গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

গৌতম বুদ্ধ

গৌতম বুদ্ধ [খ্রিঃ পূঃ ৫৬৩-৪৮৩]

প্রাচীন ভারতে বর্তমান নেপালের অন্তর্গত হিমালয়ের পাদদেশে ছিল কোমল রাজ্য । রাজ্যের রাজধানী কপিলাবস্তু। কোশলের অধিপতি ছিলেন শাক্যবংশের রাজা শুদ্ধোধন । শুদ্ধোধনের সুখের সংসারে একটি মাত্র অভাব ছিল । তাঁর কোন পুত্রসন্তান ছিল না । বিবাহের দীর্ঘদিন পর গর্ভবতী হলেন জ্যেষ্ঠা রানী মায়াদেবী । সে কালের প্রচলিত রীতি অনুসারে সন্তান জন্মাবার সময় পিতৃগৃহে যাত্রা করলেন মায়াদেবী । 

পথে লুম্বিনী উদ্যান । সেখানে এসে পৌছতেই প্রসব বেদনা উঠল রানীর । যাত্রা স্থগিত রেখে বাগানেই আশ্রয় নিলেন সকলে । সেই উদ্যানেই জন্ম হল বুদ্ধের । যিনি সমস্ত মানবের কল্যানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, তিনি রাজার পুত্র হয়েও কোন রাজপ্রসাদে জন্মগ্রহণ করলেন না, মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে নীল আকাশের নীচে আবির্ভূত হলেন । পুত্র জন্মাবার কয়েক  দিন পরেই মারা গেলেন মায়াদেবী । শিশুপুত্রের সব ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন খালা মাহাপ্রজাপতি ।

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

শিশুপুত্রের নাম রাখা হল সিদ্ধার্থ । রাজা শুদ্ধোধন জ্যোতিষীদের আদেশ দিলেন শিশুর ভাগ্য গণনা করতে । তাঁরা সিদ্ধার্থের ভাগ্য গণনা করে বললেন, এই শিশু একদিন পৃথিবীর রাজা হবেন । যে দিন এ জরাজীর্ণ বৃদ্ধ মানুষ, রোগগ্রস্থ মানুষ, মৃতদেহ এবং সন্ন্যাসীর দর্শন পাবে সেই দিনই সংসারের সকল মায়া পরিত্যাগ করে গৃহত্যাগ করবে । চিন্তিত হয়ে পড়লেন শুদ্ধোধন । মন্ত্রীরা পরামর্শ দিলেন এই শিশুকে সুখ, বৈভব আর বিলাসিতার স্রোতে ভাসিয়ে দিন, তাহলে এ আর কোনদিন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী হবে না । 

স্বতন্ত্র প্রাসদেই স্থান হল রাজপুত্র সিদ্ধার্থের । সেখানে কোন জরা ব্যাধি মৃত্যুর প্রবেশ করার অধিকার নেই । ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠলেন সিদ্ধার্থ । যৌবনে পা দিতেই রাজা শুদ্ধোধন তাঁর বিবাহের আয়োজন করলেন । সম্ভ্রন্ত বংশীয় সুন্দরী কিশোরী যশোধরার সাথে বিবাহ হল সিদ্ধার্থের । 

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

বিবাহের পর কিছু দিন আনন্দ উৎসবে মেতে রইলেন সিদ্ধার্থ । যথাসময়ে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হল । তাঁর নাম রাখা হল রাহুল । সন্তানের জন্মের পর থেকেই পরিবর্তন শুরু হল সিদ্ধার্থের । একদিন পথে বের হয়েছেন এমন সময় তাঁর চোখে পড়ল এক বৃদ্ধ । অস্থিচর্মসার, মাথার সব চুলগুলো পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে । মুখে একটিও দাঁত নেই । গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে । লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছিল । বৃদ্ধকে দেখামাত্রই রথ থামালেন সিদ্ধার্থ । তাঁর সমস্ত মন বিচলিত হয়ে পড়ল মানুষের একি ভয়ঙ্কর রূপ ? 

