হ্যানিম্যান [১৭৫৫–১৮৪৩]
১৭৫৫ সালের ১০ এপ্রিল (কারো কারো মতে ১১ এপ্রিল) মধ্যরাতে জার্মান দেশের মারগ্রে ওগেট প্রদেশের অন্তর্গত মিসেন শহরে এক দরিদ্র চিত্রকারের গৃহে জন্ম হল এক শিশুর । দরিদ্র পিতামাতার মনে হয়েছিল আর দশটি পরিবারে যেমন সন্তান আসে, তাদের পরিবাবেরও তেমনি সন্তান এসেছে । তাকে নিয়ে বড় কিছু ভাববার মানসিকাত ছিল না তাদের ।
তাই অবহেলা আর দারিদ্র্যের মধ্যেই বড় হয়ে উঠল শিশু । তখনো কেউ কল্পনা করতে পারেনি এই শিশুই একদিন হয়ে উঠবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে এক নতুন ধারার জন্মদাতা, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থার জনক ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডরিখ স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ।
হ্যানিম্যানের বাবা গডফ্রিড মিসেন শহরের একটা চীনামাটির কারখানায় বাসনের উপর নানা নক্সা করতেন, ছবি আঁকতেন । এই কাজে যা পেতেন তাতে অতি কষ্টে সংসার চলত । হ্যানিম্যান ছিলেন চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় । পিতামাতার প্রথম পুত্র সন্তান । গডফ্রিডের আশা ছিল হ্যানিম্যান বড় হয়ে উঠলে তারই সাথে ছবি আঁকার কাজ করবে, তাতে হয়তো সংসারে আর্থিক সমম্যা কিছুটা দূর হবে । কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই হ্যানিম্যানের ছিল শিক্ষার প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহ ।
Hahnemann Biography
বাড়িতেই বাবা-মায়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শুরু হল । বারো বছর বয়সে হ্যানিম্যান ভর্তি হলেন স্থানীয় টাউন স্কুলে । অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হলেন তাঁর শিক্ষকরা । বিশেষত গ্রীক ভাষায় তিনি এতখানি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে তিনিই প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্রিদের গ্রীক ভাষা পড়াতেন ।
টাউন স্কুলে শিক্ষা শেষ করে হ্যানিম্যান ভর্তি হলেন প্রিন্সেস স্কুলে (Prince’s School) । এদিকে সংসারে ক্রমশই অভাব আর দারিদ্র্য প্রকট হয়ে উঠেছিল । নিরুপায় হ্যানিম্যানকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে লিপজিক শহরে এক মুদির দোকানে মাল কেনাবেচার কাজে লাগিয়ে দিল । স্কুল কর্তৃপক্ষ এ কথা জানতে পেরে হ্যানিম্যানের স্কুলের মাইনে ও অন্যসব খরচ মত্তকুব করে দিল যাতে আবার কৃতিত্বের সাথে উর্ত্তীণ হলেন হ্যানিম্যান । তিনি একাধিক ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন ।
ক্রমশই তাঁর মধ্যে উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠছিল । পিতার অমতেই লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্যে বেরিয়ে পড়লেন । হাতে সম্বল মাত্র ২০ খেরল (আমাদের দেশের ১৪ টাকার মত) । তিনি ভর্তি হলেন লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে । নিজের খরচ মেটাবার জন্য ধনী গ্রীক যুবককে জার্মান এবং ফরাসি ভাষা শেখাতেন । এছাড়া বিভিন্ন প্রকাশকের তরফে অনুবাদের কাজ করতেন ।
Hahnemann Biography
হ্যানিম্যানের ইচ্ছা ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করবেন । তখন কোন ডাক্তারের অধীনে থেকে কাজ শিখতে হত । লিপজিকে কোন ভাল চিকিৎসকের কাছে কাজ করার সুযোগ পেলেন । তখন তাঁর বয়স বাইশ বছর । ইতিমধ্যেই তিনি গ্রীক, লাটিন, ইংরাজি, ইতালিয়ান, হিরু, আরবি, স্প্যানিশ এবং জার্মান ভাষায় যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন । এবার ভাষাতত্ত্ব ছেড়ে শুরু হল চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন ।
দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময় তাঁর সমান্য গচ্ছিত অর্থ একদিন চুরি হয়ে গেল । নিদারুণ অর্থসংকটে পড়লেন হ্যানিম্যান । এই বিপদের দিনে তাঁকে সাহায্য করলেন স্থানীয় গভর্নর । তাঁর লাইব্রেরী দেখাশুনার ভার দিলেন হ্যানিম্যানকে । এই সুযোগটিকে পুরোপুরি সদব্যবহার করেছিলেন তিনি । এক বছর নয় মাসে লাইব্রেরীর প্রায় সমস্ত বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিলেন ।
হাতে কিছু অর্থ সঞ্চয় হতেই তিনি ভর্তি হলেন আরল্যানজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে । এখানে থেকেই চব্বিশ বছর বয়সে “ডক্টর অব মেডিসিন” উপাধি পেলেন ।
Hahnemann Biography
ডাক্তারি পাস করে এক বছর তিনি প্র্যাকটিস করার পর জার্মানির এক হাসপাতালে চাকরি পেলেন । এই সময় চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধীয় প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হল । এই প্রবন্ধে নতুন কিছু বক্তব্য না থাকলেও রচনার মৌলিকত্ব অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল ।
অন্য সব বিষয়ের মধ্যে রসায়নের প্রতি হ্যানিম্যানের ছিল সবচেয়ে বেশি আগ্রহ । সেই সূত্রেই হেসলার নামে এক ঔষধের কারবারীর সাথে পরিচয় হল । নিয়মিত তাঁর বাড়িতে যাতায়াত করতে হতো । হেসলারের সাথে থাকতেন তাঁর পালিত কন্যা হেনরিয়েটা । হেনরিয়েটা ছিলেন সুন্দরী বুদ্ধিমতী । অল্পদিনেই দুই তরুণ-তরুণী পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেন । ১৭৮২ সালের ১৭ নভেম্বর দু’জনের বিয়ে হয়ে গেল । হ্যানিম্যানের বয়স তখন ২৭ এবং হেনরিয়েটার ১৮ । বিয়ের পরের বছরেই তাঁদের প্রথম সন্তান জন্ম নিল ।
Hahnemann Biography
এই সময় হ্যানিম্যান রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন রচনা প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন । তাঁর প্রথম উল্লেকযোগ্য প্রবন্ধ, “কিভাবে ক্ষত এবং ঘা সারানো যায় সে বিষয়ে নির্দেশনামা ।” এই বই পড়লেই বোঝা যা তরুণ চিকিৎসক হ্যানিম্যান নিজের অধিগত বিষয়ে কতখানি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন । এই সময় থেকেই আরো গভীরভাবে পড়াশুনা এবং বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনা ও অনুবাদের কাজে আত্মনিয়োগ করেন ।
সে যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অন্য বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন না । কিন্তু হ্যানিম্যানের আগ্রহ ছিল বিভিন্ন বিষয়ে । বিশেষভাবে তিনি রসায়নের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন । ফরাসি ভাষা থেকে জার্মান ভাষায় একাধিক গ্রন্থ অনুবাদ করেন । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুই খণ্ডে Art of Manufacturing chemical products. এছাড়া দুই খণ্ডে Art of distilling Iiquors. রসায়নের ক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা সেই যুগে যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছিল । তাঁর লেখা On Arsenic poisoning ফরেনসিক গবেষণার ক্ষেত্রেও এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন ।
Hahnemann Biography
এই সময় তিনি ডাক্তার ওয়াগলার এর সাথে টাউন হাসপাতালে ডাক্তারি করতেন । হঠাৎ ডাক্তার ওয়াগলার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সমস্ত হাসপাতালের দায়িত্ব এসে পড়ল হ্যানিম্যানের উপর ।
পরের কয়েক বছর তিনি অজস্র বই অনুবাদ করেন এবং Mercurius Solubilis আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত হয়ে গেলেন । চিকিৎসক হিসাবে তখন তাঁর নাম যশ চারদিকে এতখানি ছড়িয়ে পড়েছিল যে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারতেন । মনের মধ্যে তখন নতুন কিছু উদ্ভাবনের স্বপ্ন ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল । তিনি অনুভব করতে পারছিলেন সমস্ত দিন হাসপাতালে কাটিয়ে মনের ইচ্ছা পূর্ণ করা সম্ভব হবে না । তাই হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য পুরোপুরি অনুবাদের কাজে হাত দিলেন ।
১৭৯১ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডাঃ কালেনের একটি বই এ্যালোপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকার ইংরাজি থেকে জার্মানী ভাষায় অনুবাদের কাজ হাতে নেন । এই বইয়ের একটি অধ্যায়ের Cinchona Bark পাদটীকায় লেখা ছিল ম্যালেরিয়া জ্বরের ঔষধ কুইনাইন যদি কোন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করা যায় তবে অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর শরীরে ম্যালেরিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাবে । কালেনের এই অভিমত হ্যানিম্যানের চিন্তার চিন্তাজগতে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করল ।
তিনি এর সত্যাসত্য পরীক্ষার জন্য নিজেই পতিদিন ৪ ড্রাম করে দু’বার সিষ্কোনার রস খেতে আরম্ভ করলেন । এর তিন-চারদিন পর সত্যি সত্যিই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলেন । এরপর পরিবারের প্রত্যেকের উপর এই পরীক্ষা করলেন এবং প্রতিবছরই একই ফলাফল পেলেন । এর থেকে তাঁর মনে প্রশ্ন জেগে উঠল, কুইনাইনের মধ্যে কি রোগের লক্ষণ এবং ঔষধের লক্ষণের সাদৃশ্য সৃষ্টিকারী কোন ক্ষমতা আছে ? অথবা অন্য সমস্ত ঐষধের মধ্যেই কি এই ক্ষমতা আছে ? অর্থাৎ যে ঐষধ খেলে মানুষের কোন রোগ নিরাময় হয়, সুস্থ দেহে সেই ঔষধ খেলে সেই রোগ সৃষ্টি হয় ।
Hahnemann Biography
এতদিন চিকিৎসকদের ধারণা ছিল বিরুদ্ধভাবাপন্নাতাই বিরুদ্ধভাবাপন্নকে আরোগ্য করে । অর্থাৎ মানুষের দেহে অসুস্থ অবস্থায় যে সব লক্ষণ প্রকাশ পায় তাঁর বিপরীত ক্রিয়াশক্তি সম্পন্ন ঔষধেই রোগ আরোগ্য হয় । এই প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে শুরু হল তাঁর গবেষণা ।
এই সময় তিনি যাযাবরের মত এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন । স্থায়ী কোন আস্তানা গড়ে তুলতে পারেননি । গোথার ডিউক মানসিক রোগের চিকিৎসালয় খোলার জন্য তাঁর বাগানবাড়িটি হ্যানিম্যানকে ছেড়ে দিলেন ১৭৯৩ সালে হ্যানিম্যান এখানে হাসপাতাল গড়ে তুললেন এবং একাধিক মানসিক রোগগ্রস্ত রুগীকে সুস্থ করে তোলেন । সেকালে মানসিক রুগীদের উপর কঠোর নির্যাতনকে চিকিৎসার প্রধান অঙ্গ বলে মনে করা হত । হ্যানিম্যান কঠোর ভাষায় এর নিন্দা করেন ।
কিছুদিন মানসিক হাসপাতালে থাকার পর তিনি আবার অন্য শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন । ইতিমধ্যে তাঁর আটটি সন্তানের জন্ম হয়েছে । সংসারে আর্থিক অনটন । কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর গবেষণার কাজে সমান্যতম বিঘ্ন ঘটেনি । একদিকে যেমন চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়াও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করতেন, তেমনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনে নিজেই বিভিন্ন ঔষধ খেতেন । এতে বহুবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তা সত্ত্বেও কখনো গবেষণার কাজ থেকে বিরত থাকেননি ।
Hahnemann Biography
দীর্ঘ ছয় বছরের অক্লান্ত গবেষণার পর তিনি সিদ্ধান্তে এলেন যথার্থই সাদৃশ্যকে সদৃশ আরোগ্য করে । (Similia similiabus curantur অর্থাৎ like cures likes)–এর ধারণা কোন অনুমান বা কল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত নয় । এ সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক সত্য ।
তাঁর এই Be cured. Similia-Similibus. এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আধুনিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ভিত্তি স্থাপন করলেন হ্যানিম্যান । সেই কারণে ১৭৯৬ সালকে বরা হয় হোমিওপ্যাথিক জন্মবর্ষ । হোমিওপ্যাথিক শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রীক শব্দ হোমস (Homoes) এবং প্যাথিস (Pathos) সদৃশ এর অর্থ রোগ লক্ষণের সম লক্ষণ বিশিষ্ট ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা । হ্যানিম্যানের এই যুগান্তকারী প্রবন্ধ প্রকাশের সাথে সাথে চিকিৎসা জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হল ।
প্রতিদিন ভোর ৬ টায় ঘুম থেকে উঠতেন । সকালের জলখাবার ছিল দু’কাপ দুধ । তারপর কিছুক্ষণ বাগানে পায়চারি করে চেম্বারে চলে যেতেন । দুপুরবেলায় বাড়ি ফিরে দুপুরের খাওয়া সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন । তাঁর এই বিশ্রামের সময়টুকু কড়া পাহারায় রাখতেন মেয়েরা । সামান্য সময় পেলেই চিঠিপত্র লেখার কাজ শুরু করে দিতেন । অল্প কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার রুগী দেখার কাজ । সন্ধ্যে অবধি চলত তাঁর রুগী দেখা । তারপর এককাপ গরম দুধ আর রাতের খাওয়া খেয়ে চলে যেতেন পড়ার ঘরে । মধ্যরাত, কোন কোন সময় শেষরাত অবধি চলত তাঁর রোগের বিবরণ লেখা, চিঠিপত্র লেখা, বই লেখা ।
Hahnemann Biography
অবশেষে ১৮১০ সালে প্রকাশিত হল অর্গানন অব মেডিসিন (Organon of Madicine) । এই অর্গাননকে বলা হয় হোমিওপ্যাথিক বাইবেল । এতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির নীতি ও বিধান সমূহের বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা হয়েছে । বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আর অকাট্য যুক্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন তাঁর প্রতিটি অভিমত । এতে হোমিওপ্যাথিক মূল নীতির আলোচনা ছাড়াও অন্যান্য চিকিৎসা প্রণালীর সাথে আলোচনা করে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন । এছাড়াও সে যুগে চিকিৎসার নামে যে ধরনের অমানুষিক কার্যকলাপ প্রচলিত ছিল তার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করলেন । আর্গাননের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে ।
এই বই প্রকাশের সাথে সাথে সমালোচনা আর বিতর্কের ঝড় বইতে থাকে । সকলকেই এই ধরনের অত্যাচার সইতে হয় । এই ব্যাপারে তিনি প্রথম ব্যক্তি নন, শেষ ব্যক্তিও নন । নিজের উপর তাঁর এতখানি আত্মবিশ্বাস ছিল তাই ১৮১৯ সালে যখন অর্গাননের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়, বইয়ের প্রথমে তিনি লিখলেন Aude sapere–এই অর্থ আমি নিজেকে বুদ্ধিমান বলে ঘোষণা করছি । এইভাবে তিনি তৎকালীন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তীব্র ব্যঙ্গ আর বিদ্র্রপে ফেটে পড়লেন । হ্যানিম্যানের জীবনকালে এর পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় । প্রতিটি সংস্করণেই তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত থেকে উন্নততর রূপে বর্ণনা করেছেন ।
Hahnemann Biography
১৮১০ সালে অর্গানন প্রকাশের সাথে সাথে হ্যানিম্যানের বিরুদ্ধে একাধিক রচনা প্রকাশিত হল । হ্যানিম্যানের ছয়জন ছাত্রের বিরুদ্ধে বেআইনি ঔষধ তৈরি ও বিতরণের অভিযোগ আনা হল একজন ছাত্রকে জেলে পোরা হল, তাঁর সমস্ত ঔষধ আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলা হল ।
লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক হ্যানিম্যানের চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে নিয়োগের সিন্ধান্ত নেয় কিন্তু অধ্যাপকদের একাংশ এই কাজে প্রবল বাঁধা সৃষ্টি করল । কিন্তু তাদের বাঁধাদান সত্ত্বেও হ্যানিম্যানকে বক্তৃতা দেবার জন্যে অনুমতি দেওয়া হল । তাঁর এই বক্তৃতা শোনবার জন্য দলে দলে ছাত্ররা এসে ভিড় করল । সকলেই হ্যানিম্যানের নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানতে উৎসাহী, কৌতূহলী । তখন হ্যানিম্যান প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় পৌঁছে গিয়েছেন, তবুও তরুণ অধ্যাপকদের মত তেজদীপ্ত বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে হোমিওপ্যাথিক তত্ত্বের বর্ণনা করতেন । কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে কেউই তাঁর অভিমতকে গ্রহণ করতে পারল না ।
Hahnemann Biography
কারণ তাদের মধ্যে প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে নতুন কিছুকে গ্রহণ করবার মত মানসিকতা সৃষ্টি হয়নি । তা সত্ত্বেও সামান্য কয়েকজন ছাত্রকে শিষ্য হিসাবে পেলেন যার উত্তরকালে তাঁর নব চিকিৎসা ব্যবস্থার ধার-বাহক হয়ে উঠেছিল । এই সময় ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন । তাদের মধ্যে বহু সংখ্যক সৈন্য টাইফয়েট রোগে আক্রান্ত হয়েছিল । কোন চিকিৎসাতেই তাদের রোগের প্রকোপ হ্রাস না পাওয়ায় হ্যানিম্যানকে চিকিৎসার জন্যে ডাকা হয় । তিনি বিরাট সংখক সৈন্যকে অল্পদিনের মধ্যেই সুস্থ কর তোলেন । এতে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ।
অষ্ট্রিয়ার যুবরাজ Schwarzenberg পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন । এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় কোন উপকার না পেয়ে হ্যানিম্যানের চিকিৎসা জগতে সুনামের কথা শুনে তাঁকে চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগ করলেন । হ্যানিম্যানের চিকিৎসায় অল্পদিনের মধ্যেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন । সামান্য সুস্থ হতেই হ্যানিম্যানের নির্দেশ অমান্য করে মদ্যপান করতে আরম্ভ করলেন । এতে হ্যানিম্যান ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেন এবং যুবরাজের চিকিৎসার জন্য আর তাঁর প্রসাদে গেলেন না । এর কয়েক সপ্তাহ পরেই যুবরাজ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন ।
এই ঘটনায় অস্ট্রিয়ানদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সঞ্চার হল । এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকরা এই সুযোগে হ্যানিম্যানের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় আক্রমণ শুরু করল এবং যুবরাজের মৃত্যুর জন্য সরাসরি হ্যানিম্যানকে দায়ী করল । জার্মান সরকার হ্যানিম্যানের ঔষধ তৈরির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল ।
Hahnemann Biography
১৮২০ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি হ্যানিম্যানকে আদালতে উপস্থিত হতে হল । আদালত তাঁর সমস্ত ঔষধ তৈরি এবং বিতরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল । কারণ হিসাবে বলা হল এই ঔষধ মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর । হ্যানিম্যান এর জবাবে শুধু বললেন, ভবিষ্যৎই এর সঠিক বিচার করবে ।
সম্মিলিতভাবে চিকিৎসকরা তাঁর বিরোধিতা করতে আরম্ভ করল । তাঁকে লিপজিগ থেকে বহিষ্কারের জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠল । হ্যানিম্যান বুঝতে পারলেন আর তাঁর পক্ষে লিপজিগে থাকা সম্ভব নয় । তিনি নিরুপায় হয়ে ১৮২১ সালের জুন মাসে লিপজিগ ত্যাগ করে কিথেন শহরে এসে বাসা করলেন ।
হ্যানিম্যানের জীবনের এই পর্যায়ে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ পালভাঙা নৌকার মত । সংসারে চরম অভাব । চারদিকে বিদ্বেষ আর ঘৃণা । প্রতি পদক্ষেপে মানুষের অসহযোগিতা আর বিরুদ্ধাচারণ ।
এই প্রতিকূলতার মধ্যেও হ্যানিম্যান ছিলেন অটল, নিজের সংকল্পে পর্বতের মত দৃঢ় । অসাধারণ ছিল তাঁর মহত্ত্বতা । যে চিকিৎসকরা নিয়ত তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করত তাদের বিরুদ্ধেও কখনো কোন ঘৃণা প্রকাশ করেননি । একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “চিকিৎসকরা আমার ভাই, তাদের কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই ।” আরেকটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “সত্যের বিরুদ্ধে এই নির্লজ্জ প্রচার মানুষের অজ্ঞাতারই প্রকাশ । এর দ্বারা হোমিওপ্যাথিক অগ্রগতি রোধ করা সম্ভব নয় ।”
Hahnemann Biography
হোমিওপ্যাথির এই দুর্দিনে হ্যানিম্যানের পাশে এসে দাঁড়ালেন কিথেন শহরের ডিউক ফার্দিনান্দ । তিনি কিথেন শহরে শুধু বাস করবার অনুমতি নয়, চিকিৎসা করবারও অনুমতি দিলেন । হ্যানিম্যান তাঁর ঔষধ প্রস্তুত ও চিকিৎসা করবার অনুমতির জন্য যখন ডিউকের কাছে আবেদন করলেন, সেই আবেদন পরীক্ষার ভার পড়ল আদম মূলারের উপর । হ্যানিম্যানের সাথে সাক্ষাতের অসাধারণ বিবরণ দিয়েছেন মূলার । “এই লাঞ্ছিত অপমানতি মানুষটিকে দেখে চোখে জল এসে গেল । এই মানুষটির দুঃখে আমার হৃদয় বেদনার্ত হয়ে উঠল । উপলব্দি করতে পারছিলাম আমার সামনে বসে আছে এই শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, ভবিষ্যৎ কালই যার আবিষ্কারের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারবে ।”
ডিউক ফার্দিনান্দও উপলব্দি করতে পেরেছিলেন হ্যানিম্যানের প্রতিভা । তিনি তাঁকে ঔষধ প্রস্তু করবার অনুমতি দিলেন । শুধু তাই নয়, তাঁকে রাজসভার চিকিৎসক হিসাবে মনোনীত করলেন ।
১৮৩০ সাল হ্যানিম্যানের স্ত্রী হেনরিয়েটা ৬৭ বছর বয়সে মারা গেলেন । তিনি ১১টি সন্তানের জননী । সমস্ত জীবন হ্যানিম্যানের পাশে ছিলেন তাঁর যোগ্য সহধর্মিণী । সমস্ত প্রতিকূলতার মাঝে হ্যানিম্যান যখন ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন সংসার জীবনে তখন অফুরন্ত শক্তিসাহস ভালবাসায় পূর্ণ করে দিয়েছিলেন হনরিয়েটা । হ্যানিম্যানের জীবনের অন্ধকারময় দিনগুলিতে হেনরিয়েটা ছিলেন তাঁর চলার সঙ্গী । হ্যানিম্যানের জীবনে যখন অন্ধকার দূর হয়ে আলোর আভা ফুটে উঠছিল, হেনরিয়েটা তখন চির অন্ধকারের জগতে হারিয়ে গেলেন ।
স্ত্রীর অভাব, কন্যাদের ভালবাসা আর যত্নে ভুলে গেলেন হ্যানিম্যান । হ্যানিম্যানের খ্যাতি প্রতিপত্তি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল । রোগী দেখে প্রচুর অর্থও উপার্জন করতেন । এই সময় হ্যানিম্যানের জীবনে এল নতুন বসন্ত । তিনি তখন ৮০ বছরের বৃদ্ধ ।
Hahnemann Biography
১৮৩৪ সালের ৮ অক্টোবর এক সুন্দরী যুবতী মাদাম মেলানি চর্মরোগের চিকিৎসার জন্য হ্যানিম্যানের কাছে এলেন । মেলানি ছিলেন ফ্রান্সের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিও তৎকালীন আইনমন্ত্রীর পালিত কন্যা । হ্যানিম্যানের সাথে সাক্ষাতের সময় তাঁর বয়স ৩৫ বছর । মেলানি ছিলেন শিল্পী কবি । বয়েসের বিরাট ব্যবধান বাঁধা হয়ে গেল । মেলানি হ্যানিম্যানকে ফ্রান্সে নিয়ে গেলেন । সরকারিভাবে তাঁকে ডাক্তারি করবার অনুমতি দেওয়া হল । জীবনের অন্তিমপর্বে এসে হ্যানিম্যান পেলেন জীবনব্যাপী সংগ্রামের পুরস্কার খ্যাতি, সম্মান, যশ, সুনাম, আরাম, অর্থ, সাংসারিক সুখ ।
ক্রমশেই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল । হ্যানিম্যানের জীবনকালেই ছয়টি হোমেওপ্যাথিক কলেজ গড়ে উঠেছিল । তাঁর কয়েকজন ছাত্র প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক হিসাবে সুনাম অর্জন করলেন । ৮৮ বছরে পা দিরেন হ্যানিম্যান । দেহের শক্তি কমে এসেছিল । কিন্তু মনের শক্তি একটুকু হ্রাস পায়নি । সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, অবশেষে ১৮৪৩ সালে ২ জুলাই শেষরাতে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন হোমিওপ্যাথিক জনক মহাত্মা হ্যানিম্যান ।
সমস্ত জীবন হ্যানিম্যান নিজেকে মানব কল্যানে উৎসর্গ করেছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষকে ব্যাধির অভিশাপ থেকে মুক্ত করাই একজন চিকিৎসকের মহত্তম কর্তব্য । সেই কর্তব্য পথ থেকে কখনো তিনি নিজেকে বিচ্যুত করেননি । ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সরল সাদাসিধা । কোন আড়ম্বর বিলাসিতা ছিল না তাঁর । তিনি বলতেন প্রকৃত মানপ্রেমী কখনো নিজেকে প্রচার করে না । যদি অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয় তোমার পথই শ্রেষ্ঠ তবে তা মানব কল্যানে নিয়োজিত কর আর সব খ্যাতি অর্পণ কর ঈশ্বরকে ।
Hahnemann Biography
তিনি বিশ্বাস করতেন সব কল্যাণ সৎ মহত্ত্বতার মধ্যে ঈশ্বরের স্পর্শ আছে । তিনি জীবনের বৃহত্তর অংশ অতিবাহিত করেছেন অন্যের নিন্দা সমালোচনা শুনে, প্রতি পদক্ষেপে তাঁকে সইতে হয়েছে নির্যাতন, অপবাদ, মানুষ তাঁকে বারংবার ঘরছাড়া করেছে । সমস্ত জীবনে তিনি ৩৬ বার বাসা পরিবর্তন করেছেন । এমন বহু দিন গিয়েছে, জল ছাড়া কোন খাবার জোটেনি । সাবানের অভাবে আলু দিয়ে জামা-কাপড় পরিষ্কার করেছেন ।
কনকনে শীতের রাতে ঘরে আগুন জ্বালাবার মত একটুকরা কাঠ পাননি । একটা পাউরুটি দশ টুকরো করে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিতরণ করেছেন তবুও তিনি কখনো ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারাননি । মৃত্যুশয্যায় স্ত্রীকে বলেছেন, আমি মানুষের জন্য যা কিছু করেছি সব ঈশ্বরের করুণা আর শক্তিতে । তাই সব কিছুর জন্যেই আমি তাঁর কাছে ঋণী ।
এই ঈশ্বর বিশ্বাসের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল তাঁর গভীর আত্মবিশ্বাস । তাই মৃত্যুর পূর্বে নিজের সম্বন্ধে শেষ বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, আমার জীবন ব্যর্থ হয়নি ।
যথার্থই তাঁর জীবন ছিল পরিপূর্ণ সফলতা আর পূর্ণতার । সেই কারণেই তাঁর শিষ্য ব্রেডফোর্ড গুরুর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে লিখেছিলেন, তিনি ছিলেন এমন একজন বিদ্বান যাকে বিদগ্ধ জগৎ সমাদৃত করেছে । এমন একজন রসায়নবিদ যিনি রসায়ন বিশেষজ্ঞদের শিক্ষা দিতেন । বহু ভাষায় এমন এক পণ্ডিত যার অভিমতকে ভাষাতত্ত্ববিদরা খণ্ডন করতে সাহস পেত না । একজন দার্শনিক যার দৃঢ় মতবাদ থেকে কেউ বিচ্যুত করতে পারেনি ।