কাছ অবধিই তার আসার কথা। এখানেই দাঁড়ি। আর যাওয়ার মানেই হয় না ।
দুই ।। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে নােটন নিজের ভুড়ি দেখছে। অবাক হয়ে দেখছে, বিরক্ত হয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে দেখছে। সে খাটের কিনারে বসে আছে, বিরক্তিকর নাইলনের মশারি সুড়বৃড়ি দিচ্ছে পিঠে, সামনে ছড়ানে তার পায়জামা পরা দুই পা, পায়জামার কবির ওপর দিয়ে উপচে পড়ছে তার পেটের চর্বি । খামছে ধরে সে দেখল, অন্তত ইঞ্চি তিনেক নীরেই চর্বি । আজকাল শার্ট টাইট হচ্ছে প্যান্টও খােড়ার কাছে বড় সেঁটে থাকে। এসব হচ্ছেটা কী? ইচ্ছেটা কী? হচ্ছেটা কী?
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
মশারি এমনও ফেলা। ভিতরে তার ধামসানাে বিছানা। সুপারফাইন হালকা প্রিন্টের দামী বিদেশী বেডশীটে চক্কর চক্কর ঘামের ছাপ, বালিশ ঈষৎ সিক্ত । ফুল স্পিডে সারা রাত পাখা ঘােরে, তবু এত ঘাম কেন হয় তার? এত ঘাম হওয়া কি ভাল? নাকি হার্ট বেশী পরিশ্রম করছে? নাকি অন্য কিছু?
সামনেই আয়না। ঘুম থেকে উঠইে রােজ আয়নার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। সে আয়নার পক্ষপাতী নয় এবং ও জায়গায় আয়নাটা সে টাঙায়ওনি। কিন্তু এ বাড়িতে জিনিসিপত্র এতই বেশী যে, কোনটা কোথায় রাখা যায় সেইটে নিয়ে প্রায়ই তুমুল বাকবিতণ্ডা বেঁধে যাচ্ছে। স্থানাভাবে এই আয়নটার অন্য দেয়াল জোটেনি । নােটনের বিছানার মুখােমুখি টাঙানাে হয়েছে । নিজের মুখ দেখতে নােটন যে খুব ভালবাসে এমন নয়। কিন্তু রােজ সকালে উঠে দেখতে হচ্ছে বলে আজকাল তার অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু আয়নায় যা দেখছে তাতে খুশি হচ্ছে না সে। শরীর যেন উপচে পড়ছে চর্বিতে। ধুতনির একটু পিছনে কি গলকম্বলের আভাস? পেটানাে চেহারার সেই বঁধুনি কি অনেকটাই ঢিলে হয়ে যায়নি? কিন্তু সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বস্তু হল পেট, ফিগারের বারােটা বজাতে উঁড়ির জুড়ি
নেই।