ভারাক্রান্ত মনে প্রাসাদে ফিরে গেলেন সিদ্ধার্থ । কয়েক দিন পর হঠাৎ সিদ্ধার্থের চোখে পড়ল একটি গাছের তলায় শুয়ে আছে একজন মানুষ । অসুস্থ রোগগ্রস্থ, যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে ।

বিমর্ষ হয়ে পড়লেন সিদ্ধার্থ । তাহলে তো যৌবনেও সুখ নেই । যেকোন মুহূর্তে ব্যাধি এসে সব সুখ কেড়ে নেবে । কিছু দিন পর সিদ্ধার্থের চোখে পড়ল রাজপথ দিয়ে চলেছে এক শবযাত্রা । জীবনে এই প্রথম মৃতদেহ দেখলেন । প্রিয়জনদেন কান্নায় চারদিক মুখর হয়ে উঠেছে । বিস্মিত হলেন সিদ্ধার্থ, কিসের এই কান্না ? সারথী চন্ন বলল, প্রত্যেক মানুষের জীবনের পরিণতি এই মৃত্যু । মৃত্যুই জীবনের শেষ তাই প্রিয়জনকে চিরদিনের জন্য হারাবার বেদনায় সকলে কাঁদছে ।

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

আনমনা হয়ে গেলেন সিদ্ধার্থ । এক জিজ্ঞাসা জেগে উঠল তাঁর মনের মধ্যে । মৃত্যুই যদি জীবনের অন্তিম পরিণতি হয় তবে জীবনের সার্থকতা কোথায় ? রাজপ্রসাদের সুখ ঐশ্বর্য বিলাস সব তুচ্ছ হয়ে গেল সিদ্ধর্থের কাছে । প্রতি মুহূর্তে মনে হল এই জরা ব্যধি মৃত্যুর হাত থেকে কে তাঁকে মুক্তির সন্ধান দেবে ? আকস্মাৎ দেখা হল এক সন্ন্যাসীর সাথে । সিদ্ধার্থ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন আপনি এই সন্ন্যাস গ্রহণ করেছেন ? 

সন্ন্যাসী বললেন, আমি জেনেছি সংসারের সব কিছুই অনিত্য । জরা, ব্যাধি, মৃত্যু যেকোন মুহূর্তে জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে । তাই আমি যা কিছু অবিনশ্বর চিরন্তন তারই সন্ধানে বের হয়েছি । আমার কাছে সুখী-দুঃখী, জীবন-মৃত্যু সব এক হয়ে গিয়েছে । সিদ্ধার্থ সকরের কাজে থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলেন । দিবারাত্রি চিন্তার মধ্যে হারিয়ে গেলেন । সকলের অগোচরে গভীর রাতে নিজের কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এলেন সিদ্ধার্থ ।

পেছনে পড়ে রইল স্ত্রী যশোধরা, পুত্র রাহুল, পিতা শুদ্ধোধন, মহাপ্রজাপতি । অশ্বশালায় ঘুমিয়ে ছিল সারথী চন্ন । তাঁকে ডেকে তুললেন সিদ্ধার্থ । সিদ্ধার্থকে রথে নিয়ে চললেন চন্ন । নগরের সীমানা পার হয়ে, জনপদ গ্রাম পার হয়ে রাজ্যের সীমানায় এসে দাঁড়ালেন । এবার সারথী চন্নকে বিদায় দিতে হবে । নিজের সমস্ত অলংকার রাজবেশ খুলে উপহার দিলেন চন্নকে । তারপর বললেন, তুমি পিতাকে বলো আমি যদি কোনদিন জরা ব্যধি মৃত্যুকে জয় করতে পারি তবে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসব । আমি মানুষকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে আলোর পথ দেখাতে চাই। 

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

চলতে চলতে অবশেষে সিদ্ধার্থ এসে পৌছলেন রাজগৃহ । তখন রাজগৃহ ছিল কোথাও কোন জনমানব নেই, চারদিক নির্জন, শুধু পাখির কুজন আর বয়ে চলা বাতাসের শব্দ । ভাল লেগে গেলো সিদ্ধার্থের । তিনি স্থির করলেন এখানেই বিশ্রাম গ্রহণ করবেন । ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল পাহাড়ের ছোট ছোট গুহায় ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন সব সাধুরা । একটি গুহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন সিদ্ধার্থ । সেই গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন আলাড়া নামে এক সাধু । ‍সিদ্ধার্থ গুহার অদূরে বসলেন ।

আলাড়ার ধ্যান ভঙ্গ হতেই সিদ্ধার্থ তাঁর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয়, গৃহত্যাগের কারণ বর্ণনা করে বললেন, আমি মুক্তির পথের সন্ধান করছি । আপনি আমাকে বলে দিন কোন পথ ধরে অগ্রসর হলে আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব । সেখানেই রয়ে গেলেন সিদ্ধার্থ । একটি গুহায় তিনি বাসস্থান করে নিলেন । সমস্ত দিন ধ্যান বেদপাঠ শাস্ত্রচর্চার মধ্যে অতিবাহিত হত । 

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

দিন কেটে যায় । গুরু আলাড়ার কাছে শিক্ষা পেয়ে অনেক কিছু জ্ঞানলাভ করেছেন সিদ্ধার্থ কিন্তু তাঁর অন্তরে যেন অতৃপ্তি রয়ে যায় । নতুন গুরুর সন্ধানে বের হলেন সিদ্ধার্থ । এবার এলেন উদ্দাক নামে এক সাধুর সান্নিধ্যে । দীক্ষা নিলেন তাঁর কাছে । সেই একই উপলব্ধি করতে পারলেন যে জ্ঞান, পরম সত্যের অন্বেষণ তিনি করছেন, কোন সাধুই তাঁর সন্ধান জানেন না । 

হতাশায় ভেঙে পড়লেন তিনি । তিনি অনুভব করলেন তাঁর পথের সন্ধান অপর কেউ তাঁকে দিতে পারবে না । অন্ধকারের মধ্যে তাঁকেই খুঁজে বার করতে হবে আলোর দিশা । ঘুরতে ঘুরতে এসে উপস্থিত হলেন উরুবেলা নামে এক নগর প্রান্তে । যেখানে পাঁচজন সাধু বহুদিন তপস্যা করছিলেন । সিদ্ধার্থের আসার উদ্দেশ্য শুনে তাঁরা বলল, তুমি তপস্যা কর ।

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

সিদ্ধার্থ জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন করে আমি তপস্যা করব ? দিন-রাত্রি একই আসনে বসে ধ্যান করে চলেন । এত আত্মনিগ্রহ করেও যে প্রজ্ঞা জ্ঞানের সন্ধান করছিলেন তার কোন দিশা পেলেন না সিদ্ধার্থ । মনে হল যাকে তিনি উপলব্ধি করতে চাইছিলেন, সে পরম সত্য যেন ধরা দিতে গিয়েও দূরে সরে যাচ্ছে ।

সিদ্ধার্থ স্থির করলেন আর আত্মনিগ্রহের পথে তিনি অগ্রসর হবেন না । কাছেই এক গ্রামে ছিল একটি মেয়ে, নাম ‍সুজতা । ধর্মপ্রাণা ভক্তিমতী । প্রতি বছর সে মনের কামনা পূরণের আশায় বৃক্ষ দেবতার কাছে পূজা দিত । বুদ্ধ চলতে চলতে এসে পৌঁছলেন সেই পাঁচ সাধুর পৌঁছলেন সেই পাঁচ সাধুর কাছে । তাঁরা সকলেই কঠোর সাধনায় নিমগ্ন হয়েছে । বুদ্ধকে দেখামাত্রই তাঁরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ল । বুদ্ধ তাঁদের সামনে গিয়ে বললেন, তোমরা এই আত্ননিগ্রহের পথ ত্যাগ কর ।

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

এই কৃচ্ছসাধনাও যেমন প্রজ্ঞা লাভের প্রতিবন্ধক তেমনি ভোগসুখ বিলাসের মধ্যেও সত্যকে জানা যায় না । ধীরে ধীরে পাঁচজন সাধুর মন থেকে সংশয় দূর হয়ে গেল । তাঁরা উপলব্ধি করল তথাগত বুদ্ধই তাদের জীবনে আলোর দিশারী হয়ে এসেছেন । বুদ্ধ তাদের একে একে  ধর্মের উপদেশ দিতে লাগলেন । তাঁর উপদেশ শোনবার পর পাঁচজন সাধু বলল, আপনি আমাদের দীক্ষা দেন, আজ থেকে আমরা আপনার শিষ্য হব । বুদ্ধ তাদের দীক্ষা দিয়ে শিষ্য হিসেবে বরণ করে নিলেন । দেখতে দেখতে অল্প দিনের মধ্যেই বুদ্ধের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল ।

প্রাচীন ভারতে বৈদিক ধর্মে মূর্তিপূজা না থাকলেও ছিল যাগযজ্ঞ আচার-অনুষ্ঠনের বাড়াবাড়ি । ব্রাহ্মণরা ছিল সমাজের সবকিছুর চালক । বুদ্ধের ধর্মের মধ্যে ছিল মানুষের প্রতি ভালবাসা করুণা প্রেম । তাই মানুষ সহজেই তাঁর ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন ।

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

এতদিন পুরোহিত ব্রাহ্মণরা মানুষকে বলত একমাত্র তারাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে । বুদ্ধ বললেন, অন্য কেউ তোমাদের মুক্তি দিতে পারবে না । তোমাদের জীবনচর্চার মধ্যেই আছে তোমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ । মনুষ নিজেই যেমন তাঁর দুঃখকে সৃষ্টি করে তেমনি নিজের চেষ্টার মধ্যে দিয়েই সব দুঃখ থেকে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে পারে । তুমি সৎ জীবন যাপন কর, পবিত্র আচরণ কর । অন্তরকে শুদ্ধ কর, উদার কর । সেখানে যেন কোন কলুষতা না স্পর্শ করতে পারে ।

দলে দলে মানুষ আসতে আরম্ভ করল তাঁর কাছে । তিনি তাদের কাছে বললেন, অষ্টমার্গের কথা । 

প্রথম হচ্ছে সত্য বোধ –অর্থাৎ মন থেকে সকল ভ্রান্তি দূর করতে হবে । উপলব্ধি করতে হবে নিত্যও অনিত্য বস্তুর মধ্যে প্রভেদ । দ্বিতীয় হচ্ছে সংকল্প- সংসারের পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হবার আকাঙ্খা ।যা কিছু পরম জ্ঞান তাকে উপলব্ধি করার জন্য থাকবে গভীর আত্মসংযমের পথ ধরে এগিয়ে চলা । তৃতীয়- সমাক্য বা সত্য বাক্য । কোন মানুষের সাথেই যেন মিথ্যা না করে সৎ জীবন যাপন করা । সমস্ত কাজের মধ্যেই যেন থাকে সংযম আর শৃঙ্খলা ।

এছাড়া অন্য মানুষের প্রতি আচরণে থাকবে দয়া ভালবাসা । পঞ্চম- হল সত্য জীবন বা সম্যক জীবিকা অর্থাৎ সৎভাবে অর্থ উপার্জন করতে হবে এবং জীবন ধারণের প্রয়োজনে এমন পথ অবলম্বন করতে হবে যাতে রক্ষা পাবে পবিত্রতা ও সততা । ষষ্ঠ- সৎ চেষ্টা মন থেকে সকল রকম অশুভ ও অসৎ চিন্তা দূর করতে হবে । যদি কেউ আগের পাঁচটি পথ অনুসরণ করে তবে তাঁর কর্ম ও চিন্তা স্বাভাবিকভাবেই সংযত হয়ে চলবে ।

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

সপ্তম- সম্যক ব্যায়াম অর্থাৎ সৎ চিন্তা । মানুষ এই সময় কেবল সৎ ও পবিত্র চিন্তা-ভাবনার দ্বারা মনকে পূর্ণ করে রাখবে । অষ্টম- এই স্তরে এসে মানুষ পরম শান্তি লাভ করবে । তাঁর মন এক গভীর প্রশান্তির স্তরে উত্তীর্ণ হবে । বুদ্ধ যে অষ্টমার্গের উপদেশ দিয়েছিলেন তা মূলত তাঁর সন্ন্যাসী আশ্রম বা সঙ্গ শিষ্যদের জন্য । কিন্তু তিনি তাঁর প্রখর বাস্তব চেতনা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সাধারণ গৃহী মানুষ কখনোই এই অষ্টমার্গের পথকে সম্পূর্ণ অনুসরণ করতে পারবে না । তিনি সমগ্র মানব সমাজের জন্য দশটি নীতি প্রচলন করলেন –

১. তুমি কোন জীব হত্যা করবে না ।

২. অপরের জিনিস চুরি করবে না ।

৩. কোন ব্যভিচার বা অনাচার করবে না ।

৪. মিথ্যা কথঅ বলবে না, কাউকে প্রতারণা করবে না ।

৫. কোন মাদক দ্রব্য গ্রহণ করবে না ।

৬. আহারে সংযমী হবে । দুপুরের পর আহার করবে না ।

৭. নৃত্যগীত দেখবে না ।

৮. সাজসজ্জা অলঙ্কার পরবে না ।

৯. বিলাসবহুল শয্যায় শোবে না ।

১০. কোন সোনা বা রূপা গ্রহণ করবে না ।

এই দশটি উপদেশের মধ্যে প্রথম পাঁচটি ছিল সাধারণ মানুষের জন্য । আর সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে দশটি উপদেশই পালনীয় । বুদ্ধের এই উপদেশ জনগণের মধ্যে প্রচার করার জন্য তাঁর ষাট জন বিশিষ্ট শিষ্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল । এবার বুদ্ধ তাঁর কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে রওনা হলেন গায়ার পথে ।

বুদ্ধ তাঁর কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে রওনা হলেন কপিলাবস্তুর পথে । মহারাজ শুদ্ধোধনের মনে ক্ষীণ আশা জেগে ওঠে, হয়ত পুত্র তাঁর রাজ্যের ভার গ্রহণ করবে। বুদ্ধ নগরে প্রবেশ করতেই বৃদ্ধ পিতা ছুটে গেলেন তাঁর কাছে । কিন্তু এ তিনি কাকে দেখলেন ! পরনে পীতবস্ত্র, একদিকে কাঁধ অনাবৃত । মস্তক মুণ্ডন । হাতে ভিক্ষাপাত্র । তিনি ভিক্ষাপাত্র হাতে নগরের মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইছেন । যে কিনা সমগ্র রাজ্যের যুবরাজ সে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছে ।

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

লজ্জায় ক্ষোভে মাথা নত করলেন শুদ্ধোধন । বুদ্ধ এগিয়ে এলেন পিতার কাছে । এসে তাকে প্রণাম করে বললেন, আপনি হয়ত পুত্রস্নেহ অনেক ব্যথিত হয়েছেন । মন থেকে এই মায়া আপনি দূর করুন । এই জগৎ অনিত্য । রাজা শুদ্ধোধন উপলব্ধি করলেন তাঁর সম্মুখে যে দাঁড়িয়ে আছে সে তাঁর পুত্র নয়, মহাজ্ঞানী মানবশ্রেষ্ঠ তথাগত বুদ্ধ । পুত্রকে নিয়ে রাজপ্রসাদে গেলেন । প্রাসাদের অন্তঃপুরে বসেছিলেন যশোধারা । তিতি ভাবলেন যতক্ষণ না বুদ্ধ তাঁর কাছে আসে, তিনি কোথাও যাবেন না ।

বুদ্ধের হৃদয় যশোধারার সাথে সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল । তিনি দু’জন শিষ্যকে নিয়ে অনঃপুরে প্রবেশ করলেন । বুদ্ধকে দেখামাত্রই উঠে এলেন যশোধরা । তাঁর উপর লুটিয়ে পড়লেন যশোধরা । বুদ্ধ তাঁকে শান্ত করে বলবেন, হে আমার পুত্রের জননী, আমি জানি তুমিও জন্ম জন্মান্তর ধরে সৎ পবিত্র জীবন যাপন করছ, তাই আমি তোমাকে মুক্তির পথ দেখাতে এসেছি । আমি তোমাকে যে উপদেশ দেব তুমি সেই পথ অনুসরণ কর, তাবেই জীবনের সব মায়া বন্ধনের উর্ধ্বে উঠতে পারবে । আর সেখানে অপেক্ষা করলেন না বুদ্ধ ।

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

পরদিন বুদ্ধ নগরে বেরিয়েছেন ভিক্ষাপাত্র হাতে । এমন সময় প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে যশোধরা তাঁর পুত্র রাহুলকে  বললেন, ঐ যে দিব্যকান্তি পুরুষ পথ দিয়ে চলেছেন উনি তোমার পিতা । যাও ওর কাছ থেকে গিয়ে তোমার উত্তরাধিকার চেয়ে নাও । পুত্র রাহুল গিয়ে দাঁড়াল বুদ্ধের সামনে । তাঁকে প্রণাম করে বলল, আমি তোমার পুত্র । তুমি আমাকে আমার উত্তরাধিকার দাও । এবার এলেন তাঁর ভাই আনন্দ । আনন্দ প্রজাপতির পুত্র ।

তিনি বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। সকলকে নিয়ে বুদ্ধ কপিলাবস্তু ত্যাগ করে এলেন শ্রাবস্তী নগরে । এখানে তাঁর থাকবার জন্য অনাথ পিণ্ডক নামে এক ধনী বণিক জেতবনে এক মঠ নির্মাণ করে দিলেন । একদিন কপিলাবস্তু থেকে মহাপ্রজাপতির দূত এর বুদ্ধের কাছে । তাঁর সংসার জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করে সঙ্গে আশ্রয় নিতে চান । তাঁর সাথে যশোধারা ও আরো অনেকেই সন্ন্যাস গ্রহণ করতে চায় । কিন্তু বুদ্ধ নারীদের সন্ন্যাস গ্রহণকে মেনে নিতে পারলেন না । তিনি মাতা মহাপ্রজাপতির অনুরোধ ফিরিয়ে দিলেন ।

আনন্দ ছিলেন বুদ্ধের প্রধান শিষ্য । আনন্দের অনুরোধে বুদ্ধ বললেন, বেশ তাহলে তাদের সঙ্গে প্রবেশ করার অনুমতি দিলাম । তবে সঙ্ঘের নিয়ম ছাড়াও আরো আটটি নিয়ম তাঁদের মেনে চলতে হবে । মাতা মহাপ্রজাপতি বুদ্ধের সমস্ত নিয়ম মেনে চলার অঙ্গীকার করলেন । বুদ্ধ অনুমতি দিলেও নারীদের এই সংঘে প্রবেশ করার বিষয়টিকে কোন দিনই অন্তর থেকে সমর্থন করতে পারেননি ।

বুদ্ধ আনন্দকে বললেন, যদি নারীরা সঙ্ঘে প্রবেশ না করত তবে বৌদ্ধ ধর্ম হাজার হাজার বছর ধরে ভারতের বুকে রয়ে যেত । কিন্তু নারীরা প্রবেশ করার জন্য কিছু দিনের মধ্যেই আমার প্রবর্তিত সব নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে । বুদ্ধের এই আশঙ্কা সত্য বলেই পরবর্তীকালে  প্রমাণিত হয়েছিল ।

গৌতম বুদ্ধ এর জীবনী

জীবনের দিন যতই শেষ হয়ে আসছিল ততই মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তেন । বিশেষত বর্ষার প্রকোপেই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তেন । জীবনের অন্তিম পর্বে (বুদ্ধ তখন আশি বছরে পা দিয়েছেন) বুদ্ধ তাঁর কয়েকজন শিষ্য নিয়ে এলেন হিরণ্যবতী নদীর তীরে কুশীনগরে । ঘুরতে ঘুরতে এসে দাঁড়ালেন এক শারবনের নিচে । আনন্দ গাছের নিচে বিছানা পেতে দিলেন । সামান্য কয়েকজন শিষ্য সেখানে দাঁড়িয়েছিল । তাঁরা সকলেই উপলব্ধি করতে পারছিলেন ভগবান তথাগত এবার তাঁদের ত্যাগ করে যাবেন । এবার আনন্দকে কাছে ডাকলেন বুদ্ধ। বললেন, আমি যখন থাকব না, আমার উপদেশ মত চলবে, আমার উপদেশই তোমার পথ নির্দেশ করবে ।

বুদ্ধদেব তাঁর কোন উপদেশ লিপিবদ্ধ করে যাননি । তাঁর মৃত্যুর পর বৌদ্ধ স্থবির শ্রমণরা মিলিতভাবে তাঁর সমস্ত উপদেশ সংকলিত করেন । এই সংকলিত উপদেশই ত্রিপিটক নামে পরিচিত । ত্রিপিটক বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ । বুদ্ধ শেষ বারের মত শিষ্যদের কাছে ডেকে তাঁদের উপদেশ দিলেন তারপর গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন । সে ধ্যান আর ভাঙল না । 

বৌদ্ধদের মতে বুদ্ধ দেহত্যাগ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৪ সালে । কিন্তু আধুনিক কালের ঐতিহাসিকদের মতে বুদ্ধের মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ বা ৪৮৩।

 

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের জীবনী

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *