আর আংটিটা যদি সত্যিই ফেলুদার কাছে থেকে থাকে, আর সেটার পিছনে যদি সত্যিই ডাকাত লেগে থাকে, আর সে ডাকাত যদি জেনে থাকে যে ফেলুদার কাছেই আংটিটা আছে—তা হলে ? সেটা সে জানে বলেই কি ফেলুদা ও সব হুমকি দেওয়া-দেওয়া কাগজ পাচ্ছে, আর ওর দিকে গুলতি দিয়ে ইট মারছে, আর লাঠির ডগায় ক্লোরােফর্মের ন্যাকড়া বেঁধে আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ? ফেলুদা কিন্তু সারা রাস্তা গুনগুন করে গান গেয়েছে। একবার গান থামিয়ে আমায় বলল,
খটু বলে একটা রাগ আছে জানিস ? এটা সেই রাগ ! সকালে গাইতে হয়।’
আমি বলতে চেয়েছিলাম যে ‘খটটট জানি না, রাগ-রাগিণী জানি না—কিন্তু আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে আর খটকা লাগছে তুমি আমায় ধাপ্পা দিলে কেন।’ কিন্তু কথাটা আর বলা হল না, কারণ তখন আমরা ধর্মশালায় পৌঁছে গেছি । মনে মনে ঠিক করলাম যে আজকের মধ্যেই
ফেলুদার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতেই হবে।
ধরমশালার বারান্দায় দেখি বাবা, বনবিহারীবাবু, শ্রীবাস্তব আর একজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালি ভদ্রলােক বসে গল্প করছেন।
বাবা আমাদের দেখেই বললেন, ‘ট্যাক্সির ব্যবস্থা হয়ে গেছে-কাল ভাের ছটায় রওনা । বনবিহারী বাবুর চেনা থাকায় বেশ শস্যায় হয়ে গেল।’
বাঙালি ভদ্রলােক শুনলাম এলাহাবাদে থাকেন—নাম বিলাসবাবু । তিনি নাকি একজন নামকরা হাত-দেখিয়ে । আপাতত বনবিহারীবাবুর হাত দেখছেন! বনবিহারীবাবু বললেন, ‘কোনও জানােয়ারের কামড়-কামড় খেয়ে মরব কি না সেটা একবার দেখুন তো।’
ভদ্রলোক হাতে একটা লবঙ্গ নিয়ে বনবিহারীবাবুর হাতের উপর বুলােতে বুলােতে বললেন, “কই, তা তাে দেখছি না। স্বাভাবিক মৃত্য বলেই তো মনে হচ্ছে।
ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (শেষ-পর্ব)
হতে পারেন বিলাসবাবু হত-দেখিয়ে, আমার কিন্তু তাঁর পা-টা দেখে ভারী অদ্ভুত লাগল। বুড়াে আঙুলটা তার পাশের আঙুলের চেয়ে প্রায় আধ ইঞ্চি বড় । আর সেটা দেখে মনে হল খুব রিসেন্টলি যেন আমি সেরকম পা দেখেছি। কিন্তু কোথায় বা কার পা সেটা মনে করতে পারলাম না ।
বনবিহারীবাবু একটা হাঁফ-ছাড়ার শব্দ করে বললেন, “যাক, বাঁচা গেল।’ ‘কেন মােশাই, আপনি কি শিকার করেন নাকি ? বাঘ-ভালুক মারেন ? বিলাসবাবুর বাংলায় একটা অবাঙালি টান লক্ষ করলাম।
বনবিহারীবাবু বললেন, ‘না। তবু—এ সব জেনে-টেনে রাখা ভাল। আমার এক খুড়তুতাে ভাই-কোথাও কিছু নেই-হঠাৎ এক পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে হাইড্রোফোবিয়ায় মরল । তাই আর কী…
‘আপনি কি আগে কলকাতায় ছিলেন ? বিলাসবাবু জিজ্ঞেস করলেন। বনবিহারীবাবু একটু অবাক হয়েই বললেন, ‘ওটাও কি হাতের রেখায় পাওয়া যায় নাকি ?
তাই তাে দেখছি ! আর…আপনার কি পুরনাে আমলের শিল্পদ্রব্য বা অন্য দামি জিনিস জমানাের শখ আছে ?
‘আমার ? না না–~~~-আমার কেন ? সে ছিল পিয়ারিলালের। আমার শখ জন্তু জানােয়ারের।
তাই কি ? তাই কামড় খাওয়ার কথা বলছিলেন ? কিন্তু, কিন্তু কী ?
বনবিহারীবাবুকে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হল। বিলাসবাবু প্রশ্ন করলেন, আপনার কি সম্প্রতি কোনও উদ্বেগের কারণ ঘটেছে ?
‘সম্প্রতি মানে ?
ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (শেষ-পর্ব)
এই ধরুন–গত মাসখানেকের মধ্যে ? বনবিহারীবাবু বেশ জোরে হেসে উঠে বললেন, “মশাই–আমার, যাকে বলে, নট এ কেয়ার ইন দ্য ওয়লড়। কোনও উদ্বেগ নেই। তবে হ্যাঁ—একটা অ্যাংজাইটি আছে এই যে, কাল লছমনঝুলায় গিয়ে একটা বারাে ফুট অজগরের দেখা পাব কি না পাব।’
বিলাসবাবুর বােধহয় আরেকটু দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু বনবিহারীবাবু হঠাৎ হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে একটা হাই তুলে বললেন, আসলে ব্যাপারটা কী জানেন—কিছু মনে করবেন ––এ সব পামিস্ত্রি-ফামিস্ট্রিতে আমার বিশ্বাস নেই। আমাদের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সবই আমাদের হাতে বটে কিন্তু সেটা হাতের রেখায় নয়। হাত বলতে আমি বুঝি ক্ষমত, সামর্থ্য। সেইটের উপরেই সব নির্ভর করে।
এই বলে বনবিহারীবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে সােজা ঘরের ভিতর চলে গেলেন। আমার চোখ আবার চলে গেল বিলাসবাবুর পায়ের দিকে।
অনেক ভেবেও কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কোথায় দেখেছি ওরকম লম্বা বুড়ােআঙুলওয়ালা পা।
সারাদিনের মধ্যে একবারও ফেলুদাকে সেই ঝলমলে জিনিসটার কথা জিজ্ঞেস করার সুযােগ পেলাম না।
রাত্রে বাবা যদিও বললেন, ‘তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়, ভােরে উঠতে হবে— তবুও খাওয়া-দাওয়া করে বিছানা পেতে শুতে শুতে প্রায় দশটা হয়ে গেল।
ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (শেষ-পর্ব)
লেপের তলায় যখন ঢুকছি, তখন আমাদের পাশাপাশি দুটো ঘরের মাঝখানের দরজা দিয়ে একটা বিকট নাক ডাকার আওয়াজ পেলাম।
ফেলুদা বলল, ‘বিলাসবাবু।’ আমি বললাম, “কী করে জানলে ? ‘কেন, কাল ট্রেনেও ডাকছিল—-শুনিসনি ?
ট্রেনে ? বিলাসবাবু ট্রেনেও ছিলেন ? তাই তাে ! একটা রহস্যের হঠাৎ সমাধান হয়ে গেল।
ওই বুড়াে আঙুল ! ফেলুদা আস্তে করে আমার পিঠ চাপড়ে বলল, গুড়। ঠিক কথা। আমাদের উপরের বাঙ্কে উনিই সারা রাস্তা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলেন। কেবল পায়ের ডগা দুটো বেরিয়ে ছিল বাঙ্ক থেকে, আর তখনই দেখেছিলাম ওই বুড়াে আঙুল
কিন্তু এবার যে আসল প্রশ্নটা করতে হবে ফেলুদাকে। বাবার নড়াচড়া দেখে বুঝতে পারছিলাম উনি এখনও ঘুমােননি। বাবা না ঘুমােলে কথাটা বলা চলে না, তাই আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। | ধরমশালাটা ক্রমেই আরও নিঝুম হয়ে আসছে, আর তার সঙ্গে সমস্ত শহরটা। শীতকাল, তাই এমনিতেই লােকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। আমাদের ঘরের ভিতর অন্ধকার । বাইরে উঠোনে বােধহয় একটা লাইট জ্বলছে আর তারই আলাে আমাদের দরজার চৌকাঠে এসে পড়েছে। একবার আমাদের ঘরের মেঝে থেকে যেন খুট করে একটা শব্দ এল ? বােধহয় ইঁদুর-টিদুর কিছু হবে ।
ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (শেষ-পর্ব)
এবার বাবার খাটিয়া থেকে শুনলাম এঁর জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ার শব্দ ! বুঝলাম উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি ফেলুদার দিকে ফিরলাম। তারপর গলা নামিয়ে একেবারে ফিসফিস করে বললাম, ওটা আংটিই ছিল, তাই না?
ফেলুদা কিছুক্ষণ চুপ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমারই মতাে ফিসফিস্ করে বলল, “তুই যখন জেনেই ফেলেছিস, তখন আর তাের কাছে লুকোনাের কোনও মানে হয় না। আংটিটা আমার কাছেই রয়েছে, সেই প্রথম দিন থেকেই। তােরা সব ঘুমিয়ে পড়ার পর, ধীরুকাকার ঘরে আলনায় ঝোলানাে ওঁর পাঞ্জাবির পকেট থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে আংটিটা বার করে নিই। বাক্সটা নিইনি যাতে ডেফিনিটলি বােঝা যায় আংটিটা গেছে।’
Read More