তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১) হুমায়ূন আহমেদ

তিথির নীল তোয়ালে

এই পৃথিবীর মধ্যে ছিলঅনন্ত এক শীতলপাটিঅনেক দাঙ্গা ঝগড়াঝাটি পার হয়ে তাই ভালােবাসা জাগিয়েছিল অনেক আশা, ফুটিয়েছিল অজস্র রং খানিকটা তার গদ্যে এবং খানিকটা তার পদ্যে ছিল। 

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী 

মেজাজ খারাপ করার মত পরপর কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেছে

জাফর সাহেবের প্রেসারের সমস্যা আছেমেজাজ খারাপ হলে প্রেসার দ্রুত ওঠানামা করেচট করে মাথা ধরে যায়ঘাড় ব্যথা করতে থাকে এবং মুখে থুথু জমতে থাকে এর কোনটিই ভাল লক্ষণ নয়পঞ্চাশ পার হবার পর লক্ষণ বিচার করে চলতে হয়তাঁর বয়স পাঁচপঞ্চাশতিনি লক্ষণ বিচার করে চলার মনে প্রাণে চেষ্টা করেনচেষ্টা করেন কিছুতেই যেন মেজাজ না বিগড়ে যায়এটা প্রায় কখনােই সম্ভব হয় না। 

অফিস থেকে ফেরার পর তিনটা ঘটনা ঘটল মেজাজ খারাপ করার মতইলেকট্রিসিটি থাকায় লিফট বন্ধ ছিলআটতলা পর্যন্ত হেঁটে উঠার পর কারেন্ট চলে এললিফট ওঠা নামা শুরু করল। 

পত্রিকা চেয়েছিলেন, সকাল বেলা তাড়াহুড়ায় ভালমত পড়া হয়নিতাঁকে ভেতরের একটা পাতা দেয়া হল, বাইরের পাতাটা না-কি পাওয়া যাচ্ছে না। 

এক কাপ চা চাইলেন, তিথি এক কাপ চা দিয়ে গেলচুমুক দিতে গিয়ে দেখেন সর ভাসছেতিনি বললেন, সর ভাসছে কেন? | তিথি বলল, সর চায়ের চেয়ে হালকা বলেই ভাসছেযদি ভারী হত তাহলে 

ডুবে যেতবলেই সে হেসে ফেললজাফর সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, রসিকতা করছিস কেন

রসিকতা করছি না বাবাএকটা বৈজ্ঞানিক সত্য ব্যাখ্যা করলাম| কঠিন ধমক দিতে গিয়েও জাফর সাহেব নিজেকে সামলে নিলেনমেজাজ ঠিক রাখতে হবেকিছুতেই মেজাজ খারাপ হতে দেয়া যাবে নামেজাজের জন্যে শুধু তাঁর নিজেরই যে সমস্যা হচ্ছে তাই না, পারিবারিক সমস্যাও হচ্ছেগত চারদিন ধরে এই ফ্ল্যাট বাড়িতে শুধু তিথি এবং তিনি আছেনতাঁর স্ত্রী শায়লা ছােট দুই মেয়ে ইরা, মীরাকে নিয়ে পল্লবীতে তাঁর মায়ের বাসায় চলে গেছেন। যাবার আগে কঠিন গলায় বলেছেন, তুমি তােমার মেজাজ নিয়ে থাকআমি চললাম।। 

জাফর সাহেব বলেছেন, যেতে ইচ্ছে হলে যাবেতবে তুমি যদি মনে কর আমি তােমাকে সাধাসাধি করে নিয়ে আসব তাহলে বিরাট ভুল করবেজীবনে অনেক সাধাসাধি করেছিআর নয়তােমার ব্যাপারে আমি হাত ধুয়ে ফেলেছি। 

ছােট মেয়ে দুটিও যে মার সঙ্গে চলে যাবে তিনি ভাবেন নিতিনি সারাজীবন শুনে এসেছেন মেয়েরা পিতৃভক্ত হয়শুধু তাঁর বাড়িতেই উল্টো নিয়মদুই মেয়ে সুরসুর করে মাসঙ্গে চলে গেলতাও যদি স্কুলে পড়া বাচ্চা মেয়ে হত একটা কথা ছিলএকটা আই এসসি, দিয়েছে, অন্যটা আই পড়ে, সেকেণ্ড ইয়ারবড় মেয়ে তিথিও হয়ত চলে যেতনেহায়েত হিউমেনিটেরিয়ান গ্রাউড়ে যায় নিইরা মীরা খুব ভাল করে জানে তিনি এদের না দেখলে অস্থির বােধ করেনসবাইকে এক সঙ্গে না নিয়ে বসলে খেতে পারেন নামেজাজ খুব খারাপ হয়ে যায়কাকে কখন কি বলছেন খেয়াল থাকে না| শায়লা চলে যাবার পরদিন কাজের মেয়ে রাশেদা তার টিনের ট্রাংক এবং পুটলাপুটলি নিয়ে বিদেয় হয়ে গেলযাবার সময় বলল, ভূল তুরুটি কিছু হইলে নিজ গুণে ক্ষমা দিবেন” 

জাফর সাহেব বললেন, বেতন পাওনা আছে না? বেতন নিয়ে যাওআমার বেতনের দরকার নাই। 

শেষ মুহূর্তে জাফর সাহেব আপােষের সুর বের করলেনরাশেদা চলে গেলে ভয়াবহ সমস্যা হবেতিথি সামান্য এক কাপ চা পর্যন্ত ঠিকমত বানাতে পারে নারান্নার প্রশ্নই আসে নাঢাকা শহরে ভাল কাজের লােক পাওয়া পরশ পাথর পাবার মতজাফর সাহেব রাশেদার দিকে তাকিয়ে প্রায় মধুর গলায় বললেন, চলে যাচ্ছিকেন তাই তো বুঝলাম নাতােমাকে তেমন কিছু বলা হয়নিরাশিদা বলল, আমি মিজাজের ধার ধারি নাযে বাড়িত আমারে ইংরেজি গাইল দেয় হেই বাড়িত কাম করি না। 

ইংরেজি গালির ব্যাপারটা সত্যজাফর সাহেব রাশেদাকে স্টুপিড ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার বলেছেন। এবং তিনি মনে করেন তাঁর জায়গায় অন্য যে কেউ এরচেকঠিন গালি দিততিনি অফিস থেকে এসে স্যান্ডেল চাইলেনরাশেদা স্যান্ডেল দিল ঠিকই, কিন্তু দুটা দুপাটিরতিনি কিছু বললেন নাচা চাইলেনচা এনে দিলচুমুক দিয়ে দেখেন মিষ্টি হয়নিতিনি বললেন, রাশেদা, চিনি লাগবেসে রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল, চিনি দেওয়া আছে, লাড়া দেননাড়া দিতে চামচ লাগবেতিনি চামচ চাইলেন, রাশেদা একটা তরকারির চামচ নিয়ে উপস্থিত হলচামচ দেখেই তাঁর মেজাজ খারাপ হল, তবু তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, এই চামচ চায়ের কাপে ঢুকবে

রাশেদা চামচ উল্টে পেছনটা দিয়ে ভাল ঘোঁটার মত তাঁর চায়ের কাপ ফুঁটে দিলশুধু তখনি তিনি বললেন, স্টুপিড, ব্রেইনলেস ক্রিয়েচারঅবশ্যি কঠিন গলায় বললেনমিষ্টি করে কাউকে স্টুপিড বলা যায় নাসেই বলটাই কাল হয়েছে। 

জাফর সাহেব মেজাজ আয়ত্তে রাখার চেষ্টা অনেকদিন থেকেই করছেনপারছেন নাসবাই সবকিছু পারে না, চেষ্টাও করে নাতিনি চেষ্টা করছেনসেই চেষ্টা কারাের চোখে পড়ছে নাদুশ তেত্রিশ টাকা দিয়ে বই কিনে এনেছেন Self control. সাতশপৃষ্ঠার বইসেখানে নেই, এমন জিনিস নেইএকটা অংশ আছে Yoga. সেই অংশে বলা হয়েছে প্রতি রাতে শােবার আগে পাঁচ মিনিট শবাসন করলে নিজের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপিত হবে। 

শবাসনের নিয়ম হল শক্ত মেঝেতে খালি গায়ে গায়ে কোন রকম কাপড়ই থাকতে পারবে না, অবাসও নয়) শুয়ে থাকতে হবেচোখ বন্ধ করে নিজেকে ভাবতে হবে একজন মৃত মানুষতাঁর দেহটা একটা মৃত মানুষের দেহএই দেহের কোন অনুভূতি নেইবিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে এই দেহের কোন যোগ নেই। 

পাঁচপঞ্চাশ বছর বয়সে নেংটো হয়ে মেঝেতে শুয়ে থাকার কল্পনাই ভয়াবহতিনি এই ভয়াবহ ব্যাপারটাও করলেনদরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে মেঝেতে শুয়ে রইলেনপুরােপুরি নগ্ন হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হল নাতিনি কোমরে একটা টাওয়েল জড়িয়ে রাখলেনলাভের মধ্যে লাভ এই হল, তাঁর ঠাণ্ডা লেগে গেল। কাশি, সর্দিটনসিল ফুলে একাকারটোক গিলতে পারেন না। 

মানুষের কত সমস্যা থাকেতাঁর একটিই সমস্যা। মেজাজ সমস্যাকেউ তা সহজভাবে নিতে পারে না। মানুষের অসংখ্য সৎগুণের কিছু কিছু তাঁরও নিশ্চয়ই আছেসেসব কেউ দেখবে না। 

শায়লা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলচারদিনে একবার টেলিফোন পর্যন্ত করেনিমেয়ে দুটিও নারাশেদা চলে গেছে জানার পর তার কি উচিত ছিল না বাসায় ফিরে আসা

এই যে তিথি সরভর্তি এক কাপ চা তাঁর হাতে দিল, চাপা হাসি হাসতে হাসতে বৈজ্ঞানিক সত্য ব্যাখ্যা করতে লাগল, তার কি উচিত ছিল না, বলা বাবা, কাপটা আমার কাছে দাওআমি আরেক কাপ বানিয়ে নিয়ে আসছিএমন না যে সে পরীক্ষার চাপে ব্যতিব্যস্ততার এমএসসি, ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছেসেরেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা করছেঅপেক্ষার এই সময়টা সে তাে রান্নাবান্না শেখার চেষ্টাও করতে পারেএকদিন বিয়ে হবে, নিজের সংসার শুরু করবেএই যুগের মেয়েরা শুধু লেখাপড়া শিখবে, রান্নাবান্না শিখবে না? সামান্য এক কাপ চাবানাতে পারবে নাতা তাে হয় নাসরভর্তি চা হাতে নিয়ে জাফর সাহেব বসে রইলেন। 

অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল বাজছেরাশেদা নেই যে কলিংবেল শুনে দরজা খুলে দেবেতিথি কি করছে? সেকি তার নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে? তাঁর ইচ্ছা করছে কড়া গলায় ডাকেন তিথি

ডাকার আগেই তিথি উপস্থিত হলহাতে চায়ের কাপবাবা, নাও এবার চায়ে কোন সর নেই হেঁকে এনেছি। 

জাফর সাহেব যন্ত্রের মত চায়ের কাপ নিতে নিতে বললেন, কলিংবেল বাজছেদরজা খােলা হয়েছে, বাবাকে এসেছে? অচেনা একজনযে এসেছে সে ড্রয়িং রুমে বসেছে| জাফর সাহেব চায়ের কাপ হাতে উঠতে গেলেনতিথি হাত ধরে বাবাকে বসিয়ে দিলনরম গলায় বলল, চা শেষ করে তারপর যাবেতার আগে না। 

যে এসেছে, আমার ধারণা, তাকে দেখে তােমার মেজাজ আরাে খারাপ হবেমাঝখান থেকে তােমার চা খাওয়া হবে নাচায়ে কি চিনি হয়েছে

চায়ের টেম্পারেচর ঠিক আছে? বেশি ঠাণ্ডা কিংবা বেশি গরম হয়নি তাে?নাঠিকই আছে। 

তিথি বাবার সামনে মােড়া পেতে বসলজাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন, মেয়েকে কেমন জানি অচেনা অচেনা লাগছেচুল টুল কেটেছে, কিংবা কোন একটা কায়দা করেছেরাস্তার মােড়ে মােড়ে মেয়েদের চুল কাটার দোকান হওয়ায় এই এক বিপদ হয়েছেনাপিতের কাছে ছেলেরা যাবেমেয়েরা কেন যাবে? কি হচ্ছে দেশটার

জাফর সাহেব বললেন, তোকে এমন লাগছে কেন?কেমন লাগছে? | কি রকম যেন লাগছে ! চুল কেটেছিস?” 

না, কানে দুল পরেছি‘ 

জাফর সাহেব মেয়ের কানের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেনহাতের চুড়ির চেয়ে বড় দুটা রিং, মাঝারি সাইজের হাতীর কানের জন্যে মানানসই হত মানুষের কানের জন্যে নাসুস্থ মাথার কেউ এই দুল কানে পরে? এই ফ্যাশন কবে চালু হল

সুন্দর লাগছে না, বাবা?” 

জাফর সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, এগুলির নাম কি

আলাদা কোন নাম নেইআমি নাম দিয়েছি পাংকু রিং, পাংকু মেয়েদের রিংপাংকু মেয়ে মানে কি? তুমি বুঝবে নাতােমার চা খাওয়া কি শেষ হয়েছে?” 

তাহলে তুমি বসার ঘরে যাওযে বসে আছে তাকে দ্রুত বিদেয় করে আসতবে ফর গডস সেক, রাগারাগি করবে না। 

রাগারাগি করব কেন?” 

‘রাগারাগি করবে কারণ ভদ্রলােক কাদামাখা জুতা পায়ে কার্পেটে হাঁটাহাঁটি করছেনতােমার কাছে হয়ত অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু তাঁর হাতে চারটা মুরগিমুরগিগুলি তিনি কার্পেটে শুইয়ে রেখেছেনআমার মনে হয় তারা ইতিমধ্যে কার্পেট নােংরা করে ফেলেছেকারণ মুরগিগুলিতাে আর জানে না আমরা নতুন কাপেট কিনেছি” 

ঠাট্টা করছিস?” ……মােটেই ঠাট্টা করছি নাসত্যি কথা বলছিতােমার যা মেজাজ, ঠাট্টা করেবিপদে পড়তে চাই না। ……….সত্যি কার্পেটে মুরগি শুইয়ে রেখেছে ? …..তুই বলতে পারলি না যে কার্পেট মুরগির বিছানা না

আমি বলতে পারিনি, কারণ আমি অতি ভদ্র একজন তরুণীকাউকে অপ্রস্তুত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়তাছাড়া ভদ্রলোক কেমন মুখ কাচুমাচু করে বসে আছে, দেখে মায়াই লাগলাে। 

জাফর সাহেব গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালেনতিথি বলল, প্লীজ বাবা, মেজাজ খারাপ করবে নাগ্রাম থেকে এসেছে, বােকাসােকা মানুষ ...। 

তিথি মিথ্যা বলেনিসত্যি সত্যি কার্পেটের এক কোণায় চারটা মুরগি, দড়ি দিয়ে পা বাঁধাতারা ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রয়িং রুমের সৌন্দর্য দেখছেধুলোমাখা জুতাে পায়ে রােগ ধরনের একটা ছেলে বসে আছেকার্পেট মাত্র গত সপ্তাহে কেনা হয়েছেজুট কাপেট না কিনে তিনি প্রায় চারগুণ দাম দিয়ে সিনথেটিক শ্যাগ কাপেট কিনেছেনসেখানে কেউ যদি কাদা মাখা জুতা পায়ে সােফায় বসে থাকে, কেমন। 

লাগে

জাফর সাহেব রুক্ষ গলায় বললেন, কি ব্যাপার

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